নাদিরের সঙ্গে এভাবেই তো দেখা হবে

ভ্রমণপিপাসুরা তাঁকে ‘নাদির অন দ্য গো’ নামেই চেনে বেশি। শুরুটা করেছিলেন শখের বশে। এখন পুরোদস্তুর পেশাদার ট্রাভেল ব্লগার। তাঁর ভিডিওগুলোর লাখ লাখ ভিউ। মালদ্বীপ থেকে ঢাকায় ফেরার সময় বিমানে বসেই নাদির নিবরাসের গল্প শুনলেন হাসান ইমাম

নাদির নিবরাস
ছবি: সংগৃহীত

বোর্ডিং শেষ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেলেনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়ব। এমন সময় পাশে তাকিয়ে দেখি, নাদির নিবরাস। পুরো নাম না বলে ‘নাদির অন দ্য গো’ বললেই বরং চেনা সহজ! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ভ্রমণের ভিডিও দেখেননি, এমন বাঙালি নেটিজেন খুব কমই মিলবে। কুশল বিনিময়ের পর জানলাম, একই ফ্লাইটে ফিরব আমরা। নাদিরের সঙ্গে কথায় কথায় সাংবাদিকতাটাও সেরে ফেললাম। মানে ঢাকায় ফিরে সাক্ষাৎকারের জন্য সময় চাইলাম। কিন্তু তাঁর ঢাকার দিনগুলো যে ব্যস্ততায় মধ্যে কাটবে, সেই আভাস দিলেন। অগত্যা বিমানেই শুরু হলো সাক্ষাৎকারপর্ব। আকাশে ভাসতে ভাসতেই জমে উঠল আলাপ! 

আরও পড়ুন
পরিবারের সঙ্গে নাদির
ছবি: সংগৃহীত

উত্তরের হাওয়া

নাদিরের জন্ম দিনাজপুরে। তাঁর দন্তচিকিৎসক বাবা এ কে এম ফজলুল করিমের সরকারি চাকরি। চাকরির সুবাদে উত্তরের জেলায় জেলায় কেটেছে নাদিরের ছোটবেলা। ২০০০ সালের পর পরিবারের সঙ্গে  চলে আসেন ঢাকা। একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে ও এবং এ-লেভেল। ২০১০ সালে স্নাতক করতে যান যুক্তরাষ্ট্র। পড়াশোনার অবসরে খুঁজতেন বেড়ানোর অবকাশ। ভ্রমণের লোভে নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতেন। নাদির বলে যান, ‘গবেষণাধর্মী কাজ করতাম। আমার সুপারভাইজার ছিলেন খুবই বন্ধুবৎসল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজেও যেমন কয়েক সপ্তাহের ছুটি নিতেন, আমাকেও নিতে উৎসাহ দিতেন। তাই ঘোরাফেরাটা চলতে থাকল।’

ভ্রমণের এই নেশাটা পরিবার থেকে পেয়েছেন নাদির, ‘ছোটবেলা থেকেই প্রায় প্রতিবছর একবার দেশের বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতেন মা-বাবা। আর দেশের মধ্যে তো দুই মাস পরপরই কোথাও না কোথাও যেতাম আমরা।’

যন্ত্রকৌশলে স্নাতক করেছেন নাদির। এরপর বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি শুরু করেন। পিএইচডির মধ্যেই একটা মাস্টার্স করেন ডেটা সায়েন্স অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। এই সময় ডেটা সায়েন্স নিয়ে যেমন নানা রকম জার্নাল পড়তেন, লিখতেনও ডেটা সায়েন্স ম্যাগাজিনে। ছয়-সাত মাস আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পিএইচডিটা আর করবেন না। এখন শুধু ভ্রমণেই মনোযোগ দেবেন।

আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় নাদির
ছবি: সংগৃহীত

ইউটিউবার হয়ে ওঠা

ভ্রমণের নেশা থেকেই এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে চলেছেন বাংলাদেশি এই তরুণ। অথচ তিনি যে পুরোদস্তুর ট্রাভেল ব্লগার হবেন, সেটা কখনো ভাবেননি। ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর ‘নাদির অন দ্য গো’ নামে ইউটিউবে চ্যানেল খুলে প্রথম ভিডিও আপলোড করেন নাদির। সেটা ছিল নিতান্তই নিজের জন্য। পরিবার ও বন্ধুদের নতুন জায়গা দেখানোও ছিল সেসব ভিডিও আপলোডের আরেকটি উদ্দেশ্য। নাদির বলেন, ‘দুই বছরে ২৫টা ভিডিও আপলোড করেছিলাম। তখন আমার চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ছিল মাত্র ১০০ জন। তা–ও পরিচিতজনেরা। পরের দুই বছরে সেই সংখ্যা পৌঁছায় ২০০ জনে।’

২০২০ সালে করোনার ঘরবন্দী দিনগুলোতে বাসায় বসে বসে ভ্রমণের ভিডিওগুলো দেখতেন নাদির। একসময় নিজের পুরোনো একটি ইংরেজি ভ্লগ দেখে বাংলায় একটি ভ্লগ বানালেন। আপলোড করতেই হু হু করে বাড়তে থাকল ভিউ। রীতিমতো ভাইরাল হয়ে গেল নাদিরের প্রথম বাংলা কনটেন্ট ‘বাংলাদেশ পাসপোর্টে ৪৮ দেশে ভিসা-ফ্রি ভ্রমণ’। ইউটিউবে ২০ লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে এই ভিডিও। ফেসবুকে নাদিরের পেজে দেখা হয়েছে আরও বেশিবার। এরপরই মূলত ভ্রমণ ভিডিও বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন নাদির। বেরিয়ে পড়েন বিশ্বের নানা প্রান্তে। কখনো আমাজনের গহিন বনে, তো কখনো হাওয়াইয়ের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায়। আজ একগাদা জ্যান্ত সাপ হাতে তো কাল হাঙরের সঙ্গে। এসব ভিডিও তিনি আপলোড করেন তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে। বাংলা ও ইংরেজিতে ভিডিও প্রকাশের জন্য নাদিরের আছে একাধিক চ্যানেল।

আরও পড়ুন
মালদ্বীপের বিমানবন্দরে নাদির নিবরাসের সঙ্গে হঠাৎ দেখা
ছবি: সুমন ইউসুফ

 ঘোরা আর পড়ার চক্করে এ দেশ থেকে সে দেশ

একেকটি দেশ ঘুরে যখন ভিডিও বানান, গল্পচ্ছলে সেখানকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে আনেন নাদির। আর সেটা করার জন্য পড়তে হয় অনেক, ‘কোনো একটি জায়গায় যাওয়ার আগে সেখানকার ওপর নানা রকম বই পড়ি। আর এই পড়াশোনার কারণেই ভিডিওতে যোগ করতে পারি বাড়তি অনেক গল্প।’ এসব তথ্যের কারণেই নাদিরের ভ্লগ আপলোড হওয়ার পরপরই লাখ লাখ দর্শক দেখতে থাকেন। আর সেই জনপ্রিয়তার সুবাদেই সম্প্রতি সেরা ট্রাভেল ব্লগ বিভাগে নাদির পেয়েছেন ব্লেন্ডারস চয়েস-দ্য ডেইলি স্টার ওটিটি অ্যান্ড ডিজিটাল কনটেন্ট অ্যাওয়ার্ড ২০২১।

বিমানে নাদিরের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখনো তাঁর কোলের ওপর মালদ্বীপবিষয়ক একটা ডিজিটাল বই খোলা। মালদ্বীপ আসার আগে পড়াশোনার সময় পেয়েছিলেন খুব কম। ফেরার পথে পড়ে তাই পুষিয়ে নিচ্ছেন। পরিবারের সঙ্গে মালদ্বীপ ভ্রমণে গিয়েছিলেন নাদির। তবে বাকিরা আগেই ফিরে এসেছে। একা বাড়তি কয়েক দিন কাটিয়ে ১৩ ডিসেম্বর ঢাকা ফেরার বিমানে বসে সেসবও জানা হলো। তবে নাদির যে ওই সময়ে মালদ্বীপে আছেন, সেটা বন্ধুদের সুবাদে আগেই জানতাম। নাদির কখন কোথায় থাকেন, সেটা তাঁর ইনস্টাগ্রাম ফলোয়াররাই জানেন। কারণ, রিয়েল টাইম আপডেট শুধু সেখানেই থাকে। 

একা হাতেই সবদিক

এই যে একেক জায়গা ঘোরা, সেটার ভিডিও ধারণ, স্ক্রিপ্ট, সম্পাদনা, আপলোড সবই কি নিজে করেন? নাদির বলেন, ‘হ্যাঁ। তবে মাঝেমধ্যে সাবটাইটেল ও থাম্বনেইল বানাতে কারও কারও সাহায্য নিই।’ কোনো একটা জায়গা ঘুরতে গেলে নাদির সেখানে অনেক দিন থাকার চেষ্টা করেন। কোথাও গিয়ে এক মাস তো কোথাও তিন মাস। তবে এবার মালদ্বীপ গিয়ে সপ্তাহ পার করেই ফিরে এসেছেন। কেন? ‘আমি সাধারণত বাজেট ট্রিপ দিই। কিন্তু এই দেশটা অনেক ব্যয়বহুল। তাই বেশি দিন থাকতে পারলাম না।’

দেশে থাকবেন কদ্দিন? বললেন, ‘বলা কঠিন। হয়তো দুই দিন পরেই বেরিয়ে পড়ব। হয়তো অন্য কোনো দেশে আবার আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।’