সেন্ট মার্টিন থেকে সরানো হলো ৫০ মণ বর্জ্য

আন্তর্জাতিক সমুদ্র উপকূল পরিচ্ছন্নতা অভিযান উপলক্ষে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে প্রায় ৫০ মণ বর্জ্য সংগ্রহ করে এনেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। কেওক্রাডং বাংলাদেশের এ পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিতে সহায়তা করেছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড। অভিযানে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা লিখেছেন সাজিদ হোসেন

সংগৃহীত আবর্জনার বস্তাসহ স্বেচ্ছাসেবীদের একাংশছবি: সাজিদ হোসেন

সেন্ট মার্টিনের জেটিঘাটে জাহাজ ভিড়তেই প্লাস্টিক পোড়ানোর গন্ধ নাকে এল। জাহাজ থেকে নামার মুহূর্তেই দেখি, পাশের একটি ভাগাড়ে আবর্জনা পোড়ানো হচ্ছে। ঢাকা থেকে দ্বীপের পথে রওনা হয়ে মনে আশা জেগেছিল—দীর্ঘ সময় ধরে পর্যটকদের আনাগোনা না থাকা দ্বীপটি এবার হয়তো পরিচ্ছন্ন দেখতে পাব। কিন্তু শুরুতেই ভুল ভাঙল উৎকট গন্ধে। সঙ্গে সঙ্গে মনটাই যেন ভার হয়ে গেল।

আন্তর্জাতিক সমুদ্র উপকূল পরিচ্ছন্নতা একটি বৈশ্বিক অভিযান। এ অভিযানের অংশ হিসেবে ‘কেওক্রাডং বাংলাদেশ’ দেড় দশক ধরে সেন্ট মার্টিনে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে আসছে। দলটির সঙ্গে বহু বছর ধরে আমিও কর্মসূচিতে আসছি। এবারও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির সদস্যদের সঙ্গে ৪ ডিসেম্বর সেন্ট মার্টিনে পৌঁছাই। কক্সবাজার থেকে আমাদের সঙ্গে আরও আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ১২ জন সার্ফার ও ইউনিলিভার বাংলাদেশের ২ জন কর্মকর্তা। দুই বছর ধরে কেওক্রাডং বাংলাদেশের এ বার্ষিক কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় নিত্যব্যবহার্য ও ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) উৎপাদন ও বিপণনকারী বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড।

৫৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী অংশ নেন পরিচ্ছন্নতা অভিযানে
ছবি: ইউনিলিভার বাংলাদেশ

দ্বীপের একটি রিসোর্টে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে ব্যাগপত্তর রেখেই ক্যামেরা হাতে দ্বীপটা চক্কর দিলাম। সৈকতে গিয়ে পড়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা, প্লাস্টিক পণ্যের ছবি তুলতে তুলতে আবারও কালো ধোঁয়া দেখতে পেলাম। এগিয়ে গিয়ে দেখি, নৌকায় আলকাতরা গলানোর জন্য টায়ার পুড়িয়ে তাপ দেওয়া হচ্ছে। আর এদিকে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে দ্বীপের আকাশে।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শুরু হলো কর্মসূচিতে আগত স্বেচ্ছাসেবক ও অতিথিদের পরিচয় পর্ব। এই পর্বে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রাণপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেই সঙ্গে ৫ ডিসেম্বর সকালে স্থানীয় স্কুলশিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলে কখন কীভাবে পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়।

সকাল হতেই শুরু অভিযান

সকাল হতেই সবাই প্রস্তুত। সাতটা বাজতেই কেওক্রাডং বাংলাদেশের সদস্যদের সঙ্গে সারি ধরে সেন্ট মার্টিন বিএন ইসলামিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে হাজির হই। সেখানেই অপেক্ষা করছিল শত শত শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা ছাড়াও স্থানীয় কিশোরেরাও এসেছিল। সবাইকে টি-শার্ট ও ক্যাপ পরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আবার সারি ধরে হাজির হই সৈকতে। দলগত ছবি তোলার পর প্রায় ৩৫টি দল গঠন করে দেওয়া হলো। প্রতিটি দলের দলনেতার হাতে দেওয়া হলো চটের বস্তা। এরপর হাতে গ্লাভস পরে ৫৩০ স্বেচ্ছাসেবী নেমে পড়ল পরিচ্ছন্নতা অভিযানে।

দলগুলো সেন্ট মার্টিনের বিভিন্ন জায়গায় আবর্জনা টুকাতে থাকল। সঙ্গে রাখা চটের বস্তা ভরে গেলে আবর্জনা এনে রাখছিল সৈকতের বিভিন্ন জায়গা রাখা বড় বস্তায়। বেলা তিনটা পর্যন্ত চলল আবর্জনা সংগ্রহ। এরপর বড় বস্তাগুলো তুলে আনা হলো জেটিঘাটের কাছে। সেখানে বাছাই করা হলো আলাদা আলাদা আবর্জনা। পাওয়া গেল চিপস, বিস্কুট, চানাচুরসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের প্যাকেট ও মোড়ক, প্লাস্টিকের বোতল ও ঢাকনা, প্লাস্টিকের ব্যাগ, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক সামগ্রী, মাছ ধরার পরিত্যক্ত জালের মতো বর্জ্য। ওজন দাঁড়াল ১ হাজার ৮৫০ কেজি বা প্রায় ৫০ মণ বর্জ্য। পরে এসব বর্জ্য বস্তায় বস্তায় ভরে টেকনাফে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হলো।

সৈকতে পড়ে থাকা আবর্জনা তুলছেন দুজন।
ছবি: সাজিদ হোসেন

ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপস অ্যান্ড কমিউনিকেশনসের পরিচালক শামিমা আক্তার বলেন, ‘নিরাপদ ও উচ্চমানের পণ্য ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে প্লাস্টিক প্যাকেজিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এর পরিবেশগত প্রভাব কমাতে নকশা, ভার্জিন প্লাস্টিক ব্যবহার হ্রাস এবং পুনর্ব্যবহৃত উপকরণের ব্যবহার বাড়ানো অপরিহার্য। ইউনিলিভার বাংলাদেশে বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে মিলে বাজারে যত প্লাস্টিক দিচ্ছে, তার চেয়ে বেশি প্লাস্টিক পরিবেশ থেকে অপসারণে কাজ করছে। একই সঙ্গে এমন ব্যবস্থাও গড়ে তুলছে, যা সঠিক উপায়ে সংগ্রহ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকর করে তোলে। সেন্ট মার্টিনে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপে আমাদের অংশগ্রহণ এ প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন।’

লক্ষ্য সচেতন করা

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওশান কনসারভেন্সির দেশি সমন্বয়কারী হিসেবে কেওক্রাডং বাংলাদেশ পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বৈশ্বিক মেরিন ডেব্রির তথ্যভান্ডারে যোগ করা হয় কতটুকু ও কী কী ধরনের বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়, এ তথ্যও। তাদের এ কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য সচেতনতা তৈরি করা। নভেম্বর থেকে যাতায়াতের কথা থাকলেও এ বছর সেন্ট মার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ যায় ১ ডিসেম্বর। পর্যটন মৌসুমের শুরুতেই এ পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম স্থানীয় বাসিন্দাসহ পর্যটকদের মধ্যেও সচেতন বাড়িয়েছে। কেওক্রাডং বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবকেরা দর্শনার্থীদের দায়িত্বশীল আচরণে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক সেশন ও কমিউনিটি কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।

কেওক্রাডং বাংলাদেশের সমন্বয়কারী মুনতাসির মামুন বলেন, ‘এ পরিচ্ছন্নতা অভিযানের মূল বিষয় হলো নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি। ১২ হাজার মানুষের সেন্ট মার্টিনে হাজার হাজার পর্যটক যাবেন, এতে সমস্যা নেই। সমস্যা হলো এত মানুষের আবর্জনা কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে পরিষ্কার রাখা অসম্ভব। বিগত বছরগুলোতে এ দ্বীপ থেকে আমরা প্রায় ২৫ হাজার কেজি আবর্জনা সংগ্রহ করে টেকনাফে নিয়ে এসেছি।’

আরও পড়ুন