যে শহরে আছে ইসলামের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ

কোনো রকম সিমেন্ট ছাড়াই তৈরি হয়েছিল এসব স্থাপত্য, এখনো দাঁড়িয়ে থেকে রোমানদের দাপটের কথা জানান দিয়ে যাচ্ছে
ছবি: লেখক

অনেক দিনের পরিকল্পনা তিউনিসিয়া যাব। হুট করেই টিকিট কেটে নিউইয়র্ক থেকে এয়ার ফ্রান্সের বিমানে উঠে বসলাম। গন্তব্য তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিস। সেখান থেকে যাব প্রাচীন শহর কাইরুয়ান। তিউনিস থেকে কাইরুয়ান প্রায় ১৬০ কিলোমিটার। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম। মাঝে দুগ্গা নামের এক জায়গায় থামব, রোমান ধ্বংসাবশেষ দেখব। তিউনিস থেকে দুগ্গা দেড় ঘণ্টার ড্রাইভ। তিউনিসিয়ার রাস্তাঘাট বেশ পরিপাটি। হাইওয়েতে ওঠার পর বেশ মনোরম দৃশ্য চোখে পড়ল। সারি সারি জলপাই বাগান। দূরে অ্যাটলাস পর্বতমালা দেখা যায়।

দুগ্গা গিয়ে চোখ কপালে ওঠার অবস্থা। এই রোদে হাঁটব কী করে। তারপরও শহরের ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে মনটা ভরে গেল, রোদকে তোয়াক্কা না করে হাতে পানি আর মাথায় ক্যাপ পরে হাঁটা শুরু করলাম। কোনো রকম সিমেন্ট ছাড়াই তৈরি হয়েছিল এসব স্থাপত্য। এখনো দাঁড়িয়ে থেকে রোমানদের দাপটের কথা জানান দিয়ে যাচ্ছে। রোমানদের বেশ বড় উপনিবেশ ছিল তিউনিসিয়া। ইতালির সিসিলি থেকে মাত্র চার–পাঁচ ঘণ্টা দূরে তিউনিসিয়া। তাই রোমানরা ইতালির পর উত্তর আফ্রিকাতেই রোমান সম্রাজ্য বিস্তার করা শুরু করেছিল। তিউনিসিয়া ছিল বেশ বড় রোমান উপনিবেশ। রোমানরা চলে যাওয়ার পর এসব শহরে আর বসতি গড়ে ওঠেনি। তাই ধ্বংসাবশেষগুলো বেশ ভালো অবস্থায় আছে। প্রায় দুই হাজার বছরের পুরোনো রোমান রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তখনকার সময়ের কথা কল্পনা করা শুরু করলাম। বাজার, দোকান, ঘরবাড়ি বেশ অনেক কিছুই এখনো বেশ ভালো অবস্থায় আছে। শহরটা কেমন ছিল বোঝা যায়। দুগ্গাতে ঘুরতে ঘুরতে অনেক সময় চলে গেল। কাইরুয়ান আরও দুই ঘণ্টার ড্রাইভ।

কাইরুয়ান পৌঁছে সোজা হোটেলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবারের খোঁজে বের হলাম। কাইরুয়ানের পুরোনো শহরে পৌঁছে মনে হলো আরব্য রজনীর কোনো শহরে চলে এসেছি। পুরোনো শহরকে তারা বলে মদিনা। যেকোনো বড় শহরেই একটা করে মদিনা থাকে। মদিনা ঘিরে থাকে উঁচু দেয়াল। শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতেই এ ব্যবস্থা। বলে রাখা ভালো, কাইরুয়ানের মদিনা একটি ইউনেসকো বিশ্বঐতিহ্য স্থাপনা।

কাইরুয়ানের মদিনা
ছবি: লেখক

মদিনা থাকে অনেক ব্যস্ত। চারদিকে মানুষ, দোকানপাট। মদিনা থেকে একটু দূরে গাড়ি পার্ক করে আমরা মদিনার দিকে চললাম। দুপুরে গড়িয়ে বিকাল প্রায়, খিদায় মাথা খারাপের দশা, কোথায় খাবো বুঝতে পারছি না। আশপাশে স্থানীয় কোনো খাবারের দোকান আছে কি না, এক দোকানিকে জিজ্ঞাসা করতে সে নিজেই নিয়ে গেল। দোকানটা অনেকটা আমাদের ঢাকা শহরের পাড়ার হোটেলের মতো। কিন্তু একটাই মেনু, তাজিন। উত্তর আফ্রিকার বেশ জনপ্রিয় খাবার। ভেড়ার মাংস, সঙ্গে সবজি আর ভাত। খুব কম মসলা দিয়ে রান্না করা। খেতে তেমন ভালো লাগেনি। তবু খিদার চোটে তা–ই খেলাম। পেটের খিদা মিটেছে, এবার মনের খিদা মেটানো যাক। মদিনা ঘুরে দেখা যাক।

আমাদের পুরান ঢাকার চিপা গলির মতো অনেকটা
ছবি: লেখক

বাড়িঘর, বাজার, স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা—দেয়ালের মধ্যেই সব। বড় রাস্তার ভেতরে ছোট ছোট রাস্তা। আমাদের পুরান ঢাকার চিপা গলির মতো অনেকটা, কিন্তু বেশ পরিষ্কার। আরেকটা বিষয় চোখে পড়ল, প্রতিটা গলিতেই অনেক বিড়াল। রাস্তার আশপাশেই বসে থাকে। স্থানীয় একজনের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, স্থানীয় লোকজনই তাদের খাবার দেয়, দেখভাল করে। প্রতিটা বাড়ির দরজাই স্বতন্ত্র ও সুন্দর। ঘোড়ার নালের মতো নকশা করা। এ  ধরনের দরজা মূলত উত্তর আফ্রিকাতেই দেখা যায়। অলিগলিতে বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে আবার বড় রাস্তায় উঠলাম। চোখে পড়ল মাখদুখের দোকান। মাখদুখ স্থানীয় একধরনের মিষ্টি, অনেকটা আমাদের দেশের শিরা পিঠার মতো, খেতে বেশ মিষ্টি। আমরা কয়েকটা নিলাম, হাঁটতে হাঁটতে খাওয়া যাবে।

বেশ কিছুদূর হাঁটার পর চোখে পড়ল বিখ্যাত কাইরুয়ান জামে মসজিদ। আরেক নাম উকবা মসজিদ। উকবা মসজিদ ইসলামিক স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন আরব জেনারেল উকবা ইবনে নাফি। তিনি ৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে কাইরুয়ান শহরের গোড়াপত্তন করেন। সমসাময়িক সময়ে মসজিদটিও নির্মাণ করেন। এই মসজিদ তৈরি হয়েছিল ইসলামের শুরুর দিকের সময়। হাইপোস্টাইল (পিলারনির্ভর ছাদ) পদ্ধতিতে এই মসজিদের নামাজের স্থানটি তৈরি করা হয়েছে। যার পরিধি প্রায় ৪০৫ মিটার। এতে বেশ বড় একটি বর্গাকার মিনার রয়েছে। অনেকে এই মসজিদকে মধ্যযুগের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করেন। কারণ, এই মসজিদে সে সময় ইসলামচর্চার পাশাপাশি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাও হতো।

বিখ্যাত কাইরুয়ান জামে মসজিদ, আরেক নাম উকবা মসজিদ
ছবি: লেখক

শহর ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বিকেলে একটা ক্যাফেতে বসলাম। তিউনিসিয়া অনেক বছর ফরাসি কলোনি ছিল, তাই তারা ক্যাফে–সংস্কৃতি বেশ ভালোভাবে ধারণ করে। ক্যাফেতে কোনো খাবার নেই, শুধু কফি, চা আর হুঁকা। হুঁকা আরব সংস্কৃতির অংশ। এখানে ছোটবড় সবাই খায়। আমরা কফি নিয়ে বসলাম।

ক্যাফেতে বেশির ভাগ বসার জায়গাই বাইরে। কফি নিয়ে বাইরে বসে গল্প করছে মানুষ, আরবি গান চলছে, অনেকে ব্যাকগ্যামন বোর্ড পেতে খেলছে। সবাই বেশ নির্ভার। মনে হলো এখানে মানুষকে যান্ত্রিকতা তেমন একটা ছুঁতে পারেনি। বেশ ভালো লাগল, অনেক সময় বসে থাকলাম। পরে একটা রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার সেরে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।