কাদাপানিতে মাখামাখি শরীর, জোঁকের কামড়ে রক্ত বের হচ্ছে, তবু মনজুড়ে অদ্ভুত প্রশান্তি

বর্ষায় প্রাণ ফিরে পাওয়া পাহাড়েছবি: মুহাম্মদ হোসাইন সবুজ

আলীকদম পৌঁছে দ্রুত বাজার সেরে নিলাম। তারপর থানা থেকে ভ্রমণের অনুমতি নিয়ে আমতলী ঘাটে চলে আসি। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি, প্রায় চারটা। দেরি না করে সবাইকে নৌকায় তুলে নিয়ে দ্রুত রওনা হলাম দুসরী বাজারের উদ্দেশে।

তৈন খালের পানি অনেক বেড়ে গেছে। ঝিরি ও ঝরনা বেয়ে খালে এসে মিশছে পানি। মিলিত পানি তীব্র বেগে ছুটে চলেছে দূরের সমুদ্রের পানে। বিকেলের সবুজ পাহাড়ে পাখির কোলাহল। মেঘ এসে কখনো কখনো ঢেকে দিচ্ছে পাহাড়ের চূড়া। বৃষ্টি আর মেঘের ফাঁকে দূরের পাহাড়ে দেখা যাচ্ছে নিঃসঙ্গ জুমঘর। মনে মনে বলছিলাম, এ রকম একটা ঘর যদি আমার থাকত!

আমরা যে গতিতে যাচ্ছি, তার দ্বিগুণ গতিতে ছুটে আসছে ফিরতি নৌকাগুলো। ছোটবেলায় স্রোতের অনুকূলে ও প্রতিকূলে নৌকার গতিবেগ নিয়ে অঙ্ক কষেছি। এই অঙ্ক মনে হয় এখানকার মাঝিদের যাতায়াত দেখেই তৈরি হয়েছে! যাহোক, প্রকৃতি দেখতে দেখতে দুই ঘণ্টা পর পৌঁছে গেলাম দুসরী বাজার। এখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনুমতি নিতে হলো। এবার হাঁটার পালা।

গহিন পাহাড়ের এই পাড়ার নাম খ্যামচং
ছবি: মুহাম্মদ হোসাইন সবুজ

দিনের আলো কমে আসছে। আর হয়তো আধা ঘণ্টাও আলো থাকবে না। তাড়াতাড়ি উঠতে শুরু করলাম সামনের পাহাড়ে। কিছুটা উঠতেই অন্ধকার ঘনিয়ে এল। শহুরে শরীর নিয়ে এই অন্ধকারে হঠাৎ ওপরে ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য। এ ছাড়া বৃষ্টিতে ট্রেইল কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে। প্রথম পাহাড়টা চড়তেই পুরোপুরি হতাশ আমরা। এ গতিতে চললে মধ্যরাতেও নয়াপাড়ায় পৌঁছাতে পারব না। তাই বিরতি নিয়ে সবার উদ্দেশে অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা দিলাম—পাহাড়ে প্রথম আধা ঘণ্টা এ রকমই হয়, একটু পরে শরীর সহ্য করে নিলে পথচলা সহজ হয়ে যাবে।

তারপর আবার হাঁটা। আরও কয়েকটা পাহাড় ডিঙানোর পরে পথ মোটামুটি সমতল হয়ে গেল। এর মধ্যে আমাদের শরীরের সহনশীলতাও বেড়েছে। মধ্যরাত হলো না, রাত আটটা নাগাদ নয়াপাড়ায় এসে থামলাম। পাড়ার কার্বারি অসীম দাদার বাসায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। এই পাড়ায় ঝিরিতে পাইপ বসিয়ে পানির ব্যবস্থা হয়েছে। একে একে সবাই গোসল করে যার যার কাজ শুরু করলাম। আমার দায়িত্ব কফি বানানো। মালাউই থেকে কফি এনেছিলাম, সেগুলোই সঙ্গে এনেছি। স্টোভ ও কেটলি বের করে লেগে পড়লাম সবার জন্য কফি বানাতে। এ দিকে শাহেদ ভাই আলীকদম থেকে বয়ে আনা দেশি মুরগি কাটাকুটি শেষ করল। আর গাইড আমাদের জন্য ডাল রান্না করে ফেলল। ভাত রান্না করতে হলো না, অসীমদার পরিবার আমাদের জন্যও ভাত রান্না করেছে।

ক্রিসতংয়ের চূড়ায় টিকে থাকা বন
ছবি: মুহাম্মদ হোসাইন সবুজের সৌজন্যে

ধোঁয়া ওঠা জুমের চালের ভাত, আলু আর দেশি মুরগি, সঙ্গে ডাল পাতে উঠতেই তিন ঘণ্টা ট্রেকিংয়ের কষ্ট ভুলে গেলাম। গহিন পাহাড়ে এ যেন স্বর্গীয় খাবার।

মুরগির ডাক আর পাখির কলকাকলিতে খুব ভোরে ঘুম ভাঙল। বারান্দায় গিয়ে দেখি, সামনের পাহাড়ের মাথায় মেঘেদের বিক্ষিপ্ত আনাগোনা। আজ আমাদের সামনে বড় পথ। রুংরাংয়ে ওঠে খ্যামচং পাড়ায় আমাদের ব্যাগ রাখতে হবে। সেখান থেকে ক্রিসতংও ঘুরে আসতে হবে। তাই দেরি না করে সকালে আলুভর্তা, গত রাতের মুরগির তরকারি আর ডাল দিয়ে খেয়ে পথে নেমে পড়লাম।

নয়াপাড়া থেকে বের হওয়ার আগেই আবার বৃষ্টি শুরু হলো। ধীরলয়ে ট্রেক করে একটু সামনে যেতেই মনটা একেবারে ফুরফুরে হয়ে গেল। পাহাড়ের গায়ে বড় কয়েকটা গাছের মধ্য দিয়ে চলে গেছে আমাদের ট্রেক। মেঘ এসে ডেকে দিচ্ছে সামনের পথ, মেঘেদের মধ্যেই আমাদের পথচলা। যেদিকে দৃষ্টি যায়, প্রকৃতি যেন বর্ষার ছোঁয়ায় প্রতি মুহূর্তে নতুন করে সেজে উঠছে। তবে বৃষ্টির দিনে প্রাণ ফিরে পেয়েছে অনেক দিন ঘুমিয়ে থাকা জোঁকেরাও। মানুষের গন্ধ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। টেনে টেনে জোঁক ছাড়াতে হচ্ছে। রাস্তাও অনেক জায়গায় এত পিচ্ছিল, দলে দলে আছাড় খাচ্ছি সবাই। কাদাজলে মাখামাখি শরীর, জোঁকের কামড়ে রক্ত বের হচ্ছে, তবু মনজুড়ে অদ্ভুত প্রশান্তি। বৃষ্টিভেজা এ রাস্তায় কখন যে রুংরাংয়ের কাছে চলে এসেছি, বুঝতেই পারিনি।

চূড়া থেকে নেমে তাড়াতাড়িই চলে এলাম খ্যামচং পাড়ায়। ডন দাদার ঘরে ব্যাগ রেখে মাত্র ১০ মিনিট বিরতি দিয়েই রওনা দিলাম ক্রিসতং। জঙ্গলের মধ্যে বৃষ্টিভেজা মেঠো পথ, পাখির ডাক আর বৃষ্টির শব্দে আবিষ্ট হয়ে চলে এলাম চূড়ায়।

আরও পড়ুন