উন্দাভাল্লির গুহায় যা দেখে এলাম

উন্দাভাল্লির আয়ত চিত্র
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ঢাকা থেকে দিল্লি হয়ে বিজয়ওয়াড়া। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আমাকে আমন্ত্রণ করে এনেছে অন্ধ্র প্রদেশের গুন্টুর জেলার ভাদ্দেশ্বরমে অবস্থিত কোনেরু লক্ষ্মাইয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিজয়ওয়াড়া অবস্থানকালেই একবার উন্দাভাল্লির গুহা দেখতে গিয়েছিলাম। গুহাগুলো বিজয়ওয়াড়া থেকে প্রায় চার কিলোমিটার। এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি পথ, তবু পাহাড়ের পাদদেশ উর্বরা সমতল। ইউনিভার্সিটি থেকে আমাদের জন্য একটি টাটা নিক্সন বরাদ্দ করেছে। সেই গাড়ির পেছনের সিটে ড. সম্পদ পান্ডে ও আমাকে বসিয়েছেন গাড়িচালক প্রশান্ত কুমার। সম্পদ আমার পূর্বপরিচিত, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী। আমরা দুজন সাইপ্রাসের ফ্রেডেরিক ইউনিভার্সিটিতে ড. হ্যারিস হরলম্বুসের তত্ত্বাবধানে নভোবিজ্ঞানের ওপর কাজ করেছি। ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটটাতে বসেছেন ড. সম্পদের পিএইচডি ছাত্র রাম কুমার। অতীব আনন্দের সঙ্গে তিনি ক্রমাগত আমাদের ছবি তুলে যাচ্ছেন।

কৃষ্ণা নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে পানি আটকে সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই ব্যারাজের ওপর দিয়ে চলে গেছে চার লেনের রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি ছুটে চলে। একদিকে ভরা নদী, অন্যদিকে ধু–ধু বালিয়াড়ি। কত রকমের যানবাহনই না ছুটে চলেছে! বাঁয়ের লেন দখল করে ছুটে যাচ্ছে একঝাঁক স্কুটি। কোনোটাতে দুজন রুক্ষ চেহারার ঝুলে পড়া পুরু গোঁফের দশাসই শ্যামলা পুরুষ। কোনোটাতে গিন্নিকে পেছনে বসিয়ে গৃহস্থ স্বামী। এ জীবনে হেলমেট পরার কোনো তাগিদ তাদের নেই। এসব খেটে খাওয়া মানুষের দিকে চোখ পড়তেই সম্পদ বলে, ‘এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কৃষিজীবী ও মোটামুটি সচ্ছল। ইউনিভার্সিটিতে সন্তানদের পড়ানো তাদের কাছে অনেকটাই মান–মর্যাদার বিষয়।’

ড. সম্পদ পান্ডের সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

পাহাড়ের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা উন্দাভাল্লির দিকে এগিয়ে যাই। পাকদণ্ডী ঠিক নয়, কিছুটা সমতল, কিছুটা ঢালু আঁকাবাঁকা রাস্তা। দুই পাশে নিষ্প্রভ আনাড়ি হাতে গড়ে তোলা একতলা বাড়িঘর দেখতে দেখতে সাইপ্রাসের ছোট ছোট শহরতলিতে ইতস্তত ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ভগ্নস্তূপের মতো পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর কথা মনে পড়ে। মানুষের মস্তিষ্ক এক অদ্ভুত যন্ত্র। সে যে কখন, কোথা থেকে কোন স্মৃতি সামনে এনে হাজির করবে, তার কোনো নিশানা নেই। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় গন্তব্যে পৌঁছে যাই।

চার তলা মূল গুহাটি ছাড়াও ছোট ছোট আরও তিনটি গুহা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

কঠিন পাথুরে শিলা কেটে তৈরি করা হয়েছে এই স্থাপত্য

অন্ধ্র প্রদেশের বিজয়ওয়াড়ার গুনটুরের এই গুহাগুলো ভারতের শিলা কেটে তৈরি করা স্থাপত্য ঐতিহ্যের সেরা নমুনা। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে এগুলো বিষ্ণুকুণ্ডি শাসকেরা নির্মাণ করিয়েছিল বলে মনে করা হয়। কোনো কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদ মনে করেন, এগুলো মূলত জৈন গুহা, পরে যা বৌদ্ধদের আশ্রয় দিয়েছিল। কালক্রমে হিন্দু বৈষ্ণব গুহায় পরিণত হয়েছিল। চারতলা মূল গুহাটি ছাড়াও পুরো চত্বরে ছোট ছোট তিনটি গুহা চোখে পড়ল। এগুলোর ওপর একটি আয়তাকার প্রস্তরফলকে হাতি ও সিংহের মূর্তি খোদাই করা আছে। তার ওপরে ডানে চিলেকোঠার মতো একটি বর্ধিতাংশ, সেখানে একটি বিষ্ণুমূর্তি খোদাই করা। অন্যপাশের বর্ধিতাংশটি অসমাপ্ত।

৪ সাধুর ধ্যানরত মূর্তি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

প্রবেশমুখে টিকিটের ঘর। আমাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই ঝটপট তিনখানা টিকিট কেটে ফেললেন ড. সম্পদ। আমরা চত্বরে প্রবেশ করলাম। সবুজ চত্বরের বুক চিরে গুহা অবধি শানবাঁধানো হাঁটার পথ। পথের শুরুতেই স্থাপিত আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর। সেখানে গুহাগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া আছে।

আমরা চারতলা মূল গুহার পাদদেশে চলে এলাম। ওপরে হাতির পিঠের মতো কঠিন প্রস্তরীভূত পাহাড়। মনে হলো, মূল গুহাটির ওপরের অংশ সম্প্রতি পেইন্ট করা হয়েছে। গুহার রহস্যময়তা আমাকে টানছে, তবু চারপাশের নিম্নভূমির সবুজকে আমি কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছি না। পাহাড়ের পাদদেশ সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা। সেখানে শান্তভাবে প্রবাহিত কৃষ্ণা নদী। অন্তহীন তার বয়ে চলা। কৃষ্ণা নদীবিধৌত গুনটুর জেলার মাটি খুবই উর্বর ও ফলবতী। এখানের মানুষেরা খুবই পরিশ্রমী। বছরে তিন থেকে চারটি ফসল ফলায় তারা। এক ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই খেতে বুনে দেয় অন্য ফসল।

দুজনে গল্প করতে করতে মূল গুহার সবচেয়ে নিচের তলায় এসে দাঁড়িয়েছি। মানুষের তেমন একটা ভিড় নেই। দোতলায় কিছু কপোত-কপোতী মধু নীড় পেতে বসে আছে। আমরা কঠিন শিলা কেটে বানানো চারতলা উন্দাভাল্লি গুহার সবচেয়ে নিচের তলায় প্রবেশ করলাম। এটি সম্ভবত অনেক কটি খিলানের ওপর দাঁড়ানো একটি অসমাপ্ত হলরুম। সম্পূর্ণ হলরুমটি বিশাল একটি নিরেট পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। কতজন বিশ্বকর্মার হাতুড়ি ও ছেনির আঘাতে আঘাতে এই স্থাপত্য অবয়ব পেয়েছে জানি না। কিন্তু সভ্যতার আদি নিদর্শনের সঙ্গে বর্তমান প্রযুক্তির তুলনা করে বিস্মিত হই। আজকাল হয়তো বছরের পর বছর ধরে শিলা কেটে এমন স্থাপত্য আর তৈরি করা হবে না। এই কঠিন শিলার খিলানকে প্রতিস্থাপন করবে রিইনফোর্সমেন্ট কংক্রিট স্ট্রাকচার, তবু মানুষের এই এগিয়ে যাওয়ার পথে কত শত মনীষীর অবদানকে শ্রদ্ধা না করে কি কোনো উপায় আছে?

উন্দাভাল্লি গুহাকে প্রোটেক্টেড মনুমেন্ট ঘোষণা দিয়ে তেলেগু, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় ভারত সরকারের এলান
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এরপর পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ট্রিনিটিতে ওঠার পালা। সিঁড়িও বানানো হয়েছে হাতুড়ি-ছেনি চালিয়ে পাথুরে শিলা কেটে। মেপে মেপে। দোতলায় ওঠে নজরে এল শিব ও বৈষ্ণবের ভাস্কর্য। আরও কয়েকটি ভাস্কর্য দেখে মনে হলো এগুলো পরবর্তীকালে তৈরি করা হয়েছে। সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি নজরে এল। বেশ কয়েকটি দেব-দেবীর মূর্তি দেখলাম। এগুলোর একটি স্পষ্টতই ‘নৃসিংহ’; জানুতে রেখে হিরণ্যকশিপু বধ করছেন। আরেকটি ত্রিমূর্তি; অর্থাৎ এক দেহে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। আরও একটি মূর্তি দেখে মনে হলো দণ্ডপাণি ভৈরব।

দণ্ডপাণি ভৈরবের মূর্তি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

তারপর একটি আয়তাকার মন্দির। ওপরের তলাটি অসমাপ্ত। কিছু ভাস্কর্যের নমুনা চালুক্য যুগের। কঠিন স্তম্ভগুলো কতটুকু শক্ত, ঘুষি মেরে পরীক্ষা করার অভিনয় করছি, এমন সময় রাম কুমারের ক্যামেরা ঝলসে উঠল। এই স্তম্ভগুলোর শৈলীর সঙ্গে বিজয়নগরের একটি শৈলীগত মিল আছে।

মন্দিরের দ্বিতীয় তলায় কিছু সুপরিচিত চৈত্য নকশা দেখতে পাই। কোনো এক সময়ে এগুলো যে বৌদ্ধগুহা ছিল, এসব নকশা তারই ইঙ্গিতবাহী।

তিনতলার বারান্দায় বসে থাকা ধ্যানরত চার সাধুর প্রমাণ মাপের মূর্তি খুব কাছে থেকে নেড়েচেড়ে দেখা গেল। তাঁদের মধ্যে একজন একটি তানপুরার মতো যন্ত্র বাজাচ্ছে। পাশে দুটি সিংহের ভাস্কর্য। সিংহ দুটির মোটেও বিশ্রাম নেই। তাদের পিঠে সওয়ার হয়ে ছবি তোলার ভিড় লেগে আছে। আমরাইবা বাদ যাব কেন! সবাই তাই একে একে সিংহাসনে বসে ছবি তুলে নিলাম। এই সাধুমূর্তিগুলো জৈন বা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মতো নয়, তবে সম্ভবত ঋষি–মুনির মতো। মনে হলো, তাঁদের একজন গুরু আর তিনজন শিষ্য।

চার তলা মূল গুহার প্রথম তলা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সবশেষ আকর্ষণ অর্ধশায়িত ভগবান বিষ্ণুর প্রায় ১ হাজার ৬০০ বছরের পুরোনো ৪ মিটার দীর্ঘ এক শিলা মূর্তি। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর দিকে গ্রানাইটের একটি ব্লক খোদাই করে গড়া হয়েছে এই ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্য উন্দভাল্লিকে একটি বৈষ্ণব গুহামন্দির বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ঘুমন্ত বিষ্ণুর নিশ্ছিদ্র বিশ্রাম নিশ্চিত করতে শিয়রে প্রহরারত একটি বিশাল গরুড় মূর্তি। আর দৈত্য নাগা কাজ করছে সিথানের বালিশ হিসেবে। অন্ধকার এই গুহায় দুই ধারে দুটি পিদিম জ্বেলে রাখা হয়েছে। সেই মৃদু আলোয় কালো গ্রানাইটের ঘুমন্ত বিষ্ণুকে আমার চোখে এক নিবিড় শান্তির ঘুম হিসেবেই প্রতিভাত হলো।

লেখক: অধ্যাপক, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি), বাংলাদেশ