পাইনের বনে, পাহাড়ের পথে

৬৩ বছর বয়সে এসে হিমালয়ের প্রেমে পড়েন ইফতেখারুল ইসলাম। এভারেস্ট বেসক্যাম্প ভ্রমণ নিয়ে ২০২১ সালে লিখেছেন বই—‘যেখানে এভারেস্ট’। হিমালয়ের ডাকে এ বছরও গিয়েছেন গোকিও। গোকিও রির শীর্ষ থেকে দেখেছেন এভারেস্টসহ বিখ্যাত সব পর্বতশিখর। সে অভিযাত্রা নিয়ে ধারাবাহিক লিখছেন তিনি। তৃতীয় পর্ব পড়ুন আজ।

লুকলা থেকে ট্রেকিং শুরু
ছবি লেখকের সৌজন্যে

দুপুর হয়েছে। লুকলার এয়ারস্ট্রিপ শূন্য পড়ে আছে। চারদিকের উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে একটু নিচু একটা পাহাড়ের মাথায় পর্বত অভিযাত্রীদের সবার চেনা এই ছোট্ট এয়ারপোর্ট। স্যার এডমন্ড হিলারির নিজ হাতে তৈরি। এখানে পা রাখলেই শরীরে আর মনে কী রকম একটা রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়ে। গত শতাব্দীর ভ্রমণকাহিনিতে পড়া কঠিন পদযাত্রা আর জনবিরল লোকালয়ের ছবি মনে পড়ে।

পোর্টার তিলক এসে আমার বড় ব্যাগটা কাঁধে তুলে নেয়। তিলকের কাছেই জানলাম ওর বন্ধু, আমার আগেরবারের পোর্টার একরাজ আসতে পারেনি, তার বাবার মৃত্যুর বর্ষপূর্তির কাজ আছে বলে। হেলিপোর্ট থেকে বেরিয়ে পাথুরে পথ বেয়ে অনেকটা উঁচুতে উঠতে হয়। ‘দ্য নেস্ট এট লুকলা’ নামের রেস্তোরাঁটি বেশ জনাকীর্ণ। আজ যাঁদের কাঠমান্ডু ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, তাঁরা অপেক্ষা করছেন। এই মেঘলা দিনে আর কোনো প্লেন আসবে কি না অনিশ্চিত। এখানে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করি। লুকলার জনপদের শেষ লজটা ইয়েতি মাউন্টেন হোম, গতবার সেখানে বেশ কদিন আটকে ছিলাম বিধিনিষেধে। সেই লজ পেরিয়ে ট্রেকিংয়ের পথে নামতেই আমাদের লুকলার রুরাল মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। চেনা পথ। চারদিকে পরিচিত অরণ্য ও পাহাড়।

আরও পড়ুন
বৌদ্ধস্তুপা ও প্রার্থনাচক্রের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ট্রেকিংয়ের পথ
ছবি লেখকের সৌজন্যে

এসব পাহাড় প্লেন বা হেলিকপ্টার থেকেও দেখা যায়। তখন কাছ থেকে দেখলেও দূরের লাগে। কিন্তু ট্রেক শুরু করলে এই অরণ্য ও পাহাড়কে মনে হয় আপন। হাঁটার সময় হিমালয়ের আবহটা অনুভব করা যায়। পাইনবন, পাহাড় আর চারপাশের শান্ত শীতলতা মনকে ছুঁয়ে যায়। কাছেই কোথাও ইয়াক অথবা মহিষের গলায় বাঁধা ঘণ্টার টুংটাং। দূর থেকে শোনা যায় দুধকোশি নদীর উচ্ছল শব্দ। মাঝেমধ্যে পাহাড় ও পাইনবনের নিচে নদীর সাদা জলধারা চোখে পড়ে। ট্রেক করে চলার সময় বারবার চারদিকে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। আকাশের গায়ে অনেক উঁচুতে তুষারঢাকা শিখরগুলোকে বিরাট বিস্ময় বলে মনে হয়।

লুকলা হলো এভারেস্ট, সাগরমাথা জাতীয় উদ্যান আর খুমবু অঞ্চলের অন্য সব পর্বতের প্রবেশদ্বার। যে যেখানে যাক, এখানকার স্বাগত তোরণ দিয়েই তাকে ঢুকতে হবে। আর সাগরমাথা জাতীয় উদ্যানের প্রবেশপথে যাব পরের দিন। হাঁটার সময় চারদিকে তাকিয়ে মনে হয় সত্যিই আমি পাহাড়ের অতিথি। কোথাও কোনো বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে, আবার কখনো ছোট ছোট বৌদ্ধস্তুপা ও বড় আকারের লাল-সোনালি প্রার্থনাচক্রের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ট্রেকিংয়ের পথ। সেই পথ ধরে আমি লক্ষ্যের দিকে হেঁটে যাই।

আরও পড়ুন
উচ্ছল পাহাড়ি নদী আর মেঘে ঢাকা দূরের পাহাড়
ছবি লেখকের সৌজন্যে

হিমালয়ের কোলে প্রথম সন্ধ্যা

লুকলা থেকে হেঁটে রওনা হয়ে ফাকদিংয়ে রাতযাপন। এই আট কিলোমিটার মাত্র তিন ঘণ্টার পথ হলেও উঁচু–নিচু পথ বেয়ে আসতে হয় বলে প্রথম দিনেই হিমালয়ে ট্রেকিং-অভিজ্ঞতার সূচনাটুকু হয়ে যায়। লুকলার চেয়ে ফাকদিং কিছুটা নিচে। আগেরবার এখানে ইয়েতি মাউন্টেন হোমে ছিলাম, সেটা ফাকদিংয়ের লোকালয় শুরু হওয়ার আগে। বলা চলে একেবারে প্রথম লজ। সেখানে এবার থাকা যাবে না। এর প্রধান ভবনটি ভেঙে ফেলে নতুনভাবে তৈরির কাজ চলছে। এবার আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে শেরপা শাংগ্রিলা রিসোর্ট নামের নতুন একটা লজে। সেটা এই জনপদ ছাড়িয়ে একেবারে অন্য মাথায়, টকটক নামের একটা লোকালয়ে। জার্মান সহায়তায় বেশ কয়েক বছর ধরে নির্মাণাধীন, অসমাপ্ত একটা বড় হাসপাতালের ঠিক পাশে। অদূরে রয়েছে একটা হেলিপোর্ট।

দুই বছর আগে এই হাসপাতাল ভবনগুলো যেমন দেখে গিয়েছি, এখনো তেমনি আছে। জনশূন্য। পাশেই তৈরি হয়েছে ঝকঝকে নতুন হোটেল। পেছনে পাইনবন, নদীর ছলছল শব্দ। তার সামনে শাংগ্রিলা নামের এই হোটেলটা ছবির মতন। রিসোর্টের সামনে ও আশপাশে কিছু গাছ খুবই প্রাচীন ও বিশাল। ফেরার সময় এখানে এভারেস্টের শিখর ছুঁয়ে আসা বড় একটা দলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেটা অনেক পরের গল্প। আপাতত হিমালয়ের কোলে এখানেই প্রথম সন্ধ্যা।

আরও পড়ুন
সাগরমাথা জাতীয় উদ্যানের প্রবেশপথে
ছবি লেখকের সৌজন্যে

ডালভাত পাওয়ার-টোয়েন্টিফোর আওয়ার

হিমালয়ের রুটিন—সন্ধ্যায় ডালভাত খেয়ে নয়টা না বাজতেই ঘুম। হিমালয়ের এই পার্বত্য এলাকায়, বিশেষত গোকিও, অমা ধবলাম, বিভিন্ন পাস ও ইবিসির পথে ডালভাত ও সবজি খাওয়াটাই আমাদের রীতি। এখানকার প্রায় সব লজে নুডলস, পাস্তা, পিত্জা থেকে শুরু করে নানা দেশের নানা ধরনের খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু ওই প্রত্যন্ত ও উঁচু এলাকায় মাছ–মাংস বয়ে আনতে হয় অনেক নিচের কোনো শহর থেকে। সেগুলো কীভাবে কত দিন কোথায় রাখা হয় আর কতটা স্বাস্থ্যসম্মত, তা অনিশ্চিত বলেই নিরামিষ নিরাপদ। হিমালয়ে এসে ভেজিটেরিয়ান হতে ভালোই লাগে। নেপালের পাহাড়ি এলাকায় শেরপাদের দেশের প্রবচন, ডালভাত পাওয়ার—টোয়েন্টিফোর আওয়ার। এখানে সব উপত্যকায় প্রচুর আলু চাষ হয়। ডালভাত ছাড়া আমি দু-একটা জায়গায় খেয়েছি মাশরুম স্যুপ, ফ্রেঞ্চফ্রাই ধরনের আলু ভাজা অথবা সবজির মোমো। হিমালয়ের অভিযাত্রী বা তীর্থযাত্রীরা বেশি দিনের জন্য এলে আগে নিজেদের রান্না নিজেরাই করতেন। এখনো অনেক অভিযাত্রী একা অথবা সদলে এলে প্রত্যন্ত এলাকায় নিজেদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে নেন। তাঁবুতে থাকেন। নিজেদের রান্নার আয়োজন নিজেরা করেন।

আরও পড়ুন

এই পথের অন্য অনেক যাত্রীর মতো আমাদেরও হিমালয়ের প্রথম রাতটা কাটে ফাকদিংয়ে। পরদিন, অর্থাৎ ৭ মে ভোরে উঠে সাড়ে ছয়টায় নাশতা সেরে সাতটায় আবার পথে নামি আমরা। এদিনের ট্রেক দীর্ঘ ট্রেক। ফাকদিং থেকে নামচেবাজার। দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার। ফাকদিং থেকে নামচে অনেকখানি, মানে প্রায় ৮০০ মিটার উঁচুতে। পার্বত্য পথে অনেকবার চড়াই বেয়ে উঁচুতে উঠতে হয়। কয়েকটা সাসপেনশন ব্রিজ বা ঝুলন্ত সেতু পার হতে হয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে হিলারি ব্রিজ। নিচ থেকে, নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে সেই ব্রিজকে অনেক উঁচু দেখায়। অত ওপরে উঠব কীভাবে? কীভাবে যাব দূরের পাহাড়টায়? প্রথমবার এখানে বেশ ভয় পেয়েছিলাম। এবার দ্বিধা ও ভয় দূর করে হেঁটে চলি। হেঁটে হেঁটে ওপরে উঠি। তারপর ঝুলন্ত সেতু পার হই।

আগেরবার একে যত উঁচু আর কঠিন মনে হয়েছিল, এবার আর তেমন লাগে না। কঠিন আসলে পরের অংশটি। ওই ব্রিজ পার হওয়ার পর প্রায় দেড় ঘণ্টার টানা চড়াই ধরে পর্বতারোহণ আমার জন্য বেশ কঠিন ও ক্লান্তিকর। নিশ্বাস দ্রুত হয়, হৃৎকম্পন বেড়ে যায়। এই দিনের ট্রেকে পার হতে হয় এ রকম বেশ কয়েকটা দীর্ঘ ও খাড়া চড়াই। মাঝেমধ্যে বিশ্রামের জন্য কয়েক মিনিট থেমে দেখেছি, তেমন কোনো লাভ হয় না। অথচ সামান্য বেশি সময় নিয়ে কোথাও বসলে, চা বা কফি খেলে, চারপাশের দৃশ্য দেখলে আমি সহজেই শ্রান্তি ভুলে যাই।

পায়ের কাছে দুধকোশি নদী, আর সামনের পাহাড়ের ওপর হিলারি ব্রিজ
ছবি লেখকের সৌজন্যে

বারবার দুধকোশি

তেজ বলে, এবার আমার ট্রেকের গতি অনেক স্বচ্ছন্দ, আগেরবারের চেয়েও ভালো। আমি নিজেও প্রথম দিকে বেশ আস্থার সঙ্গে শুরু করেছি। কিন্তু ক্রমেই ক্লান্তি বোধ করি। এ রকম দীর্ঘ ট্রেকের জন্য সারা দিনের লক্ষ্যকে আমি ছোট ছোট লক্ষ্যে ভাগ করে নিই। সাড়ে ছয় বা সাত ঘণ্টার ট্রেক মানে খাওয়া ও কফির বিরতি মিলিয়ে প্রায় আট ঘণ্টা। আমি সকালে দেড় ঘণ্টা ট্রেক করে কফির জন্য থামব। তারপর আবার দুঘণ্টা বা আড়াই ঘণ্টা ট্রেক করে দুপুরের খাওয়া। এরপর দুই-আড়াই ঘণ্টা হাঁটলে দিনের শেষ গন্তব্যে পৌঁছে যাব। এ রকম দুই-আড়াই ঘণ্টার ট্রেকের মধ্যেও আমি কয়েকবার পানি খাওয়ার জন্য বা ছবি তোলার জন্য একটু একটু করে থামি। এতে সব মিলিয়ে আমার সময় লাগে অন্যদের চেয়ে বেশি। কিন্তু এখানে তো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। আমার দরকার সুস্থ থেকে লক্ষ্যে পৌঁছানো।

এই পথে দ্বিতীয়বার যাচ্ছি বলে কিছু কিছু জিনিস চেনা মনে হয়। আগেরবার আমরা যেমন দেখেছি, তেমনি এবারও নানা জায়গা থেকে দেখা যায় দুধকোশি নদীর দুরন্ত জলধারা। শোনা যায় পাথরের ওপর আছড়ে পড়া পাহাড়ি নদীর স্রোতের শব্দ। না-দেখা কোনো ডুবো পাথরে ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে উঠছে তীব্র স্রোত। পাহাড়ের ফাঁকে কোনো কোনো উপত্যকায় জনপদ রয়েছে। রয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শাকসবজি ও আলুখেত। আর দুপাশে সৌন্দর্যের আগুন ছড়িয়ে উঁচু হয়ে ওঠা পাহাড়ের গায়ে পাইনের ঘন বন। বৃষ্টির সজীব ছোঁয়ায় সে বন এবার অনেক গহিন, অনেক বেশি সবুজ ও সতেজ। তবু আমার দুই বছর আগের প্রথম দেখার আনন্দ ও বিস্ময়ের কথা মনে পড়ে। এখানে দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুলেছিলাম। একটু পরেই একটা সাইনবোর্ড আছে না? ওখানে পরিচয় হয়েছিল মালয়েশিয়া থেকে আসা একটি পরিবারের সঙ্গে। একটু দাঁড়াই, তারপর আবার পরিশ্রান্ত পায়ে হেঁটে যাই। পথের ধারে কালো পাথরে তিব্বতি ভাষায় মন্ত্র লেখা। আর একটু হাঁটলেই নামচেবাজার।