এই তরুণ দৌড়ে পাড়ি দিয়েছেন আফ্রিকা মহাদেশ

রাসেল কুক দৌড়ে পাড়ি দিয়েছেন ১৬ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি পথ
ছবি: সংগৃহীত

কঙ্গোর গহিন অরণ্য। দুর্ভেদ্য পত্রপল্লব চিরে এগিয়ে চলেছে একটি মোটরসাইকেল। আরোহীর আসনে টগবগে এক তরুণ। তাঁকে অপহরণ করেছে একদল দস্যু। মোটরসাইকেলে বসা ওই তরুণের একটাই ভাবনা—এ-যাত্রা বাঁচব তো? যে স্বপ্ন নিয়ে পথে নেমেছিলাম, তা পূরণ হবে তো?

ওই তরুণে নাম রাসেল কুক। ২৭ বছরের একজন ব্রিটিশ। মুক্তিপণের বিনিময়ে কঙ্গোর ওই দস্যুদের কবল থেকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, আফ্রিকার শ্বাপদসংকুল জঙ্গল, দিগন্তজোড়া মরুভূমি আর পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে এক অসাধ্য সাধন করেছেন। যিনি দৌড়ে পাড়ি দিয়েছেন পুরো আফ্রিকা মহাদেশ।

কুকের আফ্রিকা পাড়ির এই স্বপ্নযাত্রার শুরু গত বছরের ২২ এপ্রিল। আফ্রিকার সর্বদক্ষিণের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যাত্রা শুরু করেন তিনি। আর এই বছরের ৭ এপ্রিল পৌঁছান একেবারে উত্তরের দেশ তিউনিসিয়া। এতে তাঁর সময় লেগেছে ৩৫২ দিন। মোটমাট ১৬টি দেশে পা রেখেছেন কুক। দৌড়ে পাড়ি দিয়েছেন ১৬ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি পথ।

দৌড়ে ১৬ হাজার কিলোমিটার! শুনলে যে কেউই আঁতকে উঠবে। তবে কুকের কথা আলাদা। তিনি একজন দৌড়বিদ। আগেও এমন কাণ্ড করেছেন। একবার তো তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে দৌড়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন। আরেকবার ম্যারাথনে দৌড়ের পুরোটা পথ একটি গাড়ি টেনেছিলেন। এসব করে একটা খেতাবও তাঁর জুটেছে—‘কঠিনতম মানুষ’।

শেষ পর্যন্ত আফ্রিকা জয় করে সেই খেতাবের মান রেখেছেন কুক। কুক বলছিলেন, ‘শেষের কয়েকটা মাস আসলেই খুব ধকল গেছে। সাহারা মরুভূমি, বালুঝড়—সবকিছুকে যেন কঠিন করে তুলেছিল। তবে আমি তো হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নই। মন কষে নিয়েছিলাম—যেভাবেই হোক সফল আমাকে হতেই হবে।’

আরও পড়ুন
দিগন্তজোড়া মরুভূমির মধ্য দিয়েও দৌড়েছেন রাসেল
ছবি: সংগৃহীত

অন্ধকার থেকে আলোয়

কুকের জীবনটা আর দশজন মানুষের মতো সহজ ছিল না। কিশোর বয়সেই পেটের দায়ে কাজে নামতে হয়েছিল। একপর্যায়ে ডুবে গিয়েছিলেন হতাশায়, সেখান থেকে বিপথে। সপ্তাহান্তের অবকাশে বন্ধুদের সঙ্গে মেতে উঠতেন নেশা আর জুয়ায়। এভাবেই চলছিল। যুক্তরাজ্যের ব্রাইটন শহরের নৈশক্লাবের একটি ঘটনা বদলে দেয় তাঁর জীবন।

সেদিন রাত আনুমানিক তিনটা। নৈশক্লাবে বসে কুকের মনে হলো, এভাবে জীবন কাটানোর কোনো মানে হয় না। নতুনভাবে সবকিছু সাজাতে হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। সে রাতেই ১২ মাইল দৌড়ে বাড়ি ফেরেন। এরপর এক বন্ধুর পরামর্শে পরপর কয়েকটি ম্যারাথনে অংশ নেন। কুকের জবানিতে, ‘বহুদিন পরে সেই প্রথম নিজের ওপর ভরসা ফিরে পেলাম।’

কুকের জীবনে শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়। ভ্রমণের জন্য টাকাকড়ি জমাতে শুরু করলেন। গেলেন আফ্রিকায়। সেখানে ইতালির এক সাইক্লিস্টের সঙ্গে দেখা। তিনি সাইকেলে করে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া প্রেরণাই কুককে দৌড়ে আফ্রিকা পেরোনোর সাহস জুগিয়েছে।

আরও পড়ুন
কুকের আফ্রিকা পাড়ির এই স্বপ্নযাত্রার শুরু গত বছরের ২২ এপ্রিল
ছবি: সংগৃহীত

একে একে সব বাধা জয়

শুরুতেই বাধা। কুকের ইচ্ছে ছিল তিউনিসিয়া থেকে দৌড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা যাবেন। কিন্তু আলজেরিয়ার ভিসা পাওয়া গেল না। অগত্যা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে উল্টো পথে যাত্রা শুরু করতে হলো। পরিকল্পনা ছিল টানা দৌড়ে বড়দিন নাগাদ তিউনিসিয়া পৌঁছাবেন। সে হিসাবে সময় লাগবে ২৪০ দিন। তবে নানা অঘটনে সে হিসাবও বজায় রাখা সম্ভব হয়নি।

২২ এপ্রিল যাত্রা শুরুর পর মাত্র ৫০ দিনে দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়া পেরিয়ে যান কুক। কিন্তু অ্যাঙ্গোলায় ডাকাতের কবলে পড়লেন। ২৪ জুন বন্দুক ঠেকিয়ে কুক ও তাঁর দলের সঙ্গে থাকা টাকাপয়সা, পাসপোর্ট, ক্যামেরা—দরকারি সবকিছু ছিনিয়ে নিল তারা। তারপরও থেমে যাননি তাঁরা। কয়েক দিনের বিরতি নিয়ে সবকিছু জোগাড়যন্ত্র করে আবার দৌড় শুরু করেন।

এরপর ঘটল সেই দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনা। কঙ্গোয় অপহরণের শিকার হলেন কুক। তাঁর আফ্রিকা-যাত্রায় ওই ঘটনাটাই নাকি সবচেয়ে ভয় ধরানো ছিল। কুকের ভাষায়, ‘অপহরণকারীরা  মোটরসাইকেলে করে আমাকে যখন জঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছিল, ভাবছিলাম, হয়তো মারা যাব। এক মিনিটের জন্য হলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম—দৌড়ের এখানেই ইতি টানব। পরেই ভাবলাম—নাহ, এভাবে স্বপ্নটাকে মাঠে মারা যেতে দেব না।’

এ তো গেল বাধাবিপত্তির একটা ধরন। ১৬ হাজার কিলোমিটার দৌড়ে পেরোনোও কোনো চাট্টিখানি কথা না। শরীরের ওপর দিয়ে কম ধকল যায় না। তারপর আবার ওপরে খরসূর্য আর নিচে তপ্ত মরুভূমি। প্রথম ৪৫ দিন দৌড়ানোর পর কুকের প্রস্রাব দিয়ে রক্ত আসা শুরু করল। সঙ্গে অসহ্য পিঠ ব্যথা। বাধ্য হয়ে একদিন বিশ্রাম নিতে হলো। ২০০তম দিনে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। নাইজেরিয়ার এক চিকিৎসকের পরামর্শে কম দূরত্ব দৌড়ালেন। এমনকি শরীর না চলায় ২০৫ ও ২০৬তম দিনে পুরোপুরি বিরতি দিতে হয়েছিল।

অবশেষে সেই ক্ষণ

আফ্রিকা জয়ের পথে কুকের শেষ বাধাটা এল মৌরিতানিয়ায়। যাত্রার সেটা ২৭৮তম দিন। পরের দেশটাই আলজেরিয়া। এবারও দেশটি তাঁকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানাল। কিন্তু এই ভিসা না পেলে তো এখানেই তাঁর যাত্রার ইতি টানতে হবে। শেষমেশ মনের দুঃখের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তুলে ধরলেন তিনি।

তাতেই কাজ হলো। ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের নজরে এল সেই পোস্ট। তাঁদের মধ্যে এক্সের মালিক ইলন মাস্ক, যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য টিম লাউটন ও আলেকজান্ডার স্টাফোর্ডও ছিলেন। এবার ভিসা দিতে রাজি হলো আলজেরিয়া।

আবার দৌড় শুরু করলেন কুক। সামনে সুবিশাল সাহারা মরুভূমি। পেরোলেই স্বপ্নপূরণ। মাস পেরিয়ে সপ্তাহ এল, সপ্তাহ পেরিয়ে দিন। অবশেষে এল সেই অন্তিম ক্ষণ। ৭ এপ্রিল বিকেলে সূর্য যখন পাটে নামছে, তিউনিসিয়ার একেবারে উত্তরে রাস অ্যাঞ্জেলায় পৌঁছালেন কুক। সেখানে তখন শত মানুষের ভিড়। সবার মুখে একটাই নাম—কুক। তাঁর আফ্রিকা পাড়ির স্বপ্নজয়ের সাক্ষী হলেন উপস্থিত সবাই।

কুকের জীবনটা আর দশজন মানুষের মতো সহজ ছিল না
ছবি: সংগৃহীত

আরেক সফলতা

দৌড়ে আফ্রিকা পাড়ি দেওয়ার পেছনে কুকের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল—অসহায় মানুষের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেওয়া। আফ্রিকা-যাত্রার পুরোটা সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর অনুসারী বেড়েছে হু হু করে। সেখান থেকে তিনি জোগাড় করেছেন ৯ লাখ ৬৫ হাজার ডলারের বেশি তহবিল। দুর্দশাপীড়িত তরুণদের সহায়তায় এই অর্থ খরচ করবেন তিনি। কিছুটা ব্যয় করা হবে আলজেরিয়ার শরণার্থীশিবিরে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রকল্পের কাজে।

আফ্রিকা জয়ের অভিজ্ঞতা আগামী দিনের জন্যও সঞ্চয় করে রাখতে চান কুক। এখন তো তিনি তরুণ। একদিন তাঁর জীবনের সাঁঝের বেলা আসবে। কুক বললেন, ‘যখন বয়স হবে, আমি রকিং চেয়ারে বসে থাকব। পাশে নাতি-নাতনিরা দৌড়াদৌড়ি করবে। তখন এই দিনগুলোর গল্প আমার সঙ্গে থাকবে। মন্দ হবে না কিন্তু।’

তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিএনএন ও দ্য গার্ডিয়ান