আর্জেন্টিনা হয়ে অ্যান্টার্কটিকা ঘুরে এলেন মহুয়া রউফ, বললেন সেই রোমাঞ্চকর গল্প

সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ৬ দিন শেষ। অন্য দিনগুলো কেটেছে অ্যান্টার্কটিকার সাগর আর উপসাগরে ঘুরে। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের রাজ্য, বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার রূপ, করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার আরও গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ

অ্যান্টার্কটিকায় পেঙ্গুইনের রাজ্যে মহুয়া রউফছবি: লেখকের সৌজন্যে

জ্ঞান ফিরলে দেখি, কেবিনে শুয়ে আছি। সামনে দাঁড়িয়ে জাহাজের ডাক্তার আর তিন ক্রু।

‘রেস্তোরাঁর সামনে তুমি অচেতন হয়ে পড়ে ছিলে,’ ডাক্তার বললেন।

চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করলাম, রেস্তোরাঁর দিকে কেন গিয়েছিলাম? মনে পড়েছে। বেশ কয়েকবার বমি করার পর ভাবছিলাম, একটা সি-সিকনেস পিল খাই। কিন্তু খালি পেটে তো আর খাওয়া যাবে না। তাই বিস্কুট আনতে গিয়েছিলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।

ডাক্তার আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আমরা এখন ড্রেক প্যাসেজ পার হচ্ছি। (ড্রেক প্যাসেজ হলো দুটি সমুদ্রের মাঝে সৃষ্ট একটি সরু সমুদ্র। সরু বলেই সেটি বেশি উত্তাল, ঢেউ হয় অনেক উঁচু।) এটিকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে রুক্ষ সমুদ্র। প্যাসেজটির একটি উপাধিও আছে। সেটি হলো কুখ্যাত ড্রেক প্যাসেজ।’ প্যাসেজটা পার হতে আরও ৩০ ঘণ্টা লাগবে।

অ্যান্টার্কটিকায় বাংলাদেশের লাল–সবুজের পাতাকা হাতে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

জাহাজে ওঠার পর প্রতিদিন নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ চলছে। হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ায় দুটি বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারিনি। যে প্রশিক্ষণ দুটিতে উপস্থিত থাকতে পারিনি, পরে আবার সেগুলোর ব্যবস্থা করা হবে। আর সুস্থ হওয়া অবধি একজন ক্রু আমার রুমের আশপাশে থাকবে। ‘আর একটা জরুরি বিষয়। বমি হলেও খেতে হবে। খেলে তোমার পাকস্থলী ব্যস্ত থাকবে আর পাকস্থলী ব্যস্ত থাকলে মস্তিষ্ক সচল থাকবে,’ বললেন ডাক্তার।

আরও পড়ুন
অভিযাত্রীদের অ্যান্টার্কটিকা চুক্তির বিষয়বস্তু বুঝিয়ে বলছেন দলনেতা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

অ্যান্টার্কটিকা যাত্রার আজ দ্বিতীয় দিন। সাতসকালে আমাদের অভিযানের দলনেতা সবাইকে লাউঞ্জে জরুরি তলব করলেন। উপস্থিতি গণনা করার কথা বলা হলেও অভিযাত্রীরা বুঝতে পারলেন, এটি একটি কঠিন বৈঠক হবে। দলনেতা শুরুটাও করেন মজার ছলে, ‘আমাকে বলা হয়ে থাকে এক্সপিডিশন লিডার। কিন্তু আমি মনে করি আমি তোমাদের হাগ (আলিঙ্গন) মাস্টার। তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো।’ দলনেতার কথায় চারদিকে মুহুর্মুহু করতালি।

এরপর তিনি খানিকটা গম্ভীর হলেন। দম নিয়ে বলতে শুরু করলেন অ্যান্টার্কটিকা চুক্তির বিষয়বস্তুর কথা। যার মানে, অভিযানে এমন কিছুই করা যাবে না, যাতে এ অঞ্চলের প্রাণিজগৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পেঙ্গুইন থেকে সদা ১৫ ফুট দূরে অবস্থান করতে হবে। তাদের কোনো রকম খানাখাদ্য খাওয়ানোর চেষ্টা করা যাবে না।

এসব নিয়মনীতি শুনেই দিন শুরু হয়েছিল। আর এখন প্রায় আধা অচেতন হয়ে পাড়ি দিচ্ছি ড্রেক প্যাসেজ।

আরও পড়ুন
পৃথিবীর একেবারে দক্ষিণের শহর আর্জেন্টিনার উসুয়ইয়া
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

পৃথিবীর শেষ শহরে পা

পৃথিবীর একেবারে দক্ষিণের শহর উসুয়ইয়া। আর্জেন্টিনার এই শহর ভ্রমণের স্বপ্ন আমার অনেক দিনের। ভিসা পেতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হলো। ভিসা হাতে পাওয়ার পরই মাথায় আসে, উসুয়ইয়াই যদি যাব, তবে অ্যান্টার্কটিকায় কেন নয়! অ্যান্টার্কটিকায় ভ্রমণ পরিচালনা করা বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করি। সবার প্যাকেজ ছয় থেকে এক বছর আগেই বুকড। একেবারে শেষ মুহূর্তে অপ্রত্যাশিতভাবে একটা সুযোগ আসে আমার কাছে। সাইপ্রাসের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান পসেইডন এক্সপেডিশনসের সেই সুযোগ আমি লুফে নিই। মার্কিন ডলারের বর্তমান বিনিময় মূল্যে প্রায় ১৬ লাখ টাকার প্যাকেজ।

১২ দিনের অভিযান, এর মধ্যে অ্যান্টার্কটিক সার্কেলে প্রবেশ করতেই লাগবে তিন দিন। আর ফিরতে তিন দিন। বাকি দিনগুলো অ্যান্টার্কটিকার নানা সাগর, উপসাগরে থেমে থেমে জাহাজ চলবে। জাহাজ থামলে অভিযাত্রীদের নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এই কার্যক্রমগুলোকে বলা হয় ‘অপারেশন’।

আরও পড়ুন
উসুয়ইয়া বন্দরে এমভি সি স্পিরিট
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে জাহাজে উঠেছি আমরা। এমভি সি স্পিরিট নামের জাহাজে আমরা বিভিন্ন দেশের ১১৪ জন অভিযাত্রী। ক্রু আর অন্যান্য কর্মকর্তা আছেন আরও ৮০ জন। এ অভিযাত্রায় আট-নয় বছর বয়সী দুটি শিশু যেমন আছে, তেমনি অশীতিপর নারী-পুরুষের সংখ্যাও কম নয়।

তবে জাহাজে ওঠার এক দিন আগেই অভিযান শুরু হয়েছে। সেই রাতে সব অভিযাত্রীকে একটি হোটেলে রাখা হয়েছিল। জাহাজের কেবিনে যেভাবে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, ঠিক সেভাবে থাকতে হয়েছে। উসুয়ইয়ার হোটেলকক্ষে প্রবেশ করেই দেখি এক রুশ তরুণী। আমাকে দেখেই সে বলে ওঠে, ‘জাহাজে তবে তুমিই আমার কেবিনসঙ্গী হবে?’

পাতলা ফিনফিনে এই তরুণীর নাম নাসতা। নিজের দেশে সে একটি ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করে। এ অভিযানে ১২ জন রুশ অভিযাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। নাসতার দলের সঙ্গেই আর্জেন্টিনার সর্ব দক্ষিণের বন্দর উসুয়ইয়া থেকে অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে উঠেছি। 

অ্যান্টার্কটিকায় অভিযাত্রীদের বড় জাহাজ থেকে ছোট ছোট নৌকায় করে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

জাহাজ পৌঁছাল অ্যান্টার্কটিকা

উত্তাল সমুদ্রের বেশির ভাগ অভিযাত্রীর জীবন প্রায় যায় যায় দশা। প্রতিদিন দুবার করে আমাকে দেখতে আসেন ডাক্তার। নিয়ম করে দুবার তাঁকে মিথ্যা বলি, ‘সবুজ আপেল খেয়েছি।’ আমার মতো দুর্বল এক প্রাণীকেও তিনি হাত উঁচিয়ে বলেন, ‘ইউ আর আ স্ট্রং লেডি, অ্যান্টার্কটিকা ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।’

একসময় অ্যান্টার্কটিক সার্কেলে প্রবেশ করল জাহাজ। অ্যান্টার্কটিকায় নামার জন্য চারটি দল করা হয়েছে। রিসেপশনে গিয়ে দেখি প্রথম গ্রুপের সবার ওপরে আমার নাম। অর্থাৎ আমি এই অভিযানের প্রথম অভিযাত্রী, যে জাহাজ থেকে নামবে। এটি এমন কোনো বাহাদুরির কিছু নয়। তবু আমার ভীষণ আনন্দ হলো।

সকাল সকাল শুরু হলো অপারেশন। আজ করব হাইকিং। অর্থাৎ অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলার একটি পর্বতে আরোহণ। উদ্দেশ্য পর্বতের ওপর থেকে অ্যান্টার্কটিকার পেনিনসুলার ভিউ দেখা। আমাদের আরোহণের জন্য নির্ধারিত দ্বীপটার নাম কুভারভিল। বড় জাহাজ থেকে ছোট ছোট নৌকায় (এগুলোকে বলে জোডিয়াক) করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো।

প্রথম অপারেশনে গিয়ে হাগ মাস্টারের দক্ষতা, সাহস, একাগ্রতা আমাদের মুগ্ধ করল। অপারেশন থেকে ফিরে আসার সময় অভিযাত্রীদের পায়ে পেঙ্গুইনের মল লেগে ছিল। তিনি ব্রাশ হাতে পরিষ্কার করে দিলেন। আমরা পাহাড় থেকে নেমে আসার পরও অনেক অভিযাত্রীর বুট–জুতা তিনি পরিষ্কার করে দিলেন। এই ভালোবাসায় অভিযাত্রীরা আবেগতাড়িত হলেন। অনেকে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। তখন সত্যিই মনে হলো, তিনি আমাদের হাগ মাস্টার।

অভিযাত্রী দলের সবচেয়ে ছোট মেয়েটিও হিমশীতল পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

হিমশীতল পানিতে ঝাঁপ

অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার একটি মজার অপারেশন হলো হিমশীতল পানিতে ঝাঁপ দেওয়া। অভিযাত্রার ভাষায় একে বলে পোলার প্ল্যাং। আমাদের অভিযাত্রী দলের সবচেয়ে ছোট রুশ মেয়েটি সবাইকে বাকরুদ্ধ করে দিয়ে সত্যি সত্যিই পানিতে ঝাঁপ দিল। এমন এক ব্যতিক্রমী ঢঙে সে পানিতে ঝাঁপ দিল, অভিযানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ক্যামেরাটিও তার মুখমণ্ডল ধারণ করতে পারল না।

অ্যান্টার্কটিকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্পিং
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

তবে আমার কাছে অ্যান্টার্কটিকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অ্যাডভেঞ্চার মনে হয়েছে ক্যাম্পিং। ক্যাম্পিং শব্দটা আমাদের দেশে পর্যটকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় আর পরিচিত। তবে অ্যান্টার্কটিকায় ক্যাম্পিং একেবারেই আলাদা। যা সব অভিযাত্রীর জন্য নয়। মাত্র ১০–১৫ জনের জন্য এটি বরাদ্দ। তাই কাউকে এ সুবিধা নিতে হলে বুকিংয়ের সময় আগেভাগে বলে দিতে হবে।

অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলার মধ্যে একটি পাহাড় খুঁজে বের করা হয়েছে, পাহাড়টির নাম অর্নে হার্বুর। যার সর্বোচ্চ শিখর ময়দানের মতো এবং যে পাহাড়ে বরফের পুরুত্ব অনেক বেশি। যে পাহাড়ে ক্যাম্পিং করা হবে, আমরা সব অভিযাত্রীই হাইক করে তার চূড়ায় উঠেছি। যাঁরা ক্যাম্পিং করবেন, তাঁরা এখানে বরফ খনন করে শরীরের সমান আয়তাকার গর্ত খুঁড়ে নিলেন। অনেকটা কবর তৈরি করার মতো। হাঁটুসমান এ গভীর গর্তে প্রথমে বিছানো হলো একটি ফোম, অনেকটা তোশকের মতো। তারপর দেওয়া হলো গরম কাপড় দিয়ে তৈরি একটি বস্তা। অনেকটা আমাদের দেশের চালের চটের বস্তার মতো। অভিযাত্রী তাঁর সম্পূর্ণ শরীর অর্থাৎ পা থেকে মাথা পর্যন্ত সে বস্তায় ঢুকিয়ে শুয়ে পড়লেন। শ্বাস নেওয়ার জন্য শুধু মুখখানা বাইরে থাকল।

বরফঢাকা পাহাড়ে হাইকিং
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ঘণ্টা দুয়েক তাঁদের সঙ্গে থেকে আমরা জাহাজে ফিরলাম। রয়ে গেলেন শুধু ক্যাম্পাররা। বরফের ঘরেই তাঁদের রাতটা কাটবে।