কলকাতার ৩ ঘণ্টা দূরত্বেই এই সমুদ্রতট

বকখালি সমুদ্রসৈকত
ছবি: লেখক

যাঁরা সমুদ্র ভালোবাসেন, কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ ঘুরতে এলে একদণ্ডের জন্য হলেও দীঘা ঘুরে আসেন তাঁরা। কলকাতার কাছেই এই সমুদ্রসৈকত। দীঘাকে ঘিরে আশপাশে গড়ে উঠেছে আরও কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্র: মন্দারমণি, তাজপুর, শংকরপুর, মোহনা। পূর্ব মেদিনীপুরের এই পর্যটনকেন্দ্রের পাশেই আবার ওডিশার সমুদ্রসৈকত। তালসারি, চন্দনেশ্বর, বিচিত্রপুর, উদয়পুর পর্যটনকেন্দ্র।

পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু আরও একটি সমুদ্র পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। বকখালি। কলকাতার কাছেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুন্দরবন এলাকার সমুদ্রতীরবর্তী এক পর্যটনকেন্দ্র। দীঘার মতো অত জৌলুশ নেই, তবে সমুদ্রতটটা অপূর্ব। জোয়ারের সময় পানি এসে ভাসিয়ে দেয় বিস্তীর্ণ তট। আবার ভাটার সময় নেমে গিয়ে দূরে চলে যায় সমুদ্র। জেগে ওঠে বিরাট সাদা বালুর তট। সূর্যের আলোয় রুপালি রং ছড়ায় তট। ঝিকমিক করে। আর তীরজুড়ে উড়ে বেড়ায় বক।

বকখালি পর্যটনকেন্দ্রটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য আছে। তট ধরে সমুদ্রের দিকে সোজা গেলেই বড় একটি খাল। ভাটার সময় সেই খালে হাঁটুরও কম পানি থাকে আর জোয়ারের সময় কোমরসমান। জোয়ারের সময় এই পানি পেরিয়ে সমুদ্রপাড়ে চলে যান পর্যটকেরা। আর ভাটার সময় জেগে ওঠে বিশাল সাদা বালুতট। তখন একেবারে পায়ে হেঁটেই পার হওয়া যায়। সমুদ্রের ঢেউ দেখেন লোকজন। ডাব খান। চা–কফিও মেলে। আর বসার জন্য মেলে প্লাস্টিকের চেয়ার। ঘণ্টায় ১০ রুপি। সমুদ্রের তীরে চেয়ার নিয়ে পর্যটকদের জন্য বসে থাকেন স্থানীয় নারীরা। জোয়ার–ভাটার তালে তালে কখনো এই চেয়ার তুলে নেওয়া হয় ওপরের দিকে, পানি নেমে গেলে আবার তা নামিয়ে আনা হয় সমুদ্রতীরের কাছে।

বকখালি, কলকাতার কাছেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুন্দরবন এলাকার সমুদ্রতীরবর্তী এক পর্যটনকেন্দ্র
ছবি: লেখক

সন্ধ্যায় বকখালির আবার আরেক চেহারা, কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করে ওঠে সমুদ্রতট। সমুদ্রতীরজুড়ে নানা পসরা নিয়ে বসেন দোকানিরা। মেলে নানা সামুদ্রিক মাছ। হাঙর থেকে অক্টোপাসও। পর্যটকদের চাহিদামতো মাছ কেটে ভেজে দেন দোকানিরা। মেলে ঝালমুড়ি থেকে চা-কফি। অদূরেই সড়কজুড়ে নানা মানের হোটেল–রেস্তোরাঁ। স্বল্প আয়ের মানুষ থেকে বিত্তবান—সবার পকেটের উপযোগী হোটেল-রেস্তোরাঁই আছে। সমুদ্রতটেই মিলছে ঘোড়া-উটে চড়ার সুবিধা। আর নানা চিত্তবিনোদনের সুযোগ। আছে শিশুদের নানা খেলাধুলার ব্যবস্থা। ঝাউবনে ঘেরা সাদা বালুর সমুদ্রতট থেকে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের দৃশ্যও অপূর্ব। এক দিনের সফরের জন্য সত্যিই আদর্শ এক সমুদ্রতট।

সৈকতে লাল কাঁকড়া
ছবি: লেখক

বকখালির আশপাশেই পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য আছে হেনরি দ্বীপ, সাগর দ্বীপ, ফেডারিক দ্বীপ, ফ্রেজারগঞ্জ দ্বীপ। ফ্রেজারগঞ্জ নামকরা মৎস্যবন্দর। এখানে মাছ কেনাবেচা হয়। এখান থেকে মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে সমুদ্রে পাড়ি জমান। ১৯০৩ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর ছিলেন স্যার অ্যান্ড্রু ফ্রেজার। বকখালির সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর নামেই ফ্রেজারগঞ্জ। একসময় এখানে তিনি বাসও করেছেন। তাঁর সেই বাসভবনের ধ্বংসাবশেষ ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।

বকখালিতে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক বনবিবির মন্দির
ছবি: লেখক

বকখালি থেকে ব্যাটারিচালিত স্কুটারে ৪০০ রুপির বিনিময়ে দেখে নেওয়া যায় এসব দর্শনীয় স্থান। ওয়াচ টাওয়ার, হেনরি দ্বীপ, লাঙ্গরগঞ্জ বিচ, বেনফিস হারবার, ফ্রেজারগঞ্জ, কারগিল সি বিচ। এই কারগিল সি বিচের অদূরে জম্বু দ্বীপ, সৌসুন দ্বীপ, নদীপথে লঞ্চে করে যাওয়া যায়।

বকখালিতে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক বনবিবির মন্দির। সমুদ্রতট থেকে ঝাউবনের পাশ ধরে হেঁটে গিয়ে দেখে নেওয়া যায়। টিনের ঘরের মন্দির। এই সমুদ্রতটের আরেক আকর্ষণ লাল কাঁকড়া। বালু ফুঁড়ে ওঠে আর মানুষের পা পড়লেই আবার বালুতে ঢুকে যায়। সে এক অপূর্ব দৃশ্য!

বকখালি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার কাকদ্বীপ মহকুমার নামখানা থানায় অবস্থিত। কলকাতা থেকে ১৩০ কিলোমিটার। কলকাতা থেকে সড়কপথেও যাওয়া যায়। হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী আগে ফেরিতে পার হতে হতো। সেতু হওয়ায় এখন সরাসরিই যাওয়া যায়। ট্রেনযোগে নামখানা হয়েও বকখালি যাওয়া যায়।