১০ বছরের অহনা ঘুরে এল অন্নপূর্ণা

অপরূপ অন্নপূর্ণায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে অহনা ও তাঁর বাবা অনিকেত চৌধুরীছবি: অনিকেত চৌধুরীর সৌজন্যে

অপরূপ অন্নপূর্ণা পর্বতশৃঙ্গে ওঠার সময় তাপমাত্রা ছিল ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। এত ঠান্ডা আগে কখনো অনুভব করিনি। পাঁচটা শীতের পোশাক গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিল বাবা। কাঁধে চার কেজি ওজনের ব্যাগ ছিল। এসব নিয়েই হাঁটা শুরু করেছি। কখনো পাথরের পথ ধরে খাড়া উঠেছি, কখনো হিমশীতল বরফের মাঝখানে চলেছি। আমার অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করেছে।

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলছিল অহনা রিদা জাহরা। বয়স তার মাত্র ১০ বছর। পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। চলতি মাসের শুরুতে সে ঘুরে এসেছে উচ্চতায় বিশ্বের দশম পর্বতশৃঙ্গ অন্নপূর্ণা। বেজ ক্যাম্প পর্যন্ত গিয়েছিল সে। উঠেছিল ৪ হাজার ১৩০ মিটার উচ্চতায়। সঙ্গে ছিলেন বাবা অনিকেত চৌধুরী। হিমালয়কন্যা নেপালের মতো অনিন্দ্যসুন্দর দেশ। সব মিলিয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্য অবলোকনের অভিজ্ঞতা। অহনারা ফিরে এসেছে গত বৃহস্পতিবার। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে প্রথম আলোর এ প্রতিবেদকের কাছে বাবা-মেয়ে জানাল দুর্দান্ত সেই অভিজ্ঞতার কথা।

আগে বাবা অনিকেত চৌধুরীর কণ্ঠেই শোনা যাক। অনিকেত বলেন, ৩০ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে চেপে বসেন তাঁরা। ঢাকা থেকে ১১ সদস্যের একটি দল যাত্রা শুরু করে। ভ্রমণের ব্যবস্থাপনায় ছিল রোপফোর নামের সংগঠন। এই ১১ জনের এটিই ছিল প্রথম হিমালয় যাত্রা। বেলা দুটার দিকে নেপালে পৌঁছে যান তাঁরা।

বেজ ক্যাম্পে ওঠার আগে
ছবি: অনিকেত চৌধুরীর সৌজন্যে

নেপাল পৌঁছানোর পরের গল্পটা নতুনত্বে ভরা। দেশ, সংস্কৃতি, খাবারদাবার—সবকিছুই অন্য রকম। তবে বিমানবন্দর থেকে অন্নপূর্ণার দিকে যাওয়ার আগে অহনার কাছ থেকে প্রস্তুতি সম্পর্কে জেনে আসা যাক। অহনা প্রথম আলোকে বলল, ‘করোনার পরিস্থিতির পর বাবা আমাকে নিয়ে বান্দরবানের নাফাখুম গিয়েছিলেন। সঙ্গে মা-ও ছিলেন। আমি সবার আগেই হেঁটে অনেক জায়গা পেরিয়ে গিয়েছিলাম। কোনো ক্লান্তি আসেনি। পরে বাবা বলেছেন নেপালে নিয়ে যাবেন। এরপর আমরা চন্দ্রনাথ পাহাড়ে এক দিনে দুইবার ওঠা-নামা করে প্রস্তুতি নিই।’

অহনা চিটাগং সানশাইন গ্রামার স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে। তার বাবা অনিকেত চৌধুরী পেশায় স্থপতি। মা মেহজাবিন ইবানা ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। নগরের নাছিরাবাদ আবাসিক এলাকায় থাকেন তাঁরা।

পথে যেতে যেতে

ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে অহনারা পৌঁছায় থামেল। সেখানে কিছু কেনাকাটা ও প্রস্তুতি সেরে ৩০ অক্টোবর রাত আটটার দিকে পোখারার উদ্দেশে রওনা দেয় তারা। পোখারাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর পাঁচটা হয়ে গিয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে তারা হোটেলে উঠল। সকালের নাশতা সেরে ভোরেই প্রথম বরফে ঢাকা সাদা-পাহাড় দেখে অহনা। আকাশ ছিল ঝকঝকে। ফলে দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল পাহাড়গুলো।

নয়টার দিকে জিপে চড়ে তারা চলে যায় ঝিনু নামক স্থানে। কখনো পাথরের, কখনো পিচঢালাই, কখনো পাহাড়ের বুকে এঁকে বেঁকে চলা পথ দিয়ে তারা ঝিনুতে পৌঁছায়। সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টার মতো। পথে ছবি তোলা, ঝরনা দেখা তো ছিলই। এখান থেকে অন্নপূর্ণার মূল ট্র্যাকিং শুরু হয়। অহনার বাবা অনিকেত চৌধুরী বলেন, ‘ঝিনু থেকে বিকেল চারটার দিকে চোমরংয়ের (২ হাজার ১৭০ মিটার) পথ ধরি সবাই। তখন আকাশ খানিকটা মেঘলা হতে শুরু করেছে। ঠান্ডা হাওয়া নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল সবাইকে। ঝিনু থেকে চোমরং যাওয়ার পথটি মসৃণ নয়। রাস্তাটি পুরোপুরি খাড়া। সিঁড়ির সংখ্যাও অনেক। পথে অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে একসময় পৌঁছে যাই চোমরংয়ে। সময় লাগে তিন ঘণ্টার মতো।’

মেয়ের সঙ্গে বাবার সেলফি
ছবি: অনিকেত চৌধুরী

পথে যেতে যেতে সবার আগেই ছিল অহনা। কখনো তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি, এমনটাই বললেন অনিকেত চৌধুরী। মচ্ছপুছারে পর্বতশিখর দেখে বিমোহিত হয়ে পড়ছিল সে। পাশাপাশি ঝুলন্ত সেতুর ওপর ছবিও তুলেছিল সে। ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে চোমরংয়ে পৌঁছান সবাই। রাতে ঠান্ডা আরও বাড়তে থাকে। একসময় তাপমাত্রা নেমে যায় ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কিন্তু সেই ঠান্ডাও দমাতে পারেনি অহনাকে। রাতে ভাত, ডাল, সবজিসহ নানা খাবার শেষে সবাই বিশ্রামে চলে যান। একটা লজে উঠেছিলেন তাঁরা। যেখানে ছিল ওয়াই-ফাই, বিদ্যুৎসহ নানা সুবিধা।

পরদিন ১ নভেম্বর সকালে নাশতা সেরে সবাই রওনা দেন ডোবানের (২ হাজার ৫০৫ মিটার) উদ্দেশে। পাহাড়ি পথ বেয়ে শুরুতে ঘণ্টা দেড়েক নিচে নামতে হয় সবাইকে। আবার দেড় থেকে দুই ঘণ্টার মতো খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠেন। প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আট ঘণ্টায় তাঁরা পৌঁছান ডোবানে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ডোবানে পৌঁছান।

‘২ নভেম্বর সকাল আটটার দিকে আবার ট্র্যাকিং শুরু করি। এবারের গন্তব্য হিমালয়া গ্রাম (২ হাজার ৮৬৪ মিটার) হয়ে দেউরালি (৩ হাজার ২০০ মিটার)। পাঁচ ঘণ্টা হাঁটার পর দেউরালির হাতের মুঠোয় চলে আসে। দেউরালির মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা আমরা কখনো ভুলব না। অহনাও প্রতিটি মুহূর্ত খুবই উপভোগ করছিল,’ বলেন অনিকেত চৌধুরী।

অবশেষে অন্নপূর্ণায়

অন্নপূর্ণা বেজ ক্যাম্পে অহনা
ছবি: অনিকেত চৌধুরীর সৌজন্যে

দিনপঞ্জিকায় সেদিন ৩ নভেম্বর। দেউরালি থেকে ভোরের আলো ফোটার পর রওনা দেন অনিকেত চৌধুরী, অহনা এবং তাদের দল। এই পথে যেতে যেতে অহনা প্রথম তুষারপাত দেখে। পথে পাহাড়ি কুকুরের সঙ্গে ছবিও তোলে। দেউরালি থেকে মচ্ছপুছারে বেজ ক্যাম্প (৩ হাজার ৭২০ মিটার) হয়ে সবাই পৌঁছান অন্নপূর্ণা বেজ ক্যাম্প, যার উচ্চতা ৪ হাজার ১৩০ মিটার। সাত ঘণ্টা হেঁটে সবাই অন্নপূর্ণা স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তখন তাপমাত্রা মাইনাসে চলে গিয়েছিল। এসব তথ্য জানাতে গিয়ে অনেকটা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন অনিকেত চৌধুরী ও তাঁর মেয়ে অহনা। তাঁরা বলেন, ‘অন্নপূর্ণায় যাওয়ার পথে প্রচুর ঝরনা দেখতে পাওয়া যায়। অনেক ঝরনা হেঁটে পার হতে হয়। আর চারদিক ছিল নিস্তব্ধ। এমন সময় আর পাইনি।’

ছবি: অনিকেত চৌধুরীর সৌজন্যে

৪ নভেম্বর অহনারা ফেরার পথ ধরে। সব পথ ঘুরে ৬ নভেম্বর তারা পোখারা ফিরে আসে। এরপর পোখারা শহরের নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, বাজার, মহাদেব গুহা, ঝরনা দেখে সময় পার করে। ৯ নভেম্বর দুপুরে বাংলাদেশে চলে আসে সবাই।

এত দূরের পথ মা মেহজাবিন ইবানাকে ছাড়াই পাড়ি দিয়েছে অহনা। তবে মায়ের কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। মেহজাবিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অহনা মানসিকভাবে বেশ দৃঢ়। তাকে নিয়ে দেশের ভেতরের নানা জায়গায় আমরা গিয়েছি। অনেক পথ হাঁটতে পারে সে; বরং তার বাবাকে নিয়ে খানিকটা দুশ্চিন্তাই ছিলাম। কিন্তু সফলতার সঙ্গেই অন্নপূর্ণা ঘুরে এসেছে।’ অহনাও জানাল, ভবিষ্যতে সে আরও নানা জায়গায় ট্র্যাকিংয়ে যেতে চায়।

অহনাদের ভ্রমণের ব্যবস্থাপনায় থাকা রোপফোর আউটডোর এডুকেশনের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, পুরো ভ্রমণে বেশ সতেজ ছিল অহনা। উল্টো দলের সবাইকে সে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

দলের সবাইকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে অহনা
ছবি: অনিকেত চৌধুরীর সৌজন্যে

অহনাই অনুপ্রেরণা

অহনার অন্নপূর্ণা দর্শনের বিষয়টি নিয়ে বেশ আনন্দিত সানশাইন গ্রামার স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সাফিয়া গাজী রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন শিশুরা মুঠোফোনের ওপর ঝুঁকে পড়ছে। মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করার সুযোগও কমে যাচ্ছে। সে জায়গায় অহনা দেশ-বিদেশের নানা জায়গায় ঘুরছে। এটা সত্যিই অনুপ্রেরণা জোগাবে অন্য অনেককে।

নেপালের পথে
ছবি: অনিকেত চৌধুরীর সৌজন্যে

অন্নপূর্ণার বেজ ক্যাম্পে যেতে দিনের পর দিন হাঁটতে হয়েছে। আবার প্রচণ্ড ঠান্ডার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। শিশুদের জন্য এই ট্র্যাকিং কতটুকু নিরাপদ, সে প্রশ্নের বিশদ উত্তর দেন ফজলুর রহমান। তিনি এল্টিটিউড হান্টার নামের একটি ট্রাভেল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। নেপাল ও ভারতের বিভিন্ন পর্বতে তাঁরা ট্র্যাকিং করেন। ফজলুর রহমান বলেন, নেপালের অন্নপূর্ণা কিংবা এভারেস্টের বেজ ক্যাম্পে বিভিন্ন দেশের ৮ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুরা অহরহ যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকেও অনেকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গরম জামা রাখা, শিশুর হাঁটার অভ্যাস আছে কি না, এসব মাথায় রাখতে হবে। পাশাপাশি বড় কোনো ট্র্যাকিংয়ের আগে শিশুর ফিটনেস টেস্ট করিয়ে রাখতে হবে।