এভারেস্টে আরোহণের ছবি প্রকাশ করে শাকিল বললেন, ‘আমি দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে’
গায়ে পর্বতারোহণের জ্যাকেট, পায়ে ক্লাইম্বিং বুট, মুখে অক্সিজেন মাস্ক আর হাতে লাল–সবুজ পতাকা উঁচিয়ে ইকরামুল হাসান শাকিল বসে আছেন বরফঢাকা পর্বতের চূড়ায়। অভিযানের তিন দিন পর এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণের এই ছবি প্রকাশ করলেন তিনি।
আজ ২২ মে বেলা ১টা ৫ মিনিটে নিজের ফেসবুক পেজে এভারেস্টের চূড়ায় বসে থাকা ছবিটির সঙ্গে অভিযানের অভিজ্ঞতাও সংক্ষেপে লিখেছেন ইকরামুল হাসান। সেখানে বলেছেন, ‘১৯ মে ২০২৫। সকাল সাড়ে ছয়টা। আমি দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে। মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়। মাথার ওপর বিশুদ্ধ নীল আকাশ থাকার কথা ছিল, কিন্তু প্রকৃতি সেটা চায়নি। চেয়েছিল চরম পরীক্ষা। পায়ের নিচে ছিল অসীম শূন্যতা। ৮ হাজার ৮৪৮ দশমিক ৮৬ মিটার ওপরে দাঁড়িয়ে আমি শুধু একজন পর্বতারোহী নই, আমি তখন হাজারো আবেগ, ত্যাগ, সংগ্রাম আর স্বপ্নের প্রতিনিধি।’
ইকরামুল হাসান তাঁর এই অভিযানের নাম দিয়েছেন ‘সি টু সামিট’ অর্থাৎ সমুদ্র থেকে শৃঙ্গ। সেই লক্ষ্যেই গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে এভারেস্টের চূড়ার উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করেন। চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ও মুন্সিগঞ্জ হয়ে ১২ দিন পর ঢাকায় পৌঁছান। কয়েক দিন বিরতি দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ হয়ে ২৮ মার্চ পৌঁছান পঞ্চগড়। ইকরামুল হাসান পরদিন বাংলাদেশ থেকে প্রবেশ করেন ভারতে। দেশটির জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং হয়ে গত ৩১ মার্চ পা রাখেন নেপালে। এভাবে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে গত ২৯ এপ্রিল এভারেস্ট বেজক্যাম্পে পৌঁছান ইকরামুল হাসান।
এরপর মূল অভিযানের জন্য বেজক্যাম্প থেকে ক্যাম্প–২–এ পৌঁছান ১৬ মে। পরদিন ১৭ মে ক্যাম্প–৩ ও ১৮ মে পৌঁছান ক্যাম্প–৪–এ। এই ক্যাম্প থেকেই চূড়ান্ত যাত্রা করে ১৯ মে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টায় এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছান শাকিল।
এই যাত্রা সম্পর্কে শাকিল লিখেছেন, ‘এ পথ সহজ ছিল না। হিমালয়ের অতল গভীর বরফের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে আমাদের জীবনবিন্দু। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য। যমুনা নদীর উত্তাল খরস্রোতা ঢেউ, অনিশ্চয়তার দীর্ঘ পথ, খুম্বু আইসফল, লোৎসে ফেস, সাউথ কল, হিলারি স্টেপ একেকটা জায়গা যেন একেকটা মানসিক যুদ্ধক্ষেত্র ও মৃত্যুর চোখ রাঙানি। অক্সিজেনশূন্য উচ্চতায় কৃত্রিম অক্সিজেন মাস্কবদ্ধ মুখে প্রতিবারই মনে হয়েছে, আর পেরে উঠব না। কিন্তু হৃদয়ে বাজতে থাকা বাংলাদেশের নাম আর “সি টু সামিট” অভিযানের অঙ্গীকার আমাকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।’
ইকরামুল হাসান ৯০ দিনের মধ্যে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণের লক্ষ্য নিয়ে অভিযান শুরু করেছিলেন। তবে তার আগেই ৮৪তম দিনে এভারেস্ট শিখরে পৌঁছান। এ অভিযান শেষ করতে প্রায় ১ হাজার ৩৭২ কিলোমিটার পথ হেঁটেছেন। পথে পথে পেয়েছেন অনেক মানুষের ভালোবাসা। শাকিল লিখেছেন, ‘এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আমি কেঁদেছি—কৃতজ্ঞতায়, আনন্দে আর দায়িত্ববোধে। এই আরোহণ শুধু আমার একার নয়। এটি আমার দেশের, আমার মানুষদের, আর সেই সব তরুণের, যারা আজও স্বপ্ন দেখে নিজের সীমা ভেঙে কিছু করে দেখানোর। এটা তাদের, যারা বিশ্বাস করেছিল আমার স্বপ্নে। এটা তাদের, যারা আমাকে শিখিয়েছে, “অসম্ভব” শব্দটা শুধুই একটি দেরিতে মানা ব্যর্থতা। এভারেস্টের চূড়া থেকেই বলছি—সাহস থাকলে, পরিশ্রম থাকলে আর দেশের জন্য ভালোবাসা থাকলে, কোনো স্বপ্নই দূর থেকে যায় না।’
গাজীপুরের কালিয়াকৈরের তরুণ ইকরামুল হাসান সমুদ্র থেকে শৃঙ্গ ছোঁয়ার এই অভিযানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার পর্বতারোহী টিম ম্যাকার্টনি–স্নেপের কাছে। ১৯৯০ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো এভারেস্ট শৃঙ্গে আরোহণের পরিকল্পনা করেন। তাঁর একক অভিযানটির নাম দেন ‘সি টু সামিট এক্সপেডিশন’। অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হেঁটে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছানোর প্রয়াস। টিম করেছিলেনও তা–ই, ভারতের গঙ্গাসাগর থেকে ৯৬ দিনে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পা রাখেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে। ৩৫ বছর আগের ম্যাকার্টনির সেই কৃতিত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের পর্বতারোহী ইকরামুল হাসানও তাঁর অভিযানের নাম দেন ‘সি টু সামিট’। দেশের জনপ্রিয় পর্যটনস্থান কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে ইকরামুল হাসান হেঁটে জয় করলেন এভারেস্ট শৃঙ্গ।
১৯ মে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করে সেদিনই ক্যাম্প–২ পর্যন্ত নেমে আসেন ইকরামুল হাসান। সেখানে রাত কাটিয়ে ২০ মে বেলা সাড়ে ১১টায় নেমে আসেন বেজক্যাম্পের নিরাপদ আশ্রয়ে। অতি উচ্চতা, প্রতিকূল আবহাওয়া আর দীর্ঘ অভিযানের ধকল যাওয়ায় বেশ কাহিল হয়ে পড়েছেন তিনি। এভারেস্ট বেজক্যাম্পে বিশ্রাম নিয়ে ২১ মে আরও নিচের দিকে নেমে আসতে শুরু করেছেন ইকরামুল হাসান।