একই দিন রাত একটায় পর্বতচূড়ার উদ্দেশে রওনা হই। প্রথম ঘণ্টা চারেক পথ পুরোটাই এবড়োখেবড়ো, বড় বড় পাথরের বল্ডারের মধ্য দিয়ে গেছে। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে পাথুরে পথ পেরিয়ে আমরা বরফের পথে হাঁটতে লাগলাম। সূর্য উঠি উঠি করছে, এমন সময় আমরা পৌঁছাই উঁচু বরফের দেয়ালের সামনে। গাইড জানালেন, এখান থেকে ফিক্সড রোপে জুমার সেট করে আমাদের সামনে আগাতে হবে।

বরফের দেয়াল ডিঙিয়ে আমরা এসে দাঁড়ালাম ডোলমা খাং পর্বতচূড়ায় পৌঁছানোর আগের সর্বশেষ বাঁধা ৬০ মিটারের মতো খাড়া পাথুরে একটা দেয়ালের সামনে। ওটা অতিক্রম করলেই চূড়া মিনিট পাঁচেকের পথ। প্রধান গাইড কিলু শেরপা ইতিমধ্যে পাথুরে দেয়াল বেয়ে ওঠা শুরু করেছেন। তিনি নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে আমাকে তাঁর পদানুসরণ করতে বললেন। মূলত এ ধরনের পাথুরে দেয়াল বেয়ে ওঠার জন্য রক ক্লাইম্বিংয়ের বিশেষ দক্ষতা থাকা দরকার, যা আমার নেই। এ কারণে আমি কিছুটা ভীত ছিলাম। যদিও সঙ্গে থাকা দুই শেরপার উৎসাহে অনেকটাই ভরসা পেলাম। পাথুরে দেয়ালে ঝুলে থাকা ফিক্সড রোপে (খাড়া পাহাড়ে আগে থেকে বেঁধে রাখা দড়ি) জুমারকে ওপরের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেকে টেনে তুলতে লাগলাম ধীরে ধীরে। কিন্তু আইস বুটে লাগানো ক্রাম্পুনের জন্য খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলাম না। সামনের শেরপা বারবারই আমাকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন কোথায় পা রাখলে সহজে উঠতে পারব। মিনিট ১৫ ওঠার পর পানি পানের বিরতি নিলাম। বুঝতে পারছিলাম, মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে আছে। একফাঁকে হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলাম। সকাল পৌনে ৮টা। গাইড জানালেন, আরও ১৫ থেকে ২০ মিনিটের পথ বাকি। পানি পান শেষে নতুন উদ্যমে আবারও পথ চলা শুরু করলাম। পায়ের আইস বুটটা একটুও স্বস্তি দিচ্ছে না এবারের অভিযানে। বাজেট-স্বল্পতায় বুট কিনতে পারিনি। বেশ পুরোনো ও ওজনে ভারী একটা আইস বুট ভাড়া নিয়েছিলাম থামেলের দোকান থেকে।

খাড়া পাথুরে দেয়ালের ক্লাইম্বিং শেষ করে আমরা সরু রিজের মতো একটা জায়গায় পৌঁছালাম। এখান থেকে সামিট মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। তবে সে রিজটা খুব সরু। নিরাপদ জায়গা বেছে নিয়ে প্রধান গাইড বললেন, ‘আগে একটু বিশ্রাম নাও, গরম চা ও চকলেট খাও।’ প্রায় ৭৫ ডিগ্রি খাড়া পাথুরে দেয়াল বেয়ে ওপরে ওঠার পর শরীরে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। বিশ্রাম ও খাওয়া শেষে সরু রিজ ধরে আবার হাঁটা শুরু করলাম। কাঙ্ক্ষিত চূড়া আর মাত্র এক মিনিটের পথ।

আবারও হাঁটা শুরু করলাম। প্রধান গাইড সবার আগে চূড়ায় পৌঁছে আমার দিকে ক্যামেরা তাক করে রেখেছেন। আমি এক পা দু পা করে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। অতঃপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নেপাল স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ২০ মিনিটে ডোলমা খাং চূড়ায় পা রাখলাম। চোখে আনন্দাশ্রু। আমার পেছন পেছন অন্য গাইড ওয়ান্ডু শেরপাও চলে এলেন। আমরা একে অন্যকে অভিনন্দন জানালাম। তারপর চলল ফটোসেশন। চূড়ায় ঘণ্টাখানেক অতিবাহিত করেছি আমরা।

এবার নিচে নামার পালা। একটা পর্বত অভিযান তখনই সফল বলা যাবে, যখন আপনি সুস্থভাবে নিচে নেমে আসতে পারবেন। আর চূড়া জয় শেষে নিচে নেমে আসার পথেই অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। কারণ, পর্বতারোহীরা চূড়ায় উঠতে গিয়েই শরীরের সব শক্তি ব্যয় করে ফেলেন, ফলে নিচে নামার জন্য আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট থাকে না।

আমরা সতর্কতার সঙ্গে নিচে নামতে লাগলাম। এখন একমাত্র বাধা সেই পাথুরে দেয়াল। শেরপার নির্দেশনায় যা ঠিকমতো অতিক্রম করতে পারলাম। যে পথ উঠতে আমাদের আধা ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছিল, নামতে লাগল মাত্র ১০ মিনিট। পাথুরে দেয়াল-পরবর্তী পথটুকু এ অভিযানের সবচেয়ে রিলাক্সিং পথ ছিল। ডোলমা খাং পর্বতচূড়ায় ওঠার জন্য ৪০০ মিটারের মতো ফিক্সড রোপ বাধা হয়েছিল, যার মধ্যে ৬০ মিটার ছিল সেই পাথুরে দেয়াল। বাকি পথ বরফের খাড়া দেয়াল। এ ধরনের খাড়া বরফদেয়াল নামতে হয় র‍্যাপলিং করে। যে পথ উঠতে সময় লেগেছিল ঘণ্টা দেড়েক, তা মাত্র ১০ মিনিটেই নেমে গিয়েছি।

বেশ কিছুটা পথ নিচে নেমে নিরাপদ জায়গা দেখে বিশ্রাম নিয়ে নিলাম কিছুক্ষণ। সঙ্গে আনা শুকনা খাবারও খেয়ে নিলাম। যদিও কিছুই খেতে ইচ্ছা করছিল না। শেরপারা বারবার জোর করছিলেন খাওয়ার জন্য। কেননা, আমাদের হাইক্যাম্প পৌঁছাতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। শক্তি দরকার।

ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় ডোলমা খাং হাইক্যাম্প যখন পৌঁছালাম, ঘড়িতে তখন প্রায় তিনটা বাজে। আমার গায়ে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। তবু আমি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। কথা ছিল, সামিট শেষ করে ওই দিন আমরা হাইক্যাম্পেই রাত কাটাব। কিন্তু আমি নিচে বেদিং গ্রামে নেমে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। গাইড জানালেন, এখান থেকে বেদিং পৌঁছাতে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। মনে শতভাগ শক্তি সঞ্চয় করে নিচের দিকে নামা শুরু করলাম।

বেদিং গ্রামে যখন পৌঁছালাম, তখন রাত সাড়ে আটটা। শেষ পর্যন্ত সুস্থভাবে নেমে আসতে পেরে ভীষণ আনন্দ লাগছিল। একটি সফল অভিযান শেষে ৯ নভেম্বর কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় ফিরে আসি।