জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছে নেপালের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো

নভেম্বরের শীতের সকাল। মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষ হয়ে গেলেও হিমালয়ের দেশ নেপালে শীত জেঁকে বসেনি। সকালের দিকে কিছুটা হিমেল বাতাস গায়ে পড়ে জানান দিচ্ছে, শীত আসছে। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে প্রায় সাড়ে ছয় শ কিলোমিটার দূরে ধানগড়ি জেলা। ভারতের সীমান্তঘেঁষা এই জেলারই গ্রাম ফাকালপুর। অঞ্চলটি কৃষিনির্ভর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সকালে কিছুটা ঠান্ডা থাকলেও দিনের বাকিটা সময় তাপমাত্রা স্বাভাবিক। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফাকালপুর গ্রামের সবাই জমিতে চলে যান। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের পেশা কৃষিকাজ। নারী-পুরুষ সবাই মিলে জমিতে ফসল ফলান।

হিমালয়ের দেশ নেপাল
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

নেপালের জলবায়ু সমস্যা নিয়ে কাজ করছে সিমুড (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট)। প্রতিষ্ঠানটি জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যেও কীভাবে প্রত্যাশামতো ফসল উৎপাদন করতে হবে, সে বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করে। এলাকার মানুষকে সিমুড ব্যতিক্রমী ফসল উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সার্কভুক্ত দেশগুলো থেকে ১৭ সাংবাদিকদের নিয়ে ১১ দিনের একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করে সিমুড।

সার্কভুক্ত দেশগুলো থেকে ১৭ সাংবাদিকদের নিয়ে ১১ দিনের আয়োজনে সিমুড
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ থেকে তিন সাংবাদিক সেখানে অংশ নেন। আমি একজন আলোকচিত্রী হিসেবে অংশগ্রহণ করি। প্রশিক্ষণটি হয় নেপালের কাঠমান্ডুর লালিতপুরে সিমুডের হেড অফিসে। সেখান থেকে ১৭ জনের দলকে চার ভাগ করে নেপালের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। সে অনুযায়ী আমি ৫ নভেম্বরে ১২ জনের দলে নেপালের পশ্চিমে ধানগড়িতে যাই। আমার দলে ভুটান, চীন ও ভারত থেকে আসা বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করা সাংবাদিকেরা ছিলেন।

বদলে যাওয়া নেপালের গ্রাম ও জীবনব্যবস্থা

৬ নভেম্বর ভোরে আমরা ফাকালপুর গ্রামে যাই। সেখানে বেশির ভাগ মানুষ থারু সম্প্রদায়ের। তাঁরা কৃষিজীবী, সমাজ নারীপ্রধান। সকাল সকাল নারী-পুরুষ সবাই মিলে জমিতে কাজ শুরু করেন। ৪৫ বছর বয়সী জুলি চৌধুরী তেমনই একজন। তিনিও পরিবার নিয়ে জমিতে কাজ শুরু করেন সকাল সকাল। তিনি জানান, ‘আমাদের গ্রামের জমিতে আগে অনেক ফসল হতো, বিশেষ করে আমরা ধান চাষ করতাম। পাশাপাশি অন্যান্য সবজিও উৎপাদন করতাম। ধান চাষের পর আমাদের জমিতে বাঁধাকপি, ফুলকপি, শাক ও বেগুন চাষ করতাম। জমিতে লাগানো ধান ও সবজি নিজেদের খাবারের জন্য রেখে বিক্রি করতাম।’

বাড়ির উঠোনে থারু সম্প্রদায়ের নারীরা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কিন্তু এখন নেপালের জমিগুলোতে আগের মতো ধানের আবাদ হয় না। কারণ, পর্যাপ্ত পানি নেই। মাটি আর আগের মতো নেই। তাই কৃষকেরা ধানের পরিবর্তে মৌসুমি সবজি উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছেন। জুলি চৌধুরীর মতো অনেক নারী কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তাঁরা সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে জানেন না। তবে এর প্রভাবে বেঁচে থাকার আলাদা কৌশলে ফসল উৎপাদন করছেন নেপালের কৃষকেরা।

নারী পুরুষ মিলে করেন কৃষিকাজ
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই মাটির ঘর। কারও কারও পাকা দোতলা বাড়ি থাকলেও এক কোণে মাটির ঘর। মাটির ঘরে সাধারণত ফসল সংরক্ষণ করে রাখা হয়। গ্রামের ছোট-বড় সব বয়সী নারীরাই পুরুষের পাশাপাশি ফসলের খেতে কাজ করেন। নিজের উৎপাদিত সবজি নারীরা সাইকেল চালিয়ে হাটে বিক্রি করতে নিয়ে যান।

ফাকালপুরে সপ্তাহে প্রতি মঙ্গল ও শুক্রবার বাজার বসে। সারা দিন কাজ শেষ করে গ্রামের মানুষ সন্ধ্যার দিকে হাটে যান। এ ছাড়া অনেকে তাঁদের জমিতে উৎপাদিত সবজি সকালে সাইকেলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফেরি করে বিক্রি করেন। নেপালের গ্রামের নারীরা মাছ ধরার কাজ করেন। মাছ এখন আর আগের মতো পান না। তবে এখনো যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যাচ্ছে, সেটাও মন্দ নয়। গ্রামবাসীর কাছে শামুক, কাঁকড়া মাছের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। গ্রামের পুকুরগুলোতে মাছ চাষ করেন তাঁরা।

থারু নারীরা ব্যবহার করেন নানা ধরনের অলংকার
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব


জলবায়ু পরিবর্তন নেপালের এক আলোচিত বিষয়। এর ফলে দেশটি খাদ্যসংকটের মুখে রয়েছে। কারণ, দেশটিতে ক্রমাগত খরা ও হিমবাহ গলার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ফলে দেশটির লাখো মানুষ হুমকির মুখে পড়ে গেছেন। অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য এ দেশটি পর্যটন ও কৃষির ওপর বিপুল পরিমাণে নির্ভরশীল। আবহাওয়া পরিবর্তন এখন এই দুটি খাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা শুরু করেছে। আবহাওয়ার পরিবর্তন নেপালে খাদ্যশস্য উৎপাদনের ওপর নাটকীয় প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে কৃষকেরা নিজেদের খাওয়ার মতো খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে পারছেন না এবং ঋণের ভারে জর্জরিত হচ্ছেন।

নেপালের নারীরা এখন মৌসুমি ফসল, শাক–সবজি উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছেন
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

নেপালের জলবায়ু সমস্যা নিয়ে ৪০ বছর ধরে কাজ করছে সিমুড। প্রতিষ্ঠানটি জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে কীভাবে ফসল উৎপাদন করতে হবে, সে বিষয়ে ধারণা দিচ্ছে। এলাকার মানুষকে সিমুড ব্যতিক্রমী ফসল উৎপাদনে সাহায্য করতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ প্রশিক্ষণ পেয়ে কম পানি ব্যবহার করে এলাকার অনেকেই মৌসুমি সবজি চাষ করছেন, ফলনও হচ্ছে ভালো। ফলে কৃষকেরা নিজেদের খাবারের জন্য ফসল রেখে ও বিক্রি করে ভালো টাকা আয় করছেন।

জন্মহার কমিয়ে শিশুদের শিক্ষিত করার দিকে নজর


নেপালের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আরও একটি বড় পরিবর্তন হয়েছে। কিষানি হীরা দেবী চৌধুরী জানান, অনেকেই আগের মতো সন্তান নিচ্ছেন না। কারণ হিসেবে ৩৫ বছর বয়সী ওই নারী বলেন, ‘যত বেশি সন্তান, তত বেশি খরচ। আগে আমাদের এলাকার প্রতিটি পরিবারে অনেক সন্তান ছিল। কিন্তু এখন বেশির ভাগই সেই দুঃসাহস দেখাচ্ছেন না। তবে কৃষক পরিবারের সবাই সন্তানকে শিক্ষিত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। গ্রামের মানুষের মধ্যে একটি ধারণা জন্ম নিয়েছে যে সন্তানকে কৃষক না বানিয়ে শিক্ষিত করলে খাবারের অভাব হবে না।’

নারীরা এখন সন্তান জন্মদানের চেয়ে সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলার দিকে অধিক মনোযোগী
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

জলবায়ুর ক্ষতি কমাতে পদক্ষেপ

নেপালের চেয়েও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে আছে বেশি। সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা ইত্যাদি সবগুলো দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও বেড়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে কাজ করছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। গ্রিন রেজিলিয়েন্ট অ্যাগ্রিকালচারাল প্রোডাক্টিভ ইকোসিস্টেম প্রকল্প নেপালে জলবায়ু খাতে কাজ করছে।

প্রতিষ্ঠানটি জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে কীভাবে ফসল ফলানো যায়, সে সম্পর্কে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গবেষণার সঙ্গে কৃষকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। প্রকল্পের সহযোগী অংশীদার স্থানীয় লোকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। প্রশিক্ষণ নিয়ে রামারাধা পাল বাড়ির পাশের কৃষিজমিতে সবজি চাষ করে নিজেকে আর্থিকভাবে আরও একটু ভালো রাখার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘সিমুড থেকে কীভাবে সবচেয়ে কম পানি ও টাকা খরচ করে সবজি চাষ করতে পারি, সেটা শিখেছি।’