কিলিমানজারো অভিযান–১
এ বয়সে এসে কিছুটা স্বাধীনতা বাবাদেরও প্রাপ্য, সন্তানদের সেটা মেনে নিতে হবে
আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে উঁচু পর্বত কিলিমানজারোতে গিয়েছিলেন ইফতেখারুল ইসলাম। পর্বত আরোহণ ছাড়াও তানজানিয়ায় জাতীয় উদ্যানে সাফারি করেছেন তিনি। এ সফরের গল্প নিয়েই আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন। আজ পড়ুন প্রথম কিস্তি।
লাভা টাওয়ার হয়ে কিছু সমতল কিছুটা উঁচু-নিচু পথ ধরে বারাঙ্কো ক্যাম্পে ৩ হাজার ৯০০ মিটার উচ্চতায় যখন পৌঁছালাম, তখন বিকেলের আলো ফুরিয়ে এসেছে। ছায়াচ্ছন্ন বারাঙ্কো ওয়ালের পেছনে সোনালি রং ধারণ করেছে কিলিমানজারো। দুদিন আগে সন্ধ্যার এ সময়টাতে ৩ হাজার ৬১০ মিটার উচ্চতায় শিরা-১ ক্যাম্প থেকে নানা রঙের কিলিমানজারো দেখেছি। কখনো গোলাপি, কখনো একেবারে লাল। তখনো বারাঙ্কো ওয়াল বলে কিছু চোখে পড়েনি। গত দুদিন পায়ে হেঁটে ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শিরা-২ ও লাভা টাওয়ার পার হয়ে কিছুটা উঁচুতে উঠে এসেছি।
বাঁ দিকে গেলেই আমাদের তাঁবু। ডান দিকে উঁচু পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তারেক অণু ও অন্য কয়েকজন। বোঝা যায়, ওখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক আছে। আমিও তাঁবুর দিকে না গিয়ে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের ওপরে উঠে ওদের সঙ্গে দাঁড়াই। অণু তখন ফেসবুক লাইভে জায়গাটার বর্ণনা দিচ্ছে। কত সহজে ও এই অদেখা অপরূপ জগতের বর্ণনা দেয়, শুনে অবাক লাগে। কথা বলতে বলতে আমাকে ডেকে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় ওর দর্শক-শ্রোতার সঙ্গে। জানতে চায়, অবসরজীবন কেমন কাটছে, কীভাবে এমন অভিযানের সঙ্গে জড়িত হলাম। বর্ষীয়ান অভিযাত্রী হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা জানতে চায় অণু।
সারা দিন হেঁটে চলার ক্লান্তি গোপন করা যায় না। তবু ওর মুঠোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলি। আসলে যাঁরা ঘরে বসে মুঠোফোনে ফেসবুক লাইভ দেখছেন তাঁরাই ভালো আছেন। আমি পরিশ্রান্ত কণ্ঠে তাঁদের জানাই, কীভাবে নতুন লক্ষ্য স্থির করে অজানা পথে হেঁটে চলেছি গত কয়েক বছর। দেখছি এ পৃথিবী কত বিচিত্র। কত সুন্দর।
যতই আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলি সামনে তাকালেই দেখি বিরাট একটা বাধা। গোধূলির ছায়াঢাকা সুউচ্চ বারাঙ্কো ওয়ালের দিকে চোখ রেখে মনে হলো এই দৃশ্য ঘরে বসে ইউটিউবে দেখাটাই আরামদায়ক ও নিরাপদ। অথচ বাস্তবে এখন আমি অভিযাত্রীর বেশে এর সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। কীভাবে ওই দেয়ালের মতো খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে উঠব,সে কথা ভেবে আতঙ্কিত হই।
আবার একটু উজ্জীবিত হতে চেষ্টা করি এই ভেবে যে অন্যরা যা পেরেছেন, তা আমিও নিশ্চয়ই পারব—সকালেই একটা নতুন অভিজ্ঞতা হতে চলেছে। কিলিমানজারোর পথে একটা উঁচু বাধা পার হয়ে যাব। দৃষ্টিকে ইতিবাচক রাখার সুবিধা আছে। তার জন্য দরকার প্রস্তুতি।
এই ট্রেকের জন্য কয়েক মাস ধরে নিজেদের আমরা তৈরি করেছি। নিজ নিজ প্রস্তুতি যেমন আছে তেমনি আছে দলের অন্য সবার কাছ থেকে পাওয়া পরামর্শ ও প্রেরণা। কীভাবে নানা বয়সের নানা পেশার মানুষ নিয়ে এত বড় একটা দল তৈরি হলো, সে কথা আগে বলা দরকার।
ছিলাম আঙ্কেল, হলাম ভাই
আমাদের এটা আট দিনের ট্রেক। লেমোশো রুটে এই কিলিমানজারো অভিযানের পরিকল্পনা করেছে অণু তারেক। তানজানিয়ার একটা এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে ও সমমনা কয়েকজনকে খুঁজছিল। ঢাকায় বসে এ খবর প্রথম জানতে পারি অণুর ফেসবুক পোস্ট থেকে। ওর সাহিত্য পাঠের পরিধি প্রায়ই আমাকে বিস্মিত করে। তবে ভ্রামণিক ও অভিযাত্রী হিসেবে অণুর খ্যাতি তার চেয়েও বড়। ওর বিজ্ঞপ্তি দেখেই ঠিক করেছিলাম একটা দলের সঙ্গে কিলিমানজারো যাওয়ার এই সুযোগ হাতছাড়া করব না। জানি, এর জন্য বেশ কিছুটা সময় দিতে হবে। পর্বত দর্শনের পাশাপাশি আফ্রিকার অন্য দু-একটি দর্শনীয় জায়গায় যেতে হবে।
আমাদের এই ভ্রমণে তানজানিয়ার বিখ্যাত সব জাতীয় উদ্যানে সাফারির সুযোগ আছে। এত দূর গিয়ে সেটা না করে চলে আসব? অণু ও তার দলের সঙ্গে চার দিনের সাফারিতে যোগ দেওয়ার বিষয়টাও নিশ্চিত করতে চাই। সব মিলিয়ে খরচ কম না। এ জন্য হয়তো আমার অন্য ভ্রমণ ও খরচ কমাতে হবে। কীভাবে ম্যানেজ করব? যে যা-ই বলুক, নিজের বয়স ও সীমাবদ্ধতার কথা ভুলে গেলে চলবে না। দীর্ঘদেহী অণু এমনিতেই ‘ছোট মানুষ’, তার ওপর আমার মেয়ে-জামাইয়ের বন্ধু। ওর সঙ্গে, মানে সোজা কথায় ওর নেতৃত্বে কিলিমানজারো অভিযানে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। ঠিক আছে তো?
ঘরে ও বাইরে স্বজনদের মধ্যে আমার পর্বত অভিযান বিষয়টি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে কয়েক বছর ধরে। সুখী অবসরজীবন ফেলে পর্বতে-গিরিপথে তীব্র ঠান্ডায় পায়ে হেঁটে পাথর ডিঙিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টার মধ্যে কী আনন্দ, অন্যদের তা বোঝানো যায় না। কেউ কেউ প্রকাশ্যেই আমাকে পাগল বলে। এর একটা সুবিধাও আছে। একবার পাগল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেলে পরের পাগলামিগুলো সহনীয় হয়ে যায়। নতুন নতুন সংকল্পের কথা শুনে কেউ খুব বেশি অবাক হয় না। প্রথমে মেয়ের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে চেষ্টা করলাম। সে আমাকে ছাড়পত্র দেওয়ার আগে নিজেই অণুর সঙ্গে কথা বলল। অণু ওকে বুঝিয়ে বলে—এ বয়সে এসে কিছুটা স্বাধীনতা বাবাদেরও প্রাপ্য। সন্তানদের সেটা মেনে নিতে হবে।
যথাসময়ে প্রথম ডিপোজিটের টাকা জমা দিতে চাই। আর কারা যাচ্ছেন? অণু আমাকে জানাল, এই ট্রিপে ১৫-২০ জন অভিযাত্রী যোগ দেবেন। আমাকে সঙ্গে নেওয়ার ব্যাপারে ওর দুটি শর্ত আছে। ১. ওকে তুমি করে বলতে হবে, আপনি বলা চলবে না। আর ২. ও আমাকে ইফতেখার ভাই বলে ডাকবে, আঙ্কেল না। শর্তগুলো তেমন কঠিন নয় বলে মেনে নিই। মৌ ও জাহিদের সূত্রে আমি এতকাল ওর আঙ্কেল ছিলাম। এখন হলাম বড় ভাই।
কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু প্রস্তুতি
গত কয়েক বছরে হিমালয়ের প্রায় সব কটি প্রধান ট্রেক করতে পেরেছি। তাই পর্বত অভিযানের কিছু প্রস্তুতি আমার নেওয়াই আছে। ট্রেকিং বুটস থেকে শুরু করে জামাকাপড়, টুপি, গ্লাভস, জ্যাকেট, ব্যাকপ্যাক—সবকিছু কেনা আছে। আমার ট্রেকিংয়ের সরঞ্জাম মোটামুটি ভালো। তবে এবারের লক্ষ্য আগের চেয়েও কিছুটা উঁচুতে ওঠা। এখন দরকার যথোপযুক্ত শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি। যতই নিয়মিত হাঁটি এবং দৌড়াই, আমার হার্ট রেট বেশি বেড়ে যায়। অল্পেই হাঁপিয়ে যাই।
এভারেস্ট বেজক্যাম্পের ট্রেকে লোবুচে থেকে ইবিসি যাওয়া যেমন দীর্ঘ ও কঠিন একটা দিন ছিল, তেমনি অন্নপূর্ণা সার্কিটে ছিল থোরাংলা পার হওয়ার দিনটা। সব ট্রেকেই এ রকম একটা দিন থাকে। কিলিমানজারো আরোহণে কোনো কোনো দিন এ রকম কঠিন হতে পারে?
কিলিমানজারো পর্বতে উঠতে টেকনিক্যাল ট্রেইনিং লাগে না, যেকোনো ট্রেকার যেতে পারেন। কিছু লেখাপড়া করে ইউটিউবের ভিডিও দেখে মনে হলো ওই পর্বতে আরোহণ আমার আগের যেকোনো অভিযানের চেয়ে অন্য রকম হবে। কেন যেন মনে হলো নেপালের বিভিন্ন ট্রেক এবং এভারেস্ট বেজক্যাম্প অভিযানের চেয়ে কিলিমানজারো আরোহণ বেশি কঠিন। বিশেষ করে শেষের দু-তিন দিন।
প্রথম আলোর সজীব মিয়া আমাকে দুটো বই উপহার দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটা হলো সাইফুল ইসলাম রিপনের সাত রাতের কিলিমাঞ্জারো, এগারো রাতের হিমালয়। এই লেখকের কিলিমানজারো ট্রেকের বিবরণ পড়ে আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। তাঁর ট্রেকের সময় আবহাওয়া ছিল প্রতিকূল। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে হেঁটে চলা সহজ নয়। সেই সঙ্গে আছে নিজের জামাকাপড় আর বিছানাপত্র ভিজে যাওয়ার বাড়তি বিড়ম্বনা। যেভাবে লেখক পথ চলেছেন এবং শিখরে পৌঁছেছেন, তা রীতিমতো রোমহর্ষ। তাঁর অভিযান সফল হলেও আমি খুব একটা ভরসা পাই না।