স্লোভাকিয়ার যে জায়গাটা পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা মনে করিয়ে দিল

পাহাড়ের গায়ে গড়া ওরাভা দুর্গছবি: লেখক

স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাটিস্লাভা থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার ট্রেনযাত্রা শেষে সবুজ পাহাড়, নদী আর মেঘ জানান দিল আমরা হাই টাট্রাস পর্বতমালার দিকে এগোচ্ছি। আস্তে আস্তে ট্রেনের গতি কমে ক্রালোভানি এসে থামল।

ক্রালোভানি থেকে ট্রেন বদলে কুবিন যাব। কিন্তু স্টেশনে নেমে জানা গেল শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ এ জন্য কুবিন পর্যন্ত বাসের ব্যবস্থা করে দিল। বাসে উঠতে গিয়ে মনে হলো স্নিগ্ধ জায়গাটায় কিছুটা সময় কাটাতে পারলে মন্দ হতো না। এলাকাটা এত সবুজ আর স্নিগ্ধ যে বারবার আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা মনে করিয়ে দিল।

ট্রেনের বদলে বাস হওয়ায় ভালোই হলো। লোকালয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। ঝাঁ–চকচকে বাসটি আঁকাবাঁকা-উঁচুনিচু রাস্তা ধরে আধা ঘণ্টা পর কুবিন এসে নামিয়ে দিল। এরপর আবার ট্রেনে উঠে মূল গন্তব্য ওরাভস্কি পোডজামকের স্টেশনে এলাম মিনিট বিশেক পরই।

স্টেশন থেকে বের হতেই চোখে পড়ল পাহাড়ের ওপরের বিশাল ওরাভা ক্যাসেল বা দুর্গ। সেখানেই যাব, তবে তার আগে গুগল ম্যাপে বুকিং করে আসা মোটেলটা খুঁজে নিলাম। পাহাড়ের পাদদেশে চমৎকার মোটেল দেখে মনটা ভরে গেল। বাড়ির মালিক ক্যারোলিনা নামে একজন। ফোন পেয়ে দ্রুত দরজা খুলে দিয়ে অভিনন্দন জানাল।

সিঁড়ি ভেঙে দুর্গের বিভিন্ন কক্ষে যেতে হয়
ছবি: লেখক

ছিমছাম বাড়ির নিচতলাটুকু নিজেদের বসবাসের জন্য রেখে ওপরতলায় ছয়টা রুম ভাড়া দেয় ক্যারোলিনা। আমার রুমের ব্যালকনি থেকে ওরাভা দুর্গের অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। মনে হলো, মাত্র ৪০ ইউরোতেই এমন দারুণ জায়গায় থাকছি!

দুপুর হয়েছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সঙ্গে আনা শুকনা খাবার খেয়েই বের হলাম ওরাভা দুর্গের উদ্দেশ্যে। মোটেল থেকে বেরিয়েই নদী। এখানে ক্যাম্পিং সাইট আছে। নদীতে অনেককেই কায়াকিং করতে দেখা গেল। আরও কিছুটা সামনে এগোতেই কিছু সুভ্যেনির শপ। উপহারের দোকানে ঢুঁ মেরে চলে গেলাম দুর্গের টিকিট কাউন্টারে। দুই রকমের টিকিট নেওয়া যায়। এক শ্রেণির টিকিট নিলে কেবল দুর্গের ভেতরে ঢুকে প্রথম তলা পর্যন্ত ঘোরার অনুমতি মেলে। আরেক শ্রেণির টিকিটে পুরো দুর্গ ঘুরে দেখা যায়। জনপ্রতি ১৩ ইউরোতে পুরো দুর্গ ঘোরার টিকিটই নিলাম।

দুর্গের একটি কক্ষে আছে নির্যাতনের এই প্রতীকী স্মারক
ছবি: লেখক

ওরাভা দুর্গ শত শত বছরের ইতিহাস বহন করে চলছে। দূর থেকে দেখতে ঈগল পাখির বাসার মতো। এই দুর্গ ১২৪১ সালে নির্মিত। এরপর ধীরে ধীরে দুর্গের বিস্তৃতি বাড়ে। একসময় তা ১৫৪ কক্ষের বিশাল দুর্গে রূপ নেয়। এখান থেকেই পরিচালিত হতো ওরাভা প্রশাসন। দুর্গের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তর উভয় ক্ষেত্রেই রোমান, গথিক, রেনেসাঁ, বারোক এবং এমনকি সমসাময়িক স্থাপত্যের প্রভাব আছে। পুরো স্থাপনাটিই পাহাড়ের আকৃতির সঙ্গে সমন্বয় করে গড়ে তোলা। ১৮ শতকের দিকে আগুন লেগে প্রাচীন দুর্গটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গই সংস্কার করে বর্তমান রূপ দেওয়া হয়েছে।

দুর্গ থেকে দেখা নিচের এলাকা
ছবি: লেখক

পাথুরে রাস্তার ঢাল বেয়ে কিছুটা উঠলেই দুর্গের প্রথম দরজা। দরজা দিয়ে ঢুকে সুড়ঙ্গের মতো পথ। এই পথে কিছু দূর এগোতেই বিশাল উঠোনের মতো জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। যার বাঁ পাশে দর্শনার্থীদের জন্য কয়েকটি কক্ষ আছে। আর সোজা সামনের সিঁড়ি দুর্গের আরও ওপরের দিকে উঠে গেছে। বাঁ পাশের কক্ষগুলোয় ঘুরে দেখলাম আদি আমলের বেশ কিছু পোশাক আর নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র। এখানে একটা ছোট চার্চও আছে।

সেখান থেকে বের হয়ে আরেক তলা উঠলে আরও কিছু কক্ষ দেখা যায়। এর মধ্যে একটা কক্ষ টর্চার সেলের আদলে গড়া। সম্ভবত অবাধ্য প্রজাদের এনে এখানে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের কথা ভেবে গা শিউরে উঠল। কক্ষটিতে বেশিক্ষণ না থেকে বেরিয়ে অন্যগুলোয় গেলাম। ঘুরতে ঘুরতে দুর্গের আরও ওপরে উঠে যাই। দুর্গের এই জায়গা থেকে নিচের গ্রামগুলো দারুণ দেখাচ্ছে। একটি কক্ষে ঢুকে দেখি আদি আমলের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা কয়েকজন যন্ত্রশিল্পী। আমাদের দেখে বাদ্যযন্ত্রে সুর তুললেন। মূলত পর্যটকদের বিনোদন দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তাঁরা এটি করেন। খুশি হয়ে পর্যটকেরা যা দেন, সেটাই তাঁদের আয়। এভাবে কক্ষে কক্ষে ঘুরে দেখলাম দুর্গের নকশা ও বিবরণ, দুর্গের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র, এই দুর্গে ধারণ করা বিভিন্ন সিনেমার পোস্টার।

বিকেল হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে নিচে নামতে নামতে শুরু করলাম। নামার সময় বুঝতে পারলাম সিঁড়ি বেয়ে কতটা ওপরে উঠেছিলাম।

আরও পড়ুন