খাগড়াছড়ির পাঙ্খোয়াদের গ্রামে গেলে জুমচাষিদের ছোট্ট বাজারটায় ঘুরে আসতে ভুলবেন না

ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্য স্থান থেকে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের নিয়ে খাগড়াছড়ির যেখানে বাস থামে, তার থেকে মিনিট কয়েক হাঁটলেই বাজার। ২০ অক্টোবরের শেষ বিকেলে হাঁটতে হাঁটতেই বাজারে গিয়ে হাজির হই। দিনের নিভু নিভু আলোয় পাঙ্খোয়া গ্রামের রাস্তার দুই পাশজুড়ে বসে তরতাজা সবজির বাজার। খাগড়াছড়ির পাহাড়ের জুমচাষের ফসল নিয়েই বসে রোজকার এই বাজার।

পাহাড়ের গায়ে জুমে চাষ করা বিষমুক্ত টাটকা শাকসবজিছবি: এম এ হান্নান

বাজার বলতে আমরা যেমনটা বুঝি, একসঙ্গে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ক্রেতা–বিক্রেতার সমাগম, ঠিক তেমন নয়। গাড়ি চলাচলের রাস্তার দুই পাশজুড়েই বাজার বসেছে।

রাস্তায় বড় যান তেমন নেই, রিকশা আর অটো। প্রতি সোম আর বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক বাজার বসলেও সপ্তাহের প্রতিদিনই এখানে বাজার সচল থাকে।

বিক্রেতার সিংহভাগই পাহাড়ি নারী। গায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, পিঠে বাঁশ–বেতের ঝুড়ি। সেই ঝুড়িতে নিজেদের ফলানো ফসল নিয়ে বাজারে হাজির হন তাঁরা।

তেমনই একজন সুখি রানী। খাগড়াছড়ির পানছড়িতে তাঁর বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি ‘নয় মাইল’। সেখান থেকেই জুমের ফসল নিয়ে এসেছিলেন। বিক্রি শেষে কাঁধের ঝুড়িটা একপাশে রেখে নেমে পড়লেন নিজেদের কেনাকাটায়।

বাজারে ওঠা ফসলের মধ্যে আছে শসা জাতীয় মারফা, বাঁশ কোরল, জলপাই, কাঁচা ভুট্টার মোচা, নানা রকমের পাহাড়ি কলা, মরিচ, কচু, কচুর ছরা, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, লেবু, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, মেটে আলু, আঁটি বাধা বরবটি, কাঁকরোল, মাশরুম, পুঁইশাকের বীজ, চুকুর পাতা, ধনেপাতা, পাহাড়ি কারিপাতা, পেঁপে, লাউশাক, কাঁচা তেঁতুল, কাঁচা হলুদ, হলুদের ফুলসহ অনেক সবজি।

ঝুড়িতে বোলে, পলি বা ত্রিপল কিংবা স্রেফ কলাপাতা বিছিয়ে ছড়িয়ে রাখা। দামটাও হাতের নাগালে—১০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যেই সব সবজি নেওয়া যায়।

এ বাজারে দামটাও হাতের নাগালে
ছবি: এম এ হান্নান

বাঁশ কোরল, তেঁতুল, কলা আর পুঁইশাকের বীজ নিয়ে দাঁড়িয়ে একজন। কেটেকুটে রান্নার উপযোগী করে নিয়ে আসা টুকরা টুকরা বাঁশ কোরল, কেজি ৩০ টাকা।

অল্প এই পণ্যগুলো বিক্রি হলেই তাঁর ছুটি। জুমের এই ফসল বিক্রির টাকায় নিজেই আবার ক্রেতা হয়ে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে বাড়ি ফিরবেন।

স্থানীয় লোকজন থেকে শুরু করে সেখানে বসবাসরত বাঙালিরা এই বাজারের ক্রেতা। বাঙালিদের কেউ চাকরির করতে, কেউ পড়াশোনার জন্য, কেউবা ঘুরতে যাওয়া পর্যটক। কেই–বা না নিতে চান পাহাড়ের গায়ে জুমে চাষ করা বিষমুক্ত টাটকা শাকসবজির স্বাদ!

তেমনই এক ক্রেতা জামাল উদ্দিন। সৌদিপ্রবাসী। নিজেদের বাড়ি রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে। ছেলে খাগড়াছড়ির ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে।

তার জন্যই মূলত এখানে আছেন ভাড়া বাসা নিয়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সদাই করতে বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে এখানে হাজির হন। আজকেও যেমন কিনলেন কাঁচামরিচ, পেঁপে, লাউ আর বরবটি।

আরও পড়ুন

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, বাজারে তখনো কোনো আলো চোখে পড়ে না। রাস্তার দুই পাশে স্থায়ী যেসব মনিহারি দোকান আছে, সেসবের উপচে পড়া বৈদ্যুতিক আলোতেই বাজার চলে জম্পেশ! হঠাৎই বিদ্যুৎ চলে গেল। যেসব দোকানে বিদ্যুৎ ছাড়াও জ্বলে এমন লাইট আছে, সেসব দোকানের আলো পেতে কিছু সবজি দোকান জায়গা পরিবর্তন করে।

খাগড়াছড়ির পাহাড়ের জুমচাষের ফসল নিয়েই বসে রোজকার এই বাজার।
ছবি: এম এ হান্নান

এই আলো-আঁধারের মাঝেই আমাকে মারফার বর্ণনা দিচ্ছিলেন আরেক বিক্রেতা। প্রথম দেখায় পাহাড়ি ফলটাকে মনে করেছিলাম চিন্দ্রা বাঙ্গি। আমার ভুল ভেঙে দিয়ে জানালেন এটা আসলে শসা জাতীয় সবজি। কাঁচা সালাদ হিসেবে খাওয়া যায় আবার পরিপক্ব হলে রান্না করেও খাওয়া যায়।

হাস্যোজ্জ্বল বিক্রেতার বর্ণনা শুনতে শুনতে দুজন ক্রেতা জুটে গেল। তাঁরাও কখনো খাননি, শসার মতো শুনে তাঁরাও এক কেজি কিনে নিলেন। আরেকজন নিলেন ভুট্টা। বিক্রেতা আপা প্রতিটা মোচার খোসা খুলে আগে দেখে নিলেন ভেতরে যথেষ্ট ভুট্টার দানা আছে কিনা। সন্তোষজনক থাকলেই কেবল যন্ত্রে রাখছেন ওজন করার জন্য।

আরও পড়ুন

পণ্য বেচার ফাঁকে এত যে কথা বলছি, বিন্দুমাত্র বিরক্তি নেই। জানালেন তাঁদের কষ্ট করে জুমে ফসল ফলানোর কথা। বর্ষার আগে পাহাড়ের গায়ে ঘাসে ছাওয়া জঙ্গল পুড়িয়ে তৈরি করা হয় জমি। পরে কুপিয়ে বীজ বপণ ও পানি সেচের পালা।

বর্ষায় বৃষ্টি হলে তবে মেলে স্বস্তি। না হয় এক দিন পরপরই পানি দিতে হয়। তবুও ভালো যে অনেকের মোটরচালিত পাম্প আছে। তাতে শ্রম ও সময়ের সাশ্রয় হয় অনেক।

বাজারে এলাম, কিছু একটা না কিনলে কী হয়? আমিও একখান মারফা কিনলাম। দাম মাত্র ১০ টাকা। মজার ব্যাপার হলো যাঁর সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কথাবার্তা বললাম, তাঁর নামও মারফা! মারফা ত্রিপুরা।

বাঁশ কোরল, তেঁতুল, কলা আর পুঁইশাকের বীজ সবই আছে এ বাজারে
ছবি: এম এ হান্নান

বাজারে ক্রেতা–বিক্রেতার তো কেনাবেচার সম্পর্ক। তার সঙ্গে এত গল্প করে কে? তাই তো পাশের দোকান থেকে মারফা ত্রিপুরার কাছে প্রশ্ন, কে উনি?

মারফার ঝটপট উত্তর, আমার বন্ধু মানুষ! ঢাকা থেকে আসছে।

বন্ধু বলেই যখন স্বীকার করেছে, তাহলে যোগাযোগ তো রাখতে হবে। ফোন নম্বর চাইতেই সহজ স্বীকারোক্তি, মুঠোফোন কেনার মতো অত টাকা নাই। এভাবেই বেশ আছি। এভাবেই আমাদের জীবন চলে।

মারফার হাত থেকে মারফা কিনে আমিও ঢাকার উদ্দেশে পা বাড়াই। খাগড়াছড়ি বেড়াতে গেলে ছোট্ট এই পাহাড়ি জুমচাষিদের বাজারটায় ঘুরে আসতে ভুলবেন না যেন।

আরও পড়ুন