গহিন পাহাড়ে অঝর বৃষ্টি

রাঙামাটির বিলাইছড়ির রেংখং নদীতে হঠাৎ বৃষ্টিছবি: পরিতোষ গোপ

‘চেক!’ ঘোড়াটা আড়াই ঘর এগিয়ে দিয়েই বলে ওঠে এক দাবাড়ু।

প্রতিপক্ষ তরুণের কপালে চিন্তার ভাঁজ। পরাজয় বরণের আগে একা দাঁড়িয়ে রাজা, সৈন্যসামন্ত হারিয়ে বিমর্ষ। মহারাজকে তিন আঙুলে তুলে নিয়ে শেষ চেষ্টা করেন তরুণ। প্রতিপক্ষ দুজনকে ঘিরে আরও চার-পাঁচজন। সবার দৃষ্টি একবার সাদা ঘোড়ার দিকে, আরেকবার রাজার দিকে। রেংখং নদীপাড়ের দোকানটায় টান টান উত্তেজনা।

শেষ রক্ষা অবশ্য হয় না, নৌকার চালে ধরাশায়ী হন রাজা। সোল্লাসে ফেটে পড়েন সবাই। একজন শুধু অপ্রস্তুত। তাঁকে ঘিরে তঞ্চঙ্গ্যা তরুণেরা মাতৃভাষায় নানা কথা বলতে থাকেন। কী কথা বলছেন, বোঝা না গেলেও অভিব্যক্তিতে পরিষ্কার বোঝা যায়—হারের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন তাঁরা।

উলোছড়া পাড়ায় দাবার লড়াই
ছবি: লেখক

সকাল তখন সাড়ে সাতটা। রোদ উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। আমরা আছি রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার উলোছড়া পাড়ায়। পাড়া বলতে যে ঘিঞ্জি বাড়িঘরের ছবি মানসপটে ভেসে ওঠে, উলোছড়া তেমনটি নয়। চারপাশে সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝে অতিকায় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মতো সমতল ভূমি। পাথুরে প্রকৃতির মাঝে পলিমাটি এখানে সৌরভ ছড়ায়। ফসলি জমি, পাহাড় ঘেঁষে ছড়ানো–ছিটানো বাড়িঘর, সুউচ্চ পাহাড় আর রেংখং নদী নিয়ে উলোছড়া। পাড়ার তরুণেরা এই সাতসকালেই দাবা বোর্ডে দ্বিতীয় কিস্তির ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমরা কথা বলি তাঁদের পাশে দাঁড়ানো স্থানীয় গাইড আদর তঞ্চঙ্গ্যার সঙ্গে। তাঁর মতো উলোছড়া পাড়ায় প্রায় ৩৫ জন পর্যটকদের পথ দেখান।

উলোছড়া পাড়ার কয়েকটা বাড়ি
ছবি: লেখক

আদরের সঙ্গে ধুপপানি ঝরনার পথে পা বাড়াই। শুরুতে দুই কিলোমিটার কর্দমাক্ত পথ, তারপর উলোছড়া পাড়ার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টা ডিঙাই। এভাবে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা পর পৌঁছাই ধুপপানির সামনে। অঝোরে বৃষ্টি নামে গহিন পাহাড়ে। আমাদের শহুরে মনে ভয় ধরিয়ে দেয়—বুঝি ঢল নামবে। শ্রাবণের আকাশ সে ভয় কাটিয়ে দেয়। বৃষ্টি থামলে নিজেকে সমর্পণ করি ঝরনার জলে। শীতল জলে প্রশান্ত হয়ে ফেরার পথ ধরি।

আমাদের আপ্যায়নের জন্য গাছ থেকে ডুমুর ফল পাড়ছেন আদর তঞ্চঙ্গ্যা
ছবি: লেখক

যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টার পাহাড়ি পথ। হাঁটতে হাঁটতে দলের ১২ জন ক্লান্ত-অবসন্ন। মনে হচ্ছিল পায়ে কে যেন জগদ্দল পাথর বেঁধে দিয়েছে। এর মধ্যে উলোছড়াপাড়ার কাছে হাঁটুসমান কাদা। তবু পথ শেষ হচ্ছে ভেবে যে শক্তিটুকু পাওয়া গেল, তাতেই এসে থামি দোকানটার ঝাঁপির ছায়ায়। দুপুরের রোদ উত্তাপ ছড়ায় উলোছড়ায়। মিনিট পাঁচেক বসে আমরা নৌকায় উঠি।

দলেবলে ধুপপানি ঝরনায়
ছবি: ছুটির দিনে

ভোরে বিলাইছড়ি থেকে আসার সময় সবাই ছইয়ের ওপর বসেছিলাম। কিন্তু ফিরতি পথে কারও আর ছইয়ে বসার সাহস হলো না। তপ্ত রোদে ছইয়ের এক প্রান্তে একা মাঝি। তাঁর এক হাতে ছাতা আরেক হাতে নৌকার হাল। নিত্যরঞ্জন চাকমা নৌকার হালের মতো দুই দিন ধরে আমাদের ঘুরে বেড়ানোর হালও ধরে আছেন। তাঁর সঙ্গেই ঘুরছি আমরা।

রৌদ্রোজ্জ্বল পাহাড়ি প্রকৃতিকে ঢেকে দিল কালো মেঘ
ছবি: লেখক

দুই পাহাড়ের মাঝে বাঁক নিয়েছে রেংখং। মিনিট তিনেকের মধ্যে মেঘের আড়ালে গিয়ে লুকায় সূর্য। রৌদ্রোজ্জ্বল পাহাড়ি প্রকৃতিকে ঢেকে দেয় কালো মেঘ। দূর পাহাড়ে তাকিয়ে দেখি মাথায় মেঘের বসতি। ক্রমে বৃষ্টি হয়ে সামনের পাহাড়ের গায়ে, রেংখং নদীর বুকে নামে সেই মেঘ। খালের মতো সরু পাহাড়ি নদী রেংখং। ঝুমবৃষ্টিতে নেচে ওঠে তার পানি। হঠাৎ হঠাৎ দেখা পাওয়া জেলে নৌকাগুলো পাড় ঘেঁষে দুলছে। কোনো কোনো নৌকায় ভাঙা ছাতা হাতে জবুথবু হয়ে বসে আছে পাহাড়ি পুরুষ। এমন বৃষ্টিতে ছইয়ের তলায় কে থাকে। বৃষ্টি, বৃষ্টি বলে একে একে বেরিয়ে আসেন দলের সবাই। নৌকার গলুইয়ে বসে কেউ। কেউ উঠে পড়েন ছইয়ের ওপর। দুহাত প্রসারিত করে মুখ তুলে আকাশপানে। অঝোরে ঝরতে থাকে শ্রাবণধারা। ক্লান্ত শরীরে আমরা সেই বারিধারার নাম দিই—প্রশান্তি।