এক বছরেই তিন গ্রীষ্ম দেখলেন তারেক অণু

এ বছরই তারেক অণু পৃথিবীর তিন প্রান্ত ঘুরে দেখে এসেছেন তিনটি বর্ণিল গ্রীষ্ম ও পাতাঝরা শরৎ। তাঁর বিচিত্র ভ্রমণের গল্প শুনেছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

এ বছরই পৃথিবীর তিন প্রান্ত ঘুরে দেখে এসেছেন তারেক অণুছবি: তারেক অণুর সৌজন্যে

দক্ষিণে তাসমানিয়া, উত্তরে আলাস্কা আর ক্রান্তীয় অঞ্চলে পাপুয়া—পৃথিবীর তিন প্রান্তে ঘুরতে গিয়ে তারেক অণু দেখেছেন দুর্লভ সব প্রাণী, যাদের অধিকাংশই পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। বিশেষ করে স্যামনভর্তি নদী, স্যামনশিকারি সিল, ইগল ও ভালুকের কথা তাঁর মনে থাকবে আজীবন।

রাজশাহীর অলকার মোড়ে বসে সম্প্রতি সেই মজার ভ্রমণের কথা বলতে বলতে দু-একটা চমকপ্রদ তথ্যও দিলেন তারেক অণু। যেমন ক্যাঙারু, প্লাটিপাস, একিড্‌না, কোয়ালা বা ডিঙ্গো না, অস্ট্রেলিয়ায় তাঁকে সবচেয়ে অবাক করেছে উট। কারণ, অস্ট্রেলিয়ার নাম শুনলেই আমাদের চোখে ভাসে ক্যাঙারুর ছবি। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উটের দেশ এখন অস্ট্রেলিয়া। সেখানে প্রায় ১০ লাখ উট রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে মালামাল পরিবহনের জন্য আফগানিস্তান থেকে প্রথম উট আনা হয়েছিল। সেখানেই তারা এখন পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে।

আরও পড়ুন
পিটার সল্টমার্শ (বাঁয়ে) ও ইনাম আল হক
ছবি: তারেক অণুর সৌজন্যে

২০২৩–এর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরেছেন তারেক অণু। এই দীর্ঘ ভ্রমণের দলনেতা ছিলেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ৮০ বছর বয়সী ইনাম আল হক। তাঁদের আরেক সঙ্গী ছিলেন গায়ক কনক আদিত্য। এ সফরে তাঁরা ২০ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেছেন।

ডারউইন শহরের কাছে বাদাবনে পিটার সল্টমার্শ (৬২) নামের এক নাবিকের জাহাজে ছিলেন তাঁরা। যে জাহাজে বিশ্বভ্রমণ করেছেন পিটার, যাপন করেছেন সংসার। দুই কন্যাকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন। তাঁর এক কন্যা রাজশাহীতেও এসেছেন। তাঁর নাম সারা-জেন (৩৫)। এ মেয়ের সঙ্গে অণুদের পরিচয়ের সূত্রেই বাবার আতিথেয়তার সুযোগ মেলে। পিটারকে বলা যায় অস্ট্রেলিয়ার আরেক ক্রোকোডাইল ডান্ডি (সিনেমার চরিত্র, কুমিরশিকারি)। চার রাত তাঁর জাহাজে ছিলেন অণুরা। কুমিরভর্তি খালে দাঁড় টানা নৌকায় করে লাল কাঁকড়া ধরার ফাঁদ পাততে গেছেন। যেখানে একটু অসতর্ক হলেই কুমিরের কামড়ে মারা পড়ে মানুষ।

অণুদের পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষিণতম ট্রিপ ছিল অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়া। বিপুলসংখ্যক কয়েদিকে এই দ্বীপে পাঠানো হতো। তারেক অণু পৃথিবীর উত্তরের দেশে ‘নদার্ন লাইট’ মেরুজ্যোতি বা অরোরার আলো দেখেছেন। এবার দক্ষিণে তাসমানিয়ায়ও দেখলেন সেই মেরুজ্যোতি।

আলাস্কা সফরে ভ্রমণসঙ্গীদের সঙ্গে অণু
ছবি: তারেক অণুর সৌজন্যে

‘আ’তে আলাস্কা

সোনা-রুপার খনির জন্য আলাস্কার যেসব শহর একসময় ছিল জমজমাট, তার কোনো কোনোটি এখন সম্পূর্ণ মৃত, পরিত্যক্ত। গত জুলাই-আগস্টে সেখানে ছিলেন অণুরা। একই সময়ে কানাডার ইউকন সিটিও ঘুরেছেন। তাঁরা আলাস্কার মৃত শহর-বন্দর রাস্তাঘাট সব ঘুরে দেখেছেন। কোনো কোনোটিতে জনমানুষের দেখা পেয়েছেন। তার একটি ‘কেনো সিটি’। গ্রীষ্মে সেখানে জনসংখ্যা মাত্র ১৬। আর শীতে তা কমে দাঁড়ায় ১১। তারেক অণুরা ১১ জনের উপস্থিতি পেয়েছেন। ভালুকের ভয় সত্ত্বেও সেখানে তাঁবুতেই থেকেছেন তাঁরা।

এই ভ্রমণে হুইটিয়ার নামে এক শহরে থেমেছেন। এ শহরে ২১৪ জন মানুষের বাস, যাঁদের ১৮০ জন থাকেন একটি ভবনে। তাঁদের সেখানে সেরা অভিজ্ঞতা ছিল ডেনালি হাইওয়ের পাশে আদিবাসীদের সঙ্গে ক্যাম্পফায়ার। আগুনের পাশে বসে শুনেছেন তাঁদের গান, গল্প ও রূপকথা।

অণু আলাস্কা ও ইউকনে গিয়েছিলেন মূলত শৈশবের প্রিয় লেখক জ্যাক লন্ডনের স্মৃতিবিজড়িত গোল্ডরাশের সময়ে স্বর্ণ অনুসন্ধানের জন্য বিখ্যাত ডসন সিটি ও ক্লোনডিক নদীর টানে। গিয়েছেন সেই কেবিনে, যেখানে থাকতেন জ্যাক লন্ডন।

বার্ড অব প্যারাডাইস
ছবি: তারেক অণুর সৌজন্যে

বার্ড অব প্যারাডাইস

সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া দ্বীপে কাটিয়েছেন তারেক অণু। এই দ্বীপে বহু ভাষাভাষী মানুষের বাস। পৃথিবীতে যা অনন্য। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, পাপুয়া হচ্ছে ভাষার খনি।

সারা বিশ্বের মানুষ যে পাখিদের একবার চোখের দেখা দেখার জন্য পাগল, সেই ‘বার্ড অব প্যারাডাইস’ এখানে থাকে। পশ্চিম পাপুয়ায় ১১ প্রজাতির বার্ড অব প্যারাডাইস দেখেছেন অণুরা। এই পশ্চিম পাপুয়া ও আরফাক পর্বতের দুই গ্রামে মাত্র একজন মানুষ আছেন, যিনি টাকা গুনতে পারেন। তাঁরা হাতাম জাতির মানুষ। ইংরেজি ভাষা বোঝেন। কিন্তু টাকা গুনতে গেলেই ভুল করেন। তারেক অণুদের সঙ্গেও তাঁদের এই ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তাঁরা টাকা গুনতে ভুল করেছেন। পরে ফোন করে বলেছেন, আপনারা টাকা বেশি দিয়ে গেছেন।

পৃথিবীর তিন প্রান্তের এই তিন অঞ্চল ছাড়াও ২০২৩ সালে অণু ভ্রমণ করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক এলাকা। এক বছরে পৃথিবীর তিন প্রান্ত ঘুরে অণুর মনে জন্ম নেওয়া অনুভূতিটি হলো, পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষের ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা প্রায় একই।