নীলফামারীর ডিমলা থেকে কায়াক চালিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে গেছেন ইনতিয়াজ

নীলফামারীর ডিমলা থেকে কায়াক চালিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে গেছেন ইনতিয়াজ মাহমুদ। ৪৮ দিনের অভিযানে পাড়ি দিয়েছেন প্রায় এক হাজার কিলোমিটার নৌপথ। তাঁর এই উদ্যোগে সহযোগী ছিল ‘ছুটির দিনে’। অভিযাত্রী নিজেই লিখেছেন তাঁর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

ডিমলার খগাখড়িবাড়ি থেকে কায়াক চালানো শুরু করেন ইনতিয়াজ মাহমুদ
ছবি: ইনতিয়াজ মাহমুদের সৌজন্যে

পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হলেও জীবনের বড় একটা সময় পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে কাটিয়েছি। ২০২৩ সালে কায়াকের পোকা মাথায় ঢোকে। অল্প অল্প করে কায়াকের কেরামতি রপ্ত করি। ঢাকার আশপাশের নদীগুলোয় ছোট কয়েকটা ট্রিপ, কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে অষ্টগ্রাম, কর্ণফুলী বেয়ে কাপ্তাই থেকে চট্টগ্রাম, বুড়িগঙ্গায় সদরঘাট থেকে চাঁদপুর। আর গত জুনে পদ্মা নদীতে কায়াক চালিয়ে পৌঁছাই রাজশাহী থেকে চাঁদপুর। এরপরই মাথায় ঢোকে কায়াকে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ যাওয়ার পোকা। কিন্তু তেঁতুলিয়া থেকে সোজাসুজি কোনো নদী নেই। কাছেই নীলফামারীর ডিমলার ভারত-সীমান্তে দেশে ঢুকেছে তিস্তা। ঠিক করলাম, এখান থেকেই শুরু করব অভিযান।

৩০ দিনের অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে ১৮ অক্টোবর ডিমলার খগাখড়িবাড়ি থেকে কায়াক চালানো শুরু করি। তিস্তা অববাহিকা ধরে কায়াক নিয়ে ভেসে বেড়াই আমি। তিস্তার পানি তলানিতে চলে এসেছে তখনই। জায়গায় জায়গায় কায়াক থেকে নেমে দড়ি ধরে টেনে পার হতে হয়। এভাবে নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা হয়ে তিস্তা পার করে ব্রহ্মপুত্রে ঢুকে পড়ি। তারপর নদীর এপার–ওপার করে করে জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা পার করে উত্তরবঙ্গের অধ্যায় শেষ করি ৪ নভেম্বর।

নৌপথে যেতে যেতে পেয়েছেন স্থানীয় মানুষের ভালোবাসা
ছবি: ইনতিয়াজ মাহমুদের সৌজন্যে

উত্তরের উষ্ণ ভালোবাসা

এই অধ্যায়ে আমার মনজুড়ে আছে উত্তরের মানুষের মায়াভরা মুখ। প্রতিদিনই যেন আগের দিনকে ছাড়িয়ে যেত একেকটা অভিজ্ঞতা। কুড়িগ্রামের এক চরের কথাই বলা যাক। গ্রামটাই যেন বড় একটা বাড়ি, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই একই পরিবারের মানুষ। কায়াক রেখেছিলাম চন্দন নামে একজনের বাড়িতে। বাড়ির পাশে নদীর ধারে রাতের বেলা চন্দনেরা কজন মিলে গান ধরেন। তাঁর স্ত্রী রান্না করেন গানের আসরের সবার জন্য। তাঁদের সঙ্গে খেয়ে ঘুমাতে এসেছিলাম আসগর আলী নামে একজনের বাড়িতে। এখানে এসেও খেতে হলো আরেক দফা। সকালে খিচুড়ি আর চা খেয়ে বের হয়ে দেখি এক চাচি রুটি আর চিনি হাতে দাঁড়িয়ে। এগুলো আমাকে দিলেন পথের খাবার হিসেবে। এক দিদি বললেন, ‘দেবার কিছু নেই, কটা বাদাম ভেজে এনেছি।’ 

বিস্ময় আর আবেগে টলমল চোখে কায়াক টেনে নিয়ে বেরোনোর সময় মনে হচ্ছিল যেন কত বছর ছিলাম আমি এই চরে। তারপর গাইবান্ধার চাপড়া-সাঘাটা কিংবা সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, বগুড়ার পারতিতপরল বা পাবনার ঘোপশিলেন্দা, উত্তরের উষ্ণ ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি প্রতিবার।

যে পথে ডিমলা থেকে টেকনাফ গেছেন ইনতিয়াজ
ছবি: ইনতিয়াজ মাহমুদের সৌজন্যে

জোয়ার-ভাটার খেলা

পাবনা থেকে বেরিয়ে যমুনার পাট চুকিয়ে আমি এসে পড়ি পদ্মায়। পাটুরিয়া থেকে মানিকগঞ্জের পাশ দিয়ে মাওয়া হয়ে মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর পার করে ৯ নভেম্বর চলে আসি চাঁদপুরে! এখান থেকেই মুখোমুখি হলাম জোয়ার–ভাটার। মেঘনায় ঢোকার আগের দিন যখন, যতক্ষণ খুশি চলতাম, কিন্তু এখন কেবল ভাটার সময়ই এগোনো যায়। জোয়ারের সময় পানির প্রবাহ থাকে আমার রুটের উল্টো দিকে, তখন সামনে এগোনো অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। এদিকে হেমন্ত চলে আসায় দিনের আলোও কমে আসে।

তবু জোয়ার-ভাটার নিয়ম মেনে যেতে যেতেই পেয়ে গেলাম আমার নিজের জেলা নোয়াখালী। চেয়ারম্যানঘাটে এসে দেখি কয়েকজন অপেক্ষা করছেন। তাঁরা আগে থেকেই জানতেন আমার অভিযানের কথা। তাঁদের সঙ্গে এক মাস পূর্তির দিনটি দারুণ কাটল। নোয়াখালীর কাটাখালী থেকে তারপর যাচ্ছিলাম উড়িরচরের দিকে। পরিকল্পনা ছিল বালুয়াঘাটে যাব। কিন্তু এখানে গোলগাল চেহারার উড়িরচর আর ছোট ডুবোচর মিলে স্রোতের অবস্থা করে রেখেছে পুরো হযবরল। জোয়ারেও ভাটার মতো টান। সকাল ৯টায় বেরিয়েছিলাম কাটাখালী থেকে। স্রোতের সঙ্গে না পেরে ভাবলাম স্বর্ণ দ্বীপ যাই। কিন্তু শেষে তালবোল হারিয়ে বেলা একটায় দেখি এগোনোর বদলে উল্টো কাটাখালী থেকেও ২-৩ কিলোমিটার পিছিয়ে গেছি। স্রোত মনে হচ্ছিল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে হাতিয়া কিংবা ভাসানচরের দিকে। একটা মাছ ধরার নৌকা ধরে তখনকার মতো রক্ষা পেলাম। বেলা দুইটার পর আবার সেই কাটাখালী থেকে শুরু করলাম। নৌকার মাঝির দেখানো রুটে স্বর্ণ দ্বীপে পৌঁছালাম সন্ধ্যায়।

পরদিন সন্দ্বীপ যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও তা আর হয় না। পরিকল্পনা বদল করে চ্যানেল পার হয়ে চলে আসি চট্টগ্রামের মিরসরাই। তারপর চট্টগ্রামের উপকূল ধরে এগোতে থাকি আরও দক্ষিণে। কুতুবদিয়ায় মগনামাঘাট, উজানটিয়া, বদরখালী, মহেশখালী হয়ে ২৯ নভেম্বর পৌঁছে গেলাম কক্সবাজার। এখানে শুরু হলো এক নতুন চ্যালেঞ্জ। তীর থেকে বের হয়ে সমুদ্রে ঢোকা আর সমুদ্র থেকে তীরে ওঠা, দুটোই ছোটখাটো যুদ্ধ। তাই কক্সবাজার থেকে বাকি পথ দিনে একবারই বের হই, এক ভাটায় যত দূর যাওয়া যায় তাতেই পাট চুকিয়ে দিতে হতো। কিন্তু ইনানী বিচের পর থেকে আবার শুরু হলো পাথরের বিড়ম্বনা! সব বিপত্তি পার করে চার দিনে কক্সবাজার থেকে আসি টেকনাফ পর্যন্ত।

কক্সবাজার থেকে টেকনাফে যেতে লেগেছে চার দিন
ছবি: ইনতিয়াজ মাহমুদের সৌজন্যে

শেষ দিন

৪ ডিসেম্বর সকালে টেকনাফের নোয়াখালী পাড়া থেকে ফুরফুরে মেজাজে বের হলাম। আজই অভিযানের শেষ দিন। এগিয়ে যাচ্ছিলাম নানা কিছু ভাবতে ভাবতে। বিকেলে যখন চোখের সামনে স্থলপথের শেষ বিন্দুটা দেখলাম, যেখান থেকে সামনে কেবল পানি, আনন্দে বুক ভরে এল। শেষের দিকে এসে একটু অসুবিধায় পড়তে হলো। কক্সবাজার থেকে আসার সময় পুরো পথ সরলরেখার মতো, ঢেউ সব সময় একটা নির্দিষ্ট কোণে তীরের দিকে আসে। কিন্তু এখানে শেষ প্রান্তে জায়গাটা গোল করে বাঁকানো। একটা জায়গায় দেখি ঢেউ তীর থেকে অনেকটা দূরেই গোল হয়ে ভেঙে পড়ছে। এই ধরনের ঢেউয়ে কায়াক নিয়ে এগোনো কঠিন। তাই খুব সাবধানে এগোচ্ছিলাম। কিন্তু একদম শাহপরীর দ্বীপে এসে দেখি উত্তাল ঢেউ। পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখি বাঁধের ওপর বিশাল জটলা, ভাই-ব্রাদার সবাই আমার অপেক্ষায়। আরও চাপে পড়ে গেলাম। আর যাহোক তীরে এসে তরি ডোবানো যাবে না। অনেকটা ঘুরে ঢেউয়ের ছন্দ বুঝে তারপর ধীরে ধীরে তীরের দিকে এগোলাম। বড় বেশ কয়েকটা ঢেউ কাটিয়ে ফাঁকা পেয়েই জোরসে প্যাডেল মেরে আশঙ্কাজনক জায়গাটুকু পার হলাম। এরপর তাকিয়ে দেখি সবাই দৌড়ে আসছে আমার দিকে। 

এভাবেই ৪৮ দিনের মাথায় শেষ হলো আমার প্রায় হাজার কিলোমিটারের নৌযাত্রার ‘এক্সপেডিশন তিস্তা-টেকনাফ’।

আরও পড়ুন