আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। তাই প্রথমে পরিকল্পনা ছিল দুজনে যাব। পরে মনে হলো পরিবারের সবাইকে নিয়ে গেলে আনন্দটা বরং বেশি হবে। একসঙ্গে নতুন বছর উদ্যাপনের পরিকল্পনা শুনে সবাই রাজি হয়ে গেল। উড়ালের দিনক্ষণও ঠিক হয়ে গেল। গন্তব্য আগেই ঠিকঠাক, আরব আমিরাতের দুবাই। আমার প্রিয় শহর।
২৯ ডিসেম্বর যাত্রা করব। সাত দিন আগ থেকেই শুরু হয়ে গেল চিন্তা—লাগেজে কী নেব, আর কী নেব না। তিন দিন ধরে লাগেজ গোছালাম। যাত্রার দিন যখন ঘর থেকে বের হলাম, তখন আমার লাগেজের দিকে তাকিয়ে সবাই হা, লাগেজের ওজন যে ২৫ কেজি হয়ে গেছে!
শহরেই কাটল প্রথম দিন
দুবাইয়ে পৌঁছে কিছুটা ক্লান্ত ছিলাম। বিশ্রাম নিয়ে দিনটা আশপাশে ঘুরেই কাটালাম। আমাদের হোটেল থেকে পুরো শহরটাও দারুণভাবে দেখা যায়।
৩১ ডিসেম্বর। দেশের বাইরে প্রথম থার্টি ফার্স্ট ও নতুন বছর বরণ। সকালের দিকে সনির সঙ্গে বের হই। আল সীফ নামের একটা জায়গায় গিয়ে চমকে গেলাম। দেখে মনে হলো প্রাচীন এক শহরে এসে পড়েছি। কয়েক শ বছর আগের একখণ্ড আরব। পুরোনো শহরের মতো সাজানো, রাজা বাদশাহের ব্যবহার করা অ্যান্টিক সব জিনিসপত্র। কিছু সময় কাটাতেই মনটা ভালো হয়ে গেল।
সেদিন হোটেলে ফিরে দিনে আর বের হইনি। আশপাশের সব এরিয়া অনেকটাই বন্ধ করে দেওয়া। আমরা পরিকল্পনা করি রাতেই বের হব। দুবাইয়ের রাত আমাকে মুগ্ধ করে। মনে হয় জীবন্ত একটা শহর। আমার চোখে ছবির চেয়েও সুন্দর। রাতে আতশবাজি দেখতে আমরা একটা ক্যাফেতে গিয়ে বসি। এত সুন্দর সাজানো গোছানো থার্টি ফার্স্ট আগে দেখিনি। মনে হচ্ছিল, অন্য গ্রহে এসেছি। সমুদ্রসৈকতেও সময় কাটালাম। রুমে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় তিনটা।
বছরের প্রথম দিন
২০২৩ সালের প্রথম দিন ডেজার্ট সাফারিতে ছুটলাম। বালির মধ্যে রাইড। অনেক ওপরে ওঠা আবার নিচে নামা। রোমাঞ্চকর এই ভ্রমণের গল্প অনেকের কাছে শুনেছি, প্রামাণ্যচিত্রেও দেখেছি, এবার আমিই যাত্রী।
প্রথম গাড়িতে আমরা দুজন। দ্বিতীয় গাড়িতে মা-বাবাসহ অন্যরা। বালির মধ্যে শুরু হলো গাড়ি চলা। একবার ওপরে উঠছি তো পরেরবার নিচে নামছি। গাড়ি একবার বালির মধ্যে দিয়ে পিছলে এদিক–সেদিক যাচ্ছে। কী থেকে যে কী হয়ে যায়, ভেবে ভয় লাগছিল। কখনো মনে হচ্ছিল, পাহাড় থেকে পড়ছি। মাঝে রোলার কোস্টারে চড়ার অনুভূতি হলো। গাড়ির মধ্যে ঝাঁকিতে একবার এদিকে কাত হয়ে যাওয়া, পরেই লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠা।
মা-বাবা উচ্চ রক্তচাপের রোগী। এই যাত্রায় না জানি কী হয় তাঁদের। এদিকে আমরা তখন অনেকটা ভেতরে, নেটওয়ার্কের বাইরে। দুজনের খবর নেওয়ার মতো উপায় না পেয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছিল।
পরে দেখি হাসিমুখেই আসছেন মা-বাবা। জানলাম, আমি ভয় পেলে কী হবে, তাঁরা কিন্তু মজাই পেয়েছে।
ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে
পরের দিন গেলাম মিরাকল গার্ডেন। পুরো জায়গায় ফুল দিয়ে সাজানো। মা–বাবা যেতে চাইছিল না। তাঁদের কথা, ‘ফুলের বাগানে আর কি থাকবে, আমরা গিয়ে কি করব।’ কিন্তু আমার খুব আগ্রহ। সবার জন্যই টিকিট কাটলাম। ভেতরে প্রবেশ করে মা-বাবাকেই দেখলাম প্রথম মুঠোফোন বের করে ভিডিও করা শুরু করেছে। আর বলছে, ‘ওয়াও, নাইস।’ বললাম, ‘তোমরা না বললা আসবা না, এখন তো তোমরাই ভিডিও করছ?’ হাসিতে তাঁরা উত্তর দিল।
অনেক বড় জায়গা। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু ফুলের বাগান আর শেষ হয় না। ফুল দিয়ে একটা জায়গা যে এত সুন্দর করে সাজানো যায়, সেটা এই বাগান না দেখলে বোঝা যাবে না। মনে হলো দুবাই আসা সার্থক।
ইয়টে বিবাহবার্ষিকী
৪ জানুয়ারি আমাদের বিবাহবার্ষিকী। আমরা একটি ইয়ট ভাড়া নিই। সাগরে ভেসে ভেসে প্রথম বিবাহবার্ষিকীর কেক কাটি। ইয়টে ভেসে বেড়ানোর ইচ্ছাটা আমার ছিল। আমার ইচ্ছাটা পূরণ করার জন্য সনিকে ধন্যবাদ।
আমরা হইচই, নাচানাচি করে কাটিয়ে দিলাম ইয়টের পুরো সময়। এরই মধ্যে দেখি, আগের দিন শপিং করার সময় স্বর্ণের যে অলংকারগুলো সবাইকে পছন্দ করতে সাহায্য করেছিলাম, সেসব আমাকেই উপহার দিচ্ছে। আমি অবাক। তখন হাসছিলাম আর ভাবছিলাম, আগে যদি জানতাম আমার পছন্দের জিনিস আমাকেই দেওয়া হবে, তাহলে তো আরও সময় নিয়ে আরও ভালো কিছু পছন্দ করতাম!
সকালটা দুজনার
৫ জানুয়ারি। সকাল হতেই আমি আর সনি নিজেদের মতো বেরিয়ে পড়লাম। সময় কাটালাম নিজেদের মতো। উইংস অব মেক্সিকো ভাস্কর্য, পৃথিবীর উচ্চতম বহুতল ভবন বুর্জ খলিফা, সমুদ্রসৈকতসহ বেশ কিছু জায়গায় ঘুরলাম। সকালে এসব জায়গায় লোক সমাগম কম থাকে। এর মধ্যে বৃষ্টিও পেলাম। আবহাওয়া দারুণ, আকাশ কিছুটা মেঘলা—ভালো লাগছিল। আমার কাছে দুবাইয়ে ঘোরার জন্য সেরা সময় জানুয়ারি।
ফেরার পালা
ফেরার আগের দিন কোথাও ঘুরতে যাইনি। হোটেলের পাশেই একটি শপিং মল ছিল। সেখানে সময় কাটিয়েছি। কেনাকাটা করেছি। তখন মনে হচ্ছিল এবার অনেক জায়গা ঘুরতে পারিনি। স্কাই ডাইভিংসহ বেশ কিছু পরিকল্পনা ছিল, সেসব করা হলো না। অল্প সময়ে সবকিছু দেখা সম্ভবও নয়। সময় নিয়ে আরও কয়েকবার গেলে হয়তো দেখে শেষ করতে পারব। তবে এবারের ট্যুরে সবচেয়ে বড় পাওয়া নিজেকে সময় দেওয়া। শুটিংয়ের ব্যস্ততার কারণে পরিবারের মানুষদের নিয়ে সময় কাটানো হয়ে ওঠে না, সে সুযোগও হলো। তাঁদের সঙ্গে প্রতিটা মুহূর্ত কেটেছে আনন্দে। মনের ভ্রমণ ডায়েরিতে যা আছে সুন্দর স্মৃতি হয়ে।