নেপালে প্যারাগ্লাইডিং করতে যে কারণে আমার দুই হাজার রুপি বেশি লাগল
‘মানুষ আমি, আমার কেন পাখির মতো মন’—জনপ্রিয় এই গানের কলি বহুবার শুনেছি, পাখির মতো ওড়ার ইচ্ছাও মনের গহিনে জমিয়ে রেখেছি। নেপাল সফর পরিকল্পনার সময় সেই পাখির মতো মনটা এবার আলাদা একটা টান অনুভব করল। যাচ্ছি যখন, প্যারাগ্লাইডিংটা এবার করতেই হবে! কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল পুরোনো শারীরিক সমস্যা—কানে বড় অস্ত্রোপচার ও হাঁটুর ইনজুরি। আমার ইচ্ছার কথা জেনে চিকিৎসক থেকে বন্ধু, সবাই নিরুৎসাহিত করল।
সবার নিষেধাজ্ঞা মাথায় নিয়েই নেপালে পা রেখেছিলাম। পোখারার সারাংকোটে পৌঁছেই ইচ্ছাটা আবার মাথাচাড়া দিল। আবার পাহাড়ের চূড়া থেকে পাখির মতো ভেসে চলার আকাঙ্ক্ষা হলো। আমার বরও সাহস জোগাল। স্থানীয় এজেন্টরাও আশ্বস্ত করলেন যে শারীরিক সমস্যাগুলো তেমন প্রভাব ফেলবে না। সব মিলিয়ে মনের পাখিটা নতুন করে আবার ডানা মেলল।
কথামতো সকাল আটটায় হোটেলের সামনে এল জিপ। আমি ছাড়া যাত্রী আরও দুজন—পাইলট আর প্যারাগ্লাইডিং কো-অর্ডিনেটর। উত্তেজনার সঙ্গে বুকের ভেতর মৃদু কম্পন—ভয়, স্নায়ুচাপ। কো-অর্ডিনেটর জানালেন যে আগের দিন বৃষ্টি হওয়ার ফলে আজকের আবহাওয়া প্যারাগ্লাইডিংয়ের জন্য একেবারে আদর্শ।
জিপ থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে সারাংকোটের পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছালাম। সেখান থেকে চোখে পড়ল—একটি একটি করে রঙিন প্যারাগ্লাইডার আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট দলে আমাদের ভাগ করে পাইলটরা বুঝিয়ে দিলেন নিরাপত্তা কৌশল, দৌড়ের নিয়ম, উড়াল দেওয়ার মুহূর্ত।
সবকিছু বুঝে নিয়ে এবার অপেক্ষার পালা। অন্যদের মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করছি—কে কীভাবে পা ফেলছে, দৌড়ের সময় শরীরের ভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত, যেন হাঁটুতে চাপ না পড়ে।
শেষমেশ আমার ডাক এল। হারনেস বেঁধে দিলেন পাইলট। তাঁর হাতে হাত, পায়ে পা মিলিয়ে দৌড়ালাম…আর পরমুহূর্তেই আমি আকাশে!
নিচে সারি সারি সবুজ পাহাড়, ফেওয়া লেকের স্বচ্ছ জল, দূরে ছোট ছোট গ্রাম—সব মিলিয়ে যেন রঙিন ক্যানভাস। মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখছি, এমন সময় আমার নাকের ডগা ঘেঁষে উড়ে গেল একটা চিল। আমি তখন সত্যিই পাখি!
পাইলট হঠাৎ প্রস্তাব দিলেন, অ্যাক্রোবেটিক করতে চাই কি না। উত্তেজনায় কোনো কিছু না ভেবেই ‘হ্যাঁ’ বলে দিলাম।
শুরু হলো রোমাঞ্চকর পাক। চারবার। কখনো মনে হলো উল্টো হয়ে আছি, কখনো শরীরটাকে মনে হলো হাওয়ায় ঘূর্ণায়মান একটা পাতা। কতটা উচ্চতায় ছিলাম, কেমন ছিল গতি, কিছুই মনে নেই। শুধু জানি, দ্বিগুণ গতিতে চলছিল হৃৎস্পন্দন। এভাবে হাওয়ায় ভেসেছি প্রায় ৪৫ মিনিট। যখন মাটিতে নেমে এলাম, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল বর।
সচরাচর সাড়ে আট হাজার রুপিতেই প্যারাগ্লাইডিং করা যায়। এজেন্সি ভেদে কম-বেশিও হয়। তবে অ্যাক্রোবেটিক আর বাড়তি সময়ের কারণে আমার লাগল ১০ হাজার রুপি।
যা-ই লাগুক, এই অভিজ্ঞতা যে আত্মজয়। ভয়কে পাশ কাটিয়ে নিজেকে উড়ে যেতে দেওয়া, এ যেন নিজের সীমাকে ছুঁয়ে দেখার সাহস।
পোখারার সেই সকাল, সেই উড়াল আমার জীবনে অনন্য এক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।