যে বাজারে রাস্তাই আছে ৬০টি আর দোকান ৪ হাজার

গ্র্যান্ড বাজারে ৬০টির মতো রাস্তা রয়েছে, যার মধ্যে দোকান আছে প্রায় ৪ হাজার
ছবি: লেখক

সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে হোটেলেই নাশতা সেরে বের হলাম। গন্তব্য ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ড বাজার। এটি বিশ্বের অন্যতম বড় ও পুরোনো বাজার। গ্র্যান্ড বাজার তুর্কি ভাষায় ‘কাপালিকারসি’ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়দের কাছে এটি শুধু বাজার নয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের শাসনামলে কনস্ট্যান্টিনোপলে উসমানীয় বিজয়ের পরপরই ১৪৫৫ সালে এর ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল। মূলত শহরের বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিন্তা করে বাজারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই বাজারে ৬০টির মতো রাস্তা রয়েছে, যার মধ্যে দোকান আছে প্রায় ৪ হাজার।

টার্কিশ সিরামিকে ভরা দোকানপাট
ছবি: লেখক

বাজারের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী বিক্রি হয়। টার্কিশ মসলা, চামড়ার তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী, টার্কিশ ডিলাইট (মিষ্টিজাতীয় খাবার), ঝাড়বাতি, সিরামিক থেকে শুরু করে স্থানীয় নকশার আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক—কী নেই। প্রায় সব দোকানেই বেড়াতে আসা লোকজনের ভিড়। চলছে ক্রেতা-বিক্রেতার দর-কষাকষি। দেখে বুঝলাম বেচা-বিক্রি এখানে বেশ ভালো। আমি সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি এখানকার ঝাড়বাতির দোকানগুলো দেখে। এত সুন্দর করে সাজানো, শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে। এখানে আপ্যায়নে চা খাওয়ার বেশ চল। চায়ের কাপ নিয়ে বিক্রেতাদের বিভিন্ন দোকানে ছোটাছুটি দেখলেই সেটা বোঝা যায়। আমাদেরও এক দোকানি চা খাওয়ালেন।

নানা রকম ঝাড়বাতির দেখা মেলে এই বাজারে
ছবি: লেখক

বাজারের সবচেয়ে পুরোনো অংশের নাম সেভাহির বেদেস্টেনি। এখানে মূলত দামি ও প্রাচীন অ্যান্টিক জিনিসপত্র কেনাবেচা হয়। এই অংশের দেয়াল বেশ পুরু, ঢোকার জন্য আলাদা গেট আছে। এটি একসময় বাজারের কোষাগার ও ধনী ব্যবসায়ীদের মূল্যবান জিনিসপত্র রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো। এখানে উসমানীয় আমলের বেশ কিছু পুরোনো পয়সা ও নোট দেখলাম। দাম বেশ চড়া না হলে সংরক্ষণের জন্য কেনা যেত দু-একটা।

আরও পড়ুন

গ্র্যান্ড বাজারের প্রতিটি কোণ যেন একেকটি গল্প। পুরোনো দোকানগুলো হাতে আঁকা প্রাচীন টাইলস দিয়ে সাজানো। দেয়ালে মেরুন আর হলুদ রং। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে পানি খাওয়ার জন্য পুরোনো পানির কল, নামাজের জন্য মসজিদ আর খাবারের দোকান। সব দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক বাজারই বটে।

বেশ হাঁটাহাঁটির পর বাজারের একটি ক্যাফেতে বসলাম। টার্কিশ কফি আর বাকলাভা অর্ডার করলাম। এখানকার কফিতে সাধারণত দুধ বা চিনি দেওয়া হয় না, খেতেও বেশ কড়া। আমরা যেহেতু বিদেশি, তাই আমাদের আলাদা করে চিনি দিল। এখানকার বাকলাভা বেশ নামকরা, তাই সেটা আগ্রহ নিয়ে অর্ডার করেছিলাম। টেবিলে আসার পর বুঝলাম কেন সেটা এত জনপ্রিয়। পরিমিত মিষ্টি খাবারটি এখানে এলেই নতুনভাবে আবিষ্কার করবেন যে কেউ। ক্যাফেতে খেতে বসে জিরিয়ে নেওয়া ছাড়াও বাজারে চলাচল করা মানুষের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল।

গালাটা টাওয়ারটি তৈরি হয়েছে ১৪ শতকে
ছবি: লেখক

গ্র্যান্ড বাজার থেকে বের হয়ে ট্রামে চড়ে বসলাম, এবার যাব গালাটা টাওয়ার। কারাকোয় স্টেশনে নেমে প্রায় ১৫ মিনিট হেঁটে গালাটা টাওয়ারে পৌঁছালাম। এই এলাকা পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা। চারপাশের বাড়িগুলো খুব সুন্দর করে সাজানো। এই টাওয়ারটি তৈরি হয়েছে ১৪ শতকে, জেনোইস (জেনোয়া) উপনিবেশের আমলে। একসময় এটি ছিল ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা। যা জেলখানা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আমরা টিকিট কেটে ওপরে উঠলাম। এখন থেকে পুরো ইস্তাম্বুল দেখা যায়। টাওয়ারটার ব্যাপারে একটা গল্প চালু আছে, ১৭ শতকে হেজারফেন নামের এক ব্যক্তি তাঁর শরীরে পাখির মতো ডানা লাগিয়ে গালাটা টাওয়ার থেকে বসফরাস পেরিয়ে উসকুদার এলাকায় উড়ে গিয়েছিলেন, যা ইতিহাসের প্রাচীনতম রেকর্ড করা ফ্লাইটগুলোর একটি। তবে কেউ কেউ বলেন, সে আসলে পুরো বসফরাস পার হতে পারেননি।

আরও পড়ুন
টার্কিশ কাবাবের সুনাম আছে পৃথিবীজুড়ে
ছবি: লেখক

গালাটা থেকে বের হয়ে দুপুরের খাবারের সন্ধানে নেমে পড়া গেল। ইস্তাম্বুলের ব্যাপারে আমার একটা পর্যবেক্ষণ হলো, যেখানেই খেয়েছি, খাবার ভালো লেগেছে। ঠিক জানি না কাবাব খুব পছন্দ বলেও এমনটা মনে হতে পারে। তবে এটাও তো সত্য এ দেশের কাবাব পৃথিবী বিখ্যাত। কিছুটা হেঁটেই একটা কাবাবের দোকান পেয়ে গেলাম। এখানে ওরা কেগ কাবাব বিক্রি করে। এটা ডোনার কাবাবের মতোই কিন্তু কাবাবের স্ট্যান্ডটা অনুভূমিক। সেখান থেকে ছোট শিকে করে কাবাব নিয়ে কয়লার মধ্যে ঝলসে পরিবেশন করা হচ্ছে। কাবাবের সঙ্গে থাকে যত খুশি রুটি আর সালাদের ব্যবস্থা। কাবার-রুটির পর চা দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম। এবার যাব ইস্তাম্বুলের রোমান ইতিহাসের অংশ বাসিলিকা সিস্টার্ন দেখতে।

বহু কলাম দিয়ে তৈরি জলাধারটি দেখার মতো একটি জিনিস
ছবি: লেখক

ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক স্থানগুলোর একটি বাসিলিকা সিস্টার্ন। এখানকার মাটির নিচের জলাধারটি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের উন্নত প্রকৌশল প্রযুক্তির প্রমাণ হিসেবে টিকে আছে। এই জলাধারটি সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের শাসনামলে ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত। কনস্ট্যান্টিনোপল শহরে ব্যবহারের পানি সংরক্ষণ করার জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল, যাতে শহর কোনো কারণে পানির সংকট তৈরি না হয়। ড্যান ব্রাউনের দা ভিঞ্চি কোড বইতে এই জলাধারের বর্ণনা পড়েছিলাম। তাই সামনাসামনি দেখার বেশ আগ্রহ ছিল। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। দর্শনার্থীদের দেখার জন্য সিঁড়ি তৈরি করা আছে, যা দিয়ে নিচে নেমে মোটামুটি হতবাক হয়ে গেলাম। বহু কলাম দিয়ে তৈরি জলাধারটি দেখার মতো একটি জিনিস।

মেডুসার মাথা-সংবলিত কলাম
ছবি: লেখক

প্রায় ১ হাজার ৪০০ বছর আগে তৈরি, এখনো কী দারুণভাবে টিকে আছে। জলাধারের উত্তর-পশ্চিম কোণে মেডুসার মাথা-সংবলিত দুটি কলাম। এই মাথাগুলো এভাবে কেন বসানো, তার কোনো বিশেষ ব্যাখ্যা পেলাম না। গ্রিক পুরাণে আছে মেডুসার দিকে কেউ তাকালে সে পাথর হয়ে যায়, তাই হয়তো এই ব্যবস্থা। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, এখনো এখানে যে সামান্য পানি আছে, অনেকে তাতে পয়সা ফেলছে। পয়সাগুলোয় আলো পড়লে মনে হবে কোনো গুপ্তধন লুকানো আছে। আবার মাঝেমধ্যে প্রজেক্টর দিয়ে গ্রিক পুরাণের গল্পের অংশ দেখানো হচ্ছে। বিস্ময় আর ঘোর নিয়েই একসময় বের হয়ে হোটেলের দিকে রওনা হলাম।

আরও পড়ুন