বরফের বিশাল ফাটলের সামনে দাঁড়াতেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল

পর্বতারোহণের মর্যাদাপূর্ণ একটি অভিযান ‘স্নো লেপার্ড চ্যালেঞ্জ’। এই অভিযান সম্পন্ন করতে তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানে অবস্থিত পামির ও তিয়েন শান পর্বতশ্রেণির পাঁচটি সাত হাজার মিটারের শৃঙ্গে আরোহণ করতে হয়। রোমাঞ্চকর অভিযানটি শুরু করেছেন বাংলাদেশি পর্বতারোহী সালেহীন আরশাদী ও ইমরান খান। তিন পর্বের এই অভিযানে প্রথম পর্বে অভিযাত্রীরা গেছেন কিরগিজস্তানের লেনিন শৃঙ্গ আরোহণে। সেখান থেকেই প্রথম আলো অনলাইনের জন্য নিয়মিত লিখছেন সালেহীন আরশাদী। আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব

অ্যালার্ম বাজল। রাত দেড়টা। এখন থেকেই আমাদের গোছগাছ শুরু করতে হবে। এই গোছগাছ, এই প্রস্তুতিই একটি মহাযজ্ঞ। প্রথমে জামাকাপড় পরা। লোয়ার ইনার, ট্রাউজার, আপার ইনার, ফুল স্লিভ টি–শার্ট, ফ্লিস, ডাউন, সবশেষে উইন্ড ব্রেকার। শেষবারের মতো ব্যাকপ্যাকটি ভালোমতো প্যাক করে নেওয়া। মাথায় হেডলাইটটি সেট করে এরপর অভিযানের সবচেয়ে কষ্টকর কাজগুলোর অন্যতম পর্বতারোহণের বিশেষ জুতা পরতে বসা।

এই বুট জুতাগুলো সাধারণত দুই স্তরের হয়। প্রথমে একটি ইনসুলেটেড বুট। এই স্তরের কাজ হলো পায়ের তাপমাত্রা ধরে রাখা, বাইরে থেকে ঠান্ডা যেন ভেতরে প্রবেশ না করে, একই সঙ্গে বুটের ভেতর জন্ম নেওয়া আর্দ্রতা বের করে দেওয়া। এই ইনসুলেটেড বুটটি শক্ত আরেক স্তরের বুটের ভেতর ঢোকানো থাকে। তীব্র ঠান্ডার মধ্যে একটি জুতা পরে তার ফিতা বাঁধাই যেখানে অনেক কঠিন, সেখানে একটির ওপর আরেকটি জুতা পরে দুটোই ভালো করে শক্ত করে বাঁধার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হলো।

রাত ঠিক তিনটায় বুট জুতার ফিতা বেঁধে ক্লান্ত দুজন তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। হিমালয়ের সঙ্গে পামিরের এটাও একটি লক্ষণীয় পার্থক্য। হিমালয়ে যেখানে তাঁবুর আলো–দূষণ থেকে একটু বাইরে যেতে পারলেই অগণিত তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে, পামিরে এমনটা এখনো দেখিনি। পামিরের আকাশে বিক্ষিপ্তভাবে গুটিকয়েক তারা ধর্মমতে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয় মাত্র। রাতের অন্ধকারে যেন পথ না হারাই, তাই গতকাল বিকেলেই যাত্রাপথটি ভালো করে দেখে নিয়েছিলাম। আমাদের এখন যেতে হবে পিক লেনিনের হিমবাহ অভিমুখে। আমরা যেখানে ক্যাম্প করেছিলাম, সেখান থেকে সেটি অনেকখানি দূর। তার চেয়েও বড় কথা যাত্রাপথটি খুবই বন্ধুর আর উঁচু-নিচু।

মাঝরাতের হিম ঠান্ডার মধ্যে ইমরানের হেডল্যাম্প সামনে অন্ধকার মোরেন বা গ্রাবরেখার (মাটি ও প্রস্তর দ্বারা গঠিত তির) দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেই দেখি পথনির্দেশক হিসেবে কিছু দূর পরপর ছোট ছোট রিফ্লেকটিভ ফ্ল্যাগ জ্বলছে, বাহ! পথ খুঁজে পাওয়া নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা করছিলাম এতক্ষণ। পথনির্দেশনা থাকলে পথের পরিমাণ কমে যায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘরে আমরা উঁচু-নিচু গ্রাবরেখার পথ ধরে এগোতে লাগলাম। পদযাত্রীদের জন্য বড়ই মর্মান্তিক জায়গা এই গ্রাবরেখা। কথা নেই বার্তা নেই পাথরের স্তূপ এই ১০০ মিটার ওপরে তুলে দিচ্ছে, পরক্ষণেই আবার ১৫০ মিটার নামিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে আমাদের ছোট একটি আইসফিল্ড বা তুষার প্রান্তরই অতিক্রম করতে হলো। ক্যাম্প থেকে রওনা হওয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা পর আমরা হিমবাহ গলে নেমে আসা নদীর দেখা পাই। এই নদী ধরেই এখন আমাদের উজানের দিকে উঠে যেতে হবে। সবার আগে এবার আমাদের বুট জুতায় ক্রাম্পন সেট করে নিতে হবে। এ আরেক বিতিকিচ্ছি কাজ।

ইমরান খান

ঠান্ডা পাথরের ওপর বসে, শরীরে সেটে থাকা আঁটসাঁট সব জামার বিপরীতে হাত দুটোকে জুতার সামনে নিয়ে, ক্রাম্পন ঠিকঠাকভাবে সেট করে, তীব্র ঠান্ডার মধ্যে ফিতা শক্ত করে বাঁধা একই সঙ্গে একটি শিল্প ও শাস্তি! জুতার সঙ্গে ভালোভাবে ক্রাম্পন সেট করা পর্বতারোহণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। শক্ত বরফে পথচলার জন্য, পিচ্ছিল বরফে বুটকে আটকে রাখার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। ক্রাম্পন একটু ঢিল করে পরা হলেই মাঝপথে বুট থেকে আলগা হয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই তীব্র ঠান্ডার মধ্যে গ্লাভস থেকে অসাড় হয়ে আসা আঙুলগুলো যতই আর্তনাদ করুক, তাদের বুঝিয়ে–শুনিয়ে দরকার হলে ধমক দিয়ে হলেও ভালোভাবে বুটের সঙ্গে ক্রাম্পন সেট করা গেল।

এরপর ঠান্ডা হিমবাহ ধরে আমরা এগিয়ে গেলাম। এদিকে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটছে। মনে মনে খুশি হয়ে উঠছি, যাক সূর্যের আলো গায়ে পড়লে এই অসহ্য ঠান্ডার ভাবটি আর থাকবে না। সকাল সাড়ে আটটার দিকে উঁচু-নিচু হিমবাহ পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম প্রথম আইসফলের (হিমপ্রপাত) সামনে। কী বিরাট, দৈত্যাকার—কত তলা সমান হবে এই ব্লকটি? ধারণা করার চেষ্টা করলাম, নাহ, নিচ থেকে আন্দাজ করা অসম্ভব।

সালেহীন আরশাদী

সব মিলিয়ে এটি প্রায় ২০০ মিটারের উঁচু দেয়াল। দুই ধাপে এই অংশটুকুতে দুটি করে দড়ি বাঁধা (রোপ ফিক্স) আছে। একটি দড়ি ধরে যেন নিচের ক্লাইম্বাররা জুমারিং করে ওপরে উঠে যেতে পারে। আরেকটি দড়ি ধরে যেন ওপর থেকে যারা নিচে আসবে তারা র‌্যাপেল করে নেমে যেতে পারে। আমরা বাঁ পাশের দড়ি ধরে জুমার করে ওপরে উঠতে শুরু করলাম। প্রথমে গেল ইমরান, এরপর আমি। ইমরান প্রথম অংশ জুমারিং শেষে দ্বিতীয় অংশ যেই শুরু করতে যাবে, ওপর থেকে চার-পাঁচজনের দল হইহই করে নিচে নেমে আসতে লাগল। ইমরানকে বাঁ পাশের দড়ি ধরে ওপরে উঠতে দেখেও তারা একই দড়ি ধরে চিৎকার করে নামা শুরু করে দিল। তাদের এই জোরজবরদস্তি নেমে আসার সঙ্গে বরফের বড় বড় টুকরা ভেঙে নিচে পড়তে লাগল। অবাক হয়ে দেখলাম এরা সবাই তরুণ নেপালি। ট্রেইলে অন্যদের সম্মান করা দূরের কথা, ক্লাইম্বিং নৈতিকতার কোনো ভব্যতাই তারা রাখেনি। জুলাই-আগস্ট এই দুই মাস নেপাল থেকে প্রচুর কর্মী পামির এলাকার পর্বতে কাজ করতে আসে। সিনিয়ররা কেউ এখানে গাইডের কাজ করেন, অপেক্ষাকৃত তরুণেরা পোর্টারের কাজ করেন। এ ছাড়া ওপরের ক্যাম্পগুলো সেটআপ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজও তারা করে থাকে। হিমালয়ে অনেকবার নেপালি হাই অল্টিটিউডে এমন গাইড পোর্টারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, কিন্তু কখনো এমন উচ্ছৃঙ্খলতার মুখোমুখি হইনি। ওপরে–নিচে মিলিয়ে তখন ক্লাইম্বারদের জট লেগে গেছে। জটের সুযোগে শুরু হয়ে গেল বিশৃঙ্খলা, সবার খুব তাড়া। কেউ এখন আর লাইন মেনে চলতে চাচ্ছে না। ওপরের ক্লাইম্বাররা আপহ্যান্ড পেয়ে দুটি দড়ি দিয়েই র‌্যাপেল করে নামা শুরু করে দিল। সবকিছু শেষে আমি আর ইমরান যখন বরফের দেয়ালের একেবারে ওপর গিয়ে দাঁড়ালাম ততক্ষণে ঘড়িতে দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে।

এদিকে আবহাওয়ার অবস্থাও বেগতিক। আকাশ কালো হয়ে শুরু হয়ে গেল তুষারপাত। হোয়াইট আউটের কারণের দৃষ্টিসীমা কমে ১০ ফুটে নেমে এল, এর বাইরের কিছু আর দেখা যাচ্ছে না। এমন বেগতিক অবস্থার মধ্যেই আমরা এসে পৌঁছালাম জলপ্রপাতের বিরাট এক ক্রেভাসের (হিমবাহের তুষারের উপরিভাগে গভীর ফাটল) সামনে। মুখ হাঁ করে থাকা বিশাল ফাটলের সামনে দাঁড়াতে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। সবচেয়ে আতঙ্ক লাগল ফাটলটি পার হওয়ার পর পুরোনো নড়বড়ে মইটি দেখে, এই পলকা জিনিসটি আমাদের ভার রাখতে পারবে তো?

সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে প্রথমে ইমরান অ্যালুমিনিয়াম এলয়ের তৈরি মই বেয়ে ওপরে ওঠা শুরু করল। ক্রাম্পন ও মই—দুই ধাতুর ক্যাচ ক্যাচ শব্দ গায়ে কাটা ফুটাচ্ছিল। শেষপর্যন্ত ধীর মনোযোগের সঙ্গে ইমরান পার হয়ে গেলে এল আমার পালা। আমার প্রথমবার, এমন কোনো মৃত্যুকূপের ওপর দিয়ে মই পাড়ি দেওয়া। বুকের কম্পন বেড়ে গেছে, চারপাশে হোয়াইট আউট, তুষারপাত, সামনে মই, আর নিচে ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ। একটি ভুল পদক্ষেপ আর মুহূর্তে সব শেষ। এত অস্থিরতার মধ্যে মনোযোগ দিয়ে প্রথমে সেফটি লক লাগালাম। এরপর ধীরে ধীরে মই বেয়ে ওপরে ওঠা শুরু করতেই আতঙ্ক সব উধাও হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বরফের মাঝের বিশাল ক্রেভাস পেরিয়ে ওপরে উঠে এলাম। নিরাপদে দাঁড়িয়ে বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস নেমে এল, সেই সঙ্গে নিজেদের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল।

এর পরের পথের গল্প হচ্ছে ধৈর্য পরীক্ষার। হোয়াইট আউটের মধ্যে খাঁড়া বরফের রাজ্যে ওপরে উঠে যাওয়া। এক ঘণ্টা ধরে চড়াই ওঠার পর মানচিত্র দেখে আমরা হতবাক! এতক্ষণে মাত্র ৫০ মিটার উঠেছি। এর মধ্যে বারবার সামনে ক্রেভাস আসতে লাগল। মনঃসংযোগ ঠিক রেখে প্রতিটি ক্রেভাস অতিক্রম করতে হচ্ছিল। কয়েকটি ক্রেভাস তো ‘দ্য ক্লিফ’ চলচ্চিত্রের মতো লাফ দিয়ে পেরিয়ে গেলাম। শেষ বিকেলে দূর থেকে পাথরের ঢালে সারিবদ্ধ লাল-হলুদ তাঁবু দেখতে পেলাম। প্রায় ১৫ ঘণ্টা পর গন্তব্য দেখতে পেলাম। ক্যাম্প–২–এ পৌঁছাতে এখনো ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। তারপরও চোখের সামনে একবার যখন ক্যাম্প–২–এর তাঁবু দেখা দিয়েছে, তখন গড়িয়ে গড়িয়ে হলেও একসময় পৌঁছে যাবই…