এখান থেকে কোথাও যাব না

দার্জিলিং চায়ের নাম। একটা ঘরেরও নাম। মানে রিসোর্টের যে ঘরে লেখক ছিলেন। দার্জিলিংয়ের কাছে ইউল টি রিট্রিট ঘুরে এসে সেই অভিজ্ঞতা জানালেন শর্মিলা বসুঠাকুর

ঘুম থেকে চা বাগান ঘণ্টাখানেকের পথছবি: সহেলি দাস মুখার্জি

বেড়াতে ভালোবাসি। এ এক তীব্র নেশা। আর পাহাড় হলে তো কথাই নেই। বিশেষ করে বর্ষার পাহাড়। ভেজা ভেজা, মেঘলা দিনে এক চরম শুশ্রূষা যেন। বর্ষার পাহাড় দেখতে বেরিয়ে পড়লাম মেঘ মুলুকের দেশের উদ্দেশে, যেখানে মেঘ গাভির মতো চড়ে। উত্তরবঙ্গের চা-বাগান। দুই রাতের ঠিকানা ইউল টি রিট্রিট।

কলকাতা থেকে দার্জিলিং মেলে সোজা নিউ জলপাইগুড়ি, সেখান থেকে গাড়িতে লেপচা জগৎ ছাড়িয়ে এই রিট্রিট। টুং, সনাদা ছাড়িয়ে ঘুম থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ।

ইউল টি রিট্রিট, এখানেই ছিলেন লেখক
ছবি: সহেলি দাস মুখার্জি

উত্তরবঙ্গের নানা অঞ্চলে বারবার আসি। দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়ং এবং এই সব শহর ঘিরে বিভিন্ন ছোট ছোট গ্রাম বহুবার দেখা। তবু আসি। এখানকার মেঘের সঙ্গে বসবাসে বড় আনন্দ। যতই লোকে বলুক, দার্জিলিং নোংরা, ভিড়, আগের মতো আর নেই। আমি বলি, কথাটা মিথ্যা নয়, কিন্তু পাহাড়, নদী, মেঘ, পাইনের বন—সেসব তো একই আছে, শুধু নিজের মনের মতো কোণটুকু খুঁজে নেওয়া, তাহলেই পরম আরাম।

কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার হিড়িক আজ আর আমার নেই। কোনো দিনই তেমন ছিল না। সাইট সিয়িং, সিলেবাস মিলিয়ে টিক মেরে জায়গা দেখে বেড়ানো আমার ধাতে সয় না। তাই তো বেছে নিয়েছি ইউল টি রিট্রিট। ১৮৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই হেরিটেজ প্রোপার্টি আয়াস এবং আন্তরিক আয়োজনের সম্মিলন। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে, ঠান্ডা আবহাওয়ায়, মেঘের চাদর সরাতে সরাতে সেই পুরোনো ভালোবাসাকেই ফিরে পেলাম।

আরাম করে এখানে সময় কেটে যাবে মেঘের ভেলায় ভেসে
ছবি: সহেলি দাস মুখার্জি

ডানে-বাঁয়ে বেটে বেটে ঝোপালো চা-গাছের ধাপ কেটে কেটে পাকদণ্ডী পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছি। পাহাড়ি পথে চা বিরতিতে দুটি জিনিস চেখে দেখা অবশ্যকর্তব্য। তাই গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার ধারের ছোট্ট দোকানে, রঙিন ছাতার তলায় পরমানন্দে খেলাম হালকা আদা-পেঁয়াজের গন্ধমাখা ঝিরিঝিরি করে কাটা স্কোয়াশের পুরভরা মোমো আর ম্যাগি। দিল খুশ।

অবশেষে এসে পৌঁছালাম আমার গন্তব্যে।

সাজানো গোছানো বসার ঘর
ছবি: সহেলি দাস মুখার্জি

চা-বাগানের মধ্যে এই বাংলোতে পৌঁছানোমাত্র স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী উত্তরীয় দিয়ে স্বাগত আপ্যায়ন। ঘুরে ঘুরে দেখলাম ফার্স্ট ফ্লাশ, সেকেন্ড ফ্লাশ, ওলং, মুন ড্রপ, সুসজ্জিত সব ঘর। হ্যাঁ, চায়ের নামে এখানে ঘরের নামকরণ। হবে নাই-বা কেন! ঘরজুড়ে কার্পেট, গা-ডোবানো দুধ সাদা বিছানা, ওয়ার্ডরোব যেখানে যা থাকার কথা, সব মজুত আছে। আভিজাত্য আর আরামের ভাব ভালোবাসা।

এই রিট্রিটের ম্যানেজার সুজিত পাঠক হাসিখুশি ও সদা তৎপর মানুষ। যেকোনো সমস্যার সমাধানে তিনি হাজির। ঠান্ডা আবহাওয়ায় সারা দিন ধরে গলা ভেজাতে পারেন নানা স্বাদের, বরনের, সুবাসের দার্জিলিং চা। আমার মতো চা-প্রেমী মানুষদের জন্য এ আবাস আদর্শ।

শোবার ঘর

আছেন শেফ অক্ষয়। আমুদে মানুষ, হাতে জাদু। তা না হলে টাটকা চা-পাতার পাকোড়া যে গতিতে বানিয়ে ফেললেন! ভোজবাজি! ধোঁয়া ওঠা থুকপা, নিজেদের বাগানের মুচমুচে টাটকা সালাদ, চিকেন রোস্ট কিংবা খিচুড়ি—সবেতেই তিনি সিদ্ধহস্ত। এককথায় এখানে থেকে-খেয়ে বড় সুখ।

কাছেই রঙ্গিত নদী। সারা দিনের জন্য পিকনিক করতে যেতে পারেন পাহাড়ি নদীর কোলে। সব ব্যবস্থা এঁরাই করে দেবেন। এমনকি তাঁবু পর্যন্ত।

পাইন বনের ভেতর দিয়ে মেঘে ঢাকা পথ
ছবি: সহেলি দাস মুখার্জি

দার্জিলিং ঘুরে আসতে চাইলে, একটু শপিং করতে চাইলে গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। তবে আমার মতে, এখানে এসে নিশ্চিন্তে, নিরিবিলিতে দুটি দিন কাটিয়ে যান কিছু না করে। পাখি দেখুন, পাখি চিনতে শিখুন, অজস্র পাখি আসে এই রিট্রিটে। ঝিঁঝি পোকার অর্কেস্ট্রা শুনুন মন দিয়ে, কত যে তার ছন্দ! মেঘেদের আনাগোনা দেখুন আর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করুন দার্জিলিং চায়ের অভিজাত অনুষঙ্গ।

ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম, মেঘ মুলুকের দেশের প্রতি আমার নিঃশর্ত ভালোবাসা আজও অমলিন। ফিরে আসব আবার এই মেঘের দেশে। শিগগিরই।