কির্সতং পাহাড়ের চূড়া থেকে

দুর্লভ ও প্রাচীন গাছের এই কির্সতং বনে মানুষের আনাগোনা খুব একটা নেই।
ছবি: লেখক

পাহাড়ের রূপের কথা প্রায় সবারই জানা। এ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বারবার মানুষ পাহাড়ের কাছে ছুটে যায়। কিন্তু পাহাড়ের কাছে যেতে চাইলে কী আর যাওয়া যায়! এর জন্য প্রস্তুতি লাগে, দরকার হয় পরিকল্পনার। বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার চিম্বুক পর্বত রেঞ্জের চূড়া কির্সতং থেকে নাকি দেশের শীর্ষ পর্বতগুলোর চূড়া দেখা যায়। এর পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আর সব পাহাড়ের দৃশ্য দেখার লোভ আর সামলানো গেল না। তাই রীতিমতো হুটহাট পরিকল্পনা করেই যেতে হলো কির্সতং পাহাড়ের দিকে। সঙ্গী হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মুহসীন হলের বন্ধু শোয়েব।

বান্দরবানের চিম্বুক পর্বত রেঞ্জের চূড়া কির্সতং ও রুংরাংতং। কির্সতংয়ের উচ্চতা প্রায় ২ হাজার ৯৮৯ ফুট। ওয়ার্ল্ডঅ্যাটলাসের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শীর্ষ পর্বতের তালিকায় কির্সতং দশম। কির্সতংয়ের চেয়ে মাত্র ৩০০ ফুট ছোট পর্বত রুংরাং। পাশাপাশি অবস্থিত পর্বত দুটি ট্রেকিংয়ের জন্য আদর্শ।

যাচ্ছি আমরা পাহাড়ে

কির্সতংয়ে যাওয়ার ট্রেকিংয়ের প্রস্তুতি ও দিকনির্দেশনায় ছিল শোয়েব। একদিন রাত ১২টার দিকে দুজনেই ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে কির্সতংয়ের উদ্দেশে বাসে চেপে বসি। প্রথম গন্তব্য কক্সবাজারের চকোরিয়া। চকোরিয়ায় নেমে ওষুধ, শুকনা খাবার, ব্যাগ ও দড়ি কিনে আবার রওনা দিই বান্দরবানের আলীকদমের উদ্দেশে। এখানেই কির্সতং-রুংরাং। আমাদের দুপুরে আলীকদম আর সন্ধ্যায় দুসরি বাজারে থাকার কথা। কিন্তু আলীকদম যেতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। পরিকল্পনা ছাড়াই ঢাকা থেকে আসা যায়। কিন্তু এখানে পরিকল্পনা মতো এগোতে না পারলে বিপদে পড়তে হবে। তাই সন্ধ্যায় মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকি। পথে হঠাৎ মোটরসাইকেল বিকল হওয়ায় বাধ্য হয়ে পাহাড়ি পথে হাঁটা শুরু করতে হলো। সারা রাত দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে দুজন পৌঁছালাম দুসরি বাজারে। এখানে ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম নেওয়ার পর মূল ট্রেকিং শুরু হয়।

কির্সতংয়ের চূড়া থেকে দেশের শীর্ষ পর্বতগুলোর চূড়া দেখা যায়
ছবি: লেখক

হাঁটতে হবে বহুদূর
দুসরি বাজার থেকে বের হয়েই ঝিরিপথে হাঁটা শুরু করতে হলো। পথেই পড়বে মেনকিউপাড়া। সকালের খাবার সারতে হলো এই পাড়াতেই, জুম চালের ভাত আর সেদ্ধ ডিম। সকালে মেনকিউপাড়ায় স্কুল শুরু হয়েছে, স্কুলে জাতীয় সংগীত বাজছে। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি উপত্যকায় ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ শুনে মনটা আনন্দে ভরে উঠল।

সকালের খাবার শেষে শামুকঝরনা বরাবর এগোতে থাকলাম। আগামী দুই দিন গোসল করার সুযোগ হয়তো পাওয়া যাবে না, তাই এ ঝরনায় গোসল সেরে নিয়ে আবার ট্রেকিং শুরু করি। যতই পাহাড়ের ওপর উঠছি, শরীর যেন ততই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে।

পাহাড়ে উঠতে উঠতে বেলা তিনটার দিকে জুমঘরের দেখা মিলল। এ জায়গা থেকে নয়নাভিরাম সবুজ পাহাড়-প্রকৃতি দেখা যায়। এখানে পাঁচ মিনিটের জন্য বিশ্রাম নিয়ে চোখ খুলে দেখি এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। ক্লান্ত শরীরে আমাদের ঘুম এসে গিয়েছিল।

দুসরি বাজার থেকে বের হয়েই ঝিরিপথে হাঁটা শুরু করতে হয়
ছবি: লেখক

ধনেশ পাখির পাহাড়ে
ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে যাই রুংরাং পাহাড়ে। রুংরাং পাহাড় ধনেশ পাখির পাহাড় নামে পরিচিত। কিন্তু বাঁশবনের এ পাহাড়ে পাখির দেখা পাওয়া ভার। পাহাড়ের চূড়ায় ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। এবার আরও খানিকটা পথ নামতে হবে। পরের দিন যেতে হবে কির্সতং বন ও কির্সতং চূড়ায়। তাই রাত কাটাতে হবে পাহাড়ের পাদদেশে খেমচংপাড়ায়। পাহাড়ে অন্ধকার দ্রুত ঘনিয়ে আসে। আমরা মুঠোফোনের ফ্লাশ ও লাইট জ্বালিয়ে সামনের দিকে খুব সাবধানে হেঁটে চলছি। কারণ, রাতে পাহাড়ে হাঁটা বিপজ্জনক। একবার পা ফসকে গেলেই নিশ্চিত খাড়া খাদের নিচে পড়তে হবে। হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে, আমরা টাইম ট্রাভেলে ১০০ বছর পেছনে চলে এসেছি। চারদিকে কোনো আলো নেই, নেই কোনো সভ্যতার চিহ্ন। শুধু অন্ধকার পাহাড়, গাছপালা আর পতঙ্গের শব্দই এখানে সঙ্গী। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিচে দেখি আলো জ্বলছে। এটাই খেমচংপাড়া। এই পাড়ার একটি বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিই। ওই বাড়িতে নিজেদেরই ভাত ও পাহাড়ি আলুর তরকারি রান্না করে খেতে হয়েছে।
এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে কির্সতং। তাই এই বাড়ি থেকে সকাল সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রাচীন কির্সতং বন পেরিয়ে যেতে হচ্ছে সামনের দিকে। দুর্লভ ও প্রাচীন গাছের এই বনে মানুষের আনাগোনা খুব একটা নেই। নেই তেমন হাঁটার রাস্তাও। পথ নেই বলে কয়েকবার দিক ভুল করতে হয়েছে আমাদের। অনেক ঘুরপথে অবশেষে দুপুরের দিকে আমরা পৌঁছে যাই অপরূপ কির্সতং পাহাড়ের চূড়ায়।

কির্সতংয়ের চূড়ায়

কির্সতং নামটি এসেছে ‘কিরসা ও ‘তং’ শব্দ থেকে। ‘কিরসা’ হচ্ছে একধরনের ছোট পাখি। মারমা ভাষায় ‘তং’ অর্থ পাহাড়। কির্সতং—যে পাহাড়ে ছোট ছোট পাখি উড়ে বেড়ায়। পাহাড়জয়ের পর চিরকুটে নিজেদের ইচ্ছা/ অনুভূতি লিখে আবার আমরা নিচে নামতে শুরু করলাম। এবার আমাদের ট্রেকিং শেষ করার পালা। শরীর ক্লান্ত থাকায় সেদিন রাতেও খেমচংপাড়ায় আশ্রয় নিতে হলো।

ঘুম থেকে উঠে সকালেই আমাদের ফেরার যাত্রা শুরু হলো। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা হাঁটার পর সামনে যখন ২১ কিলোমিটার সড়ক (থানচি-আলীকদম রোড) দেখলাম, তখন মনে হলো সভ্যতার দিকে ফিরে আসছি।

দিনের আলোয় কির্সতংয়ের চূড়া থেকে এমনই দেখা যায় প্রকৃতি
ছবি: লেখক

২১ কিলোমিটার পয়েন্ট থেকে মোটরসাইকেল ভাড়া করে আলীকদমে এলাম। এখানে খাবার সেরে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। গত তিন দিনে প্রায় ৩২ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে চারপাশে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়, জুমঘর, কির্সতং-রুংরাং পাহাড়, কির্সতং বন, আদিবাসীপাড়া, ঝিরিপথ, নাম না-জানা গাছপালা, পাহাড়ি ফুল-ঝোপঝাড়, চাঁদের আলোয় পাহাড়ি প্রকৃতির রোমাঞ্চকর সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।

যেতে হবে যেভাবে

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে প্রথমে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলায় যেতে হবে। আলীকদম থেকে মোটরসাইকেল বা গাড়ি ভাড়া নিয়ে ২১ কিলোমিটার পয়েন্টে গিয়ে নামতে হবে। সেখান থেকে খেমচংপাড়া। এখান থেকে কির্সতং চূড়া। এরপর খেমচংপাড়া হয়ে রুংরাং আর মেনিয়াংপাড়া হয়ে দুসরি বাজার। দুসরি বাজার থেকে নদীপথে আলীকদম। এটাই হচ্ছে ট্রেকিংয়ের সবচেয়ে সহজ পথ।