পা হড়কালেই কয়েক হাজার ফুট নিচে

৫ হাজার ৬৪২ মিটার উচ্চতার মাউন্ট এলব্রুস ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু পর্বত আর আফ্রিকার কিলিমানজারোর উচ্চতা ৫ হাজার ৮৯৫ মিটার। ১৫ দিনের ব্যবধানে দুই মহাদেশের এই দুটি পর্বতচূড়ায় পা রেখেছেন বাংলাদেশি পর্বতারোহী জাফর সাদেক। শুনুন এলব্রুসের অভিজ্ঞতা।

প্রতি পদক্ষেপে বরফের ভেতর থেকে পা টেনে বের করে হাঁটা অনেক কষ্টসাধ্য কাজ
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আকাশে একফালি চাঁদ। চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে ককেশাস পর্বতমালার গিরিশিরা। নিচে আজাউ হিমবাহ গলে সর্পিলাকারে বয়ে চলা বকসান নদীতে মিশছে। কান পাতলেই কলকল ধ্বনি শোনা যায়। জর্জিয়া-রাশিয়ার সীমান্তে এশিয়া থেকে ইউরোপকে আলাদা করেছে সর্বোচ্চ পর্বত এলব্রুস। আমার মতো মাউন্ট এলব্রুসের হাই ক্যাম্পে অপেক্ষমাণ পর্বতারোহীদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে তার শৃঙ্গ, সেখানে যেতে হলে পাড়ি দিতে হবে বন্ধুর পথ।

মাউন্ট এলব্রুস হাই ক্যাম্পে আজ তাই সাজ সাজ রব। ২২ জুলাই অভিযান শুরু করে এখানে পৌঁছেছি ২৫ জুলাই। এক দিন অপেক্ষার পর পাওয়া গেল তুলনামূলক আরোহণ উপযোগী আবহাওয়া। তাই তাঁবু থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসছেন অভিযাত্রীরা। আমিও আইস বুট, আইস এক্স, হারনেস, ক্রাম্পনসহ পর্বতারোহণের কারিগরি গিয়ার পরে নিজেকে প্রস্তুত করলাম। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ১৮-২০ ডিগ্রি নিচে! বাইরের প্রচণ্ড বাতাস মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইস বুটে ক্রাম্পন বাঁধার জন্য হাতের গ্লাভস খুলতেই ঠান্ডায় হাতটা রীতিমতো জমে গেল। কোনোভাবেই ক্রাম্পনের ফিতা শক্ত করে বাঁধতে পারছি না। দূর থেকে অ্যালেক্স বুঝতে পেরে বলল, ‘দ্রুত গ্লাভস পরে নাও, আমি ফিতা বেঁধে দিচ্ছি।’

চূড়া অভিমুখে অভিযাত্রীরা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আলেকজান্ডার অ্যালেক্স আমাদের পাঁচ সদস্যের দলের দলনেতা। রাত দুইটার দিকে তাঁর নেতৃত্বে এলব্রুস সামিটের উদ্দেশে রওনা দিলাম। নরম বরফের ওপর দিয়ে খাঁড়া ওপরে ওঠা ভীষণ কষ্টের কাজ। নরম বরফের ভেতর পা আটকে যাচ্ছিল। প্রতি পদক্ষেপে বরফের ভেতর থেকে পা টেনে বের করে হাঁটা অনেক কষ্টসাধ্য কাজ। দাঁতে দাঁত চেপে বরফের দেয়াল বেয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটছি। হালকা বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকে বলে এভাবে ট্রেকিং করার সময় দম রাখাও কঠিন হয়ে পড়ে।

অন্য পর্বতারোহীরাও দলে দলে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিছুটা সময় ট্রেক করার ফলে শরীরের তাপ বেড়ে গেল। ঠান্ডা ভাবও অনেকটা কেটে গেল। চলার গতিতে ছন্দ ফিরে পেলাম। বাতাসে উড়ে আসা মিহি দানার মতো বরফ চোখে পড়ছিল বলে স্নো গগলস পরে নিলাম। দক্ষিণ চূড়ার রিজলাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। দেখতে পেলাম বাঁ পাশের ঢাল বরাবর দূরে লাল নিশান। খারাপ আবহাওয়ার কারণে সৃষ্ট হোয়াইট আউটে অভিযাত্রীরা যেন দিশা না হারান, সে জন্যই খুঁটি পুতে নিশান উড়িয়ে রাখা হয়েছে। এই পথে আরোহণ করার সময় কিছুটা ডান দিকে ঝুঁকে বাঁ পাশ আইস এক্সের সহযোগিতায় ভারসাম্য রক্ষা করে এগিয়ে যেতে হয়। না হলে নিচে গড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল।

এলব্রুস পর্বতের দক্ষিণ প্রান্তে শোল্ডারের কাছাকাছি যখন পৌঁছালাম, তখন পুবের আকাশ রক্তিম হয়ে উঠেছে। প্রকৃতিতে ভোরের আভাস। ধীরে ধীরে সূর্যের উদয় হলো। ককেশাস পর্বতমালায় সূর্যোদয় দেখার সময় প্রমিথিউসের কথা মনে পড়ল। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিতে বলা আছে, স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে দেওয়ার অপরাধে প্রমিথিউসকে শাস্তি দেন দেবরাজ জিউস। তাঁকে শিকলে বেঁধে এই ককেশাস পর্বতমালায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর দেওয়া হয় আরও কঠোর শাস্তি।

প্রমিথিউসের কথা ভাবতে ভাবতেই এলব্রুস শৃঙ্গের নিচে পৌঁছে গেলাম। এখানে অভিযাত্রীদের জটলা। মূল সামিটে যাওয়ার জন্য এলব্রুসের কাঁধ বরাবর এই ৪০০ মিটার ফিক্সড রোপ (স্থায়ী দড়ি) বেয়ে উঠতে হয়। ফিক্সড রোপে হারনেসের সঙ্গে সংযুক্ত ক্যারাবিনার মাধ্যমে নিজেকে আটকে রিজলাইন ধরে চূড়ার দিকে সাবধানে এগিয়ে যেতে হয়। এখানে প্রায়ই বরফধসের কারণে পর্বতারোহীরা দুর্ঘটনায় পড়েন।

এলব্রুস শৃঙ্গে জাফর সাদেক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

একটু পা হড়কালেই কয়েক হাজার ফুট নিচে পতনের আশঙ্কা নিয়ে দড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। দড়ি থেকে নিজেকে মুক্ত করে দেখি, একটি টিম চূড়ায় উঠে গেছে। এই সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। বহুদিন পুষে রাখা স্বপ্ন পূরণের স্থান। আর ২০ মিটার ওপরই জায়গাটা। তার আগেই রুকস্যাক থেকে লাল–সবুজের পতাকাটা আইস এক্সে বেঁধে নিলাম। কয়েক কদমের দূরত্ব যেন শেষ হয় না। সময় এখানে যেন থমকে গেছে। সবকিছু ধীরগতিতে চলছে।

আমাদের আগের অভিযাত্রী দলটা নেমে এল। মাউন্ট এলব্রুসের চূড়ায় উঠে পড়লাম আমরা। আইস এক্সে বাঁধা লাল-সবুজ পতাকাটা তুলে ধরলাম মাথার ওপর। যুদ্ধ জয়ের পর রণাঙ্গনের সৈন্যরা যেমন আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, তেমনি বিভিন্ন দেশের অভিযাত্রীরা একে অন্যকে অভিবাদন জানাল। প্রত্যেকে নিজ দেশের পতাকা হাতে ফটাফট ছবিও তুলছে। এরই মধ্যে কে যেন কাকে উল্লাস করে বলল, এখানে থেমো না, যেতে হবে বহুদূর।

সত্যিই তো, বহু পথ এখনো বাকি। আমাকেও দ্রুত নেমে আফ্রিকার পথ ধরতে হবে। কিলিমানজারো জয়ের পরই যে দেশে ফেরার সংকল্প।