আম্মুকে দেখছি আর ভাবছি, এ ভ্রমণের অর্থ, সময়, দুশ্চিন্তা—সব উশুল

প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। সেই আহ্বানে বিপুল পাঠক সাড়া দিয়েছেন। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।

সাজেকে গিয়ে শিশুদের মতো হয়ে গিয়েছিলেন আম্মু
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

পাহাড়ের উচ্চতাকে আম্মুর বড় ভয়। ভাবলাম, তাঁর পাহাড়-ভীতিটা এবার ভাঙাই। ঠিক করলাম, আম্মুকে নিয়ে সাজেকে যাব।

আম্মু ডায়াবেটিসের রোগী, তার সঙ্গে আছে হাঁটু আর ঘাড়ের ব্যথা। দীর্ঘ সময় জার্নি করা তাঁর জন্য অনেকটা অসম্ভব। সাজেকে যেতে ১২-১৩ ঘণ্টা লাগবে ভেবে সঙ্গে নিলাম ট্রাভেল পিলো আর ছোট মোড়া। আম্মুর ঘাড়ের আরাম হবে, তার জন্য বালিশ এবং বেশিক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসতে পারে না, তাই পায়ের নিচে দেওয়ার জন্য মোড়া।

ঢাকা থেকে রাতের বাসে খাগড়াছড়িতে যাওয়ার পথে চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। মনে হলো, ঘুমিয়ে গেলে যদি আম্মুর কষ্ট হয় আর আমি ঘুমাচ্ছি ভেবে না ডাকে! কিছুক্ষণ পরপরই চেষ্টা করলাম আম্মুর পা দুইটা আমার পায়ের ওপর রাখতে যেন ব্যথা না বাড়ে। পুরো রাস্তা সুন্দরভাবে গেলেও খাগড়াছড়িতে ঢোকার মুখে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন আম্মু। এখান থেকে রাস্তাটায় অনেক বাঁক। রক্তে শর্করার পরিমাণ একদম কমে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই খেজুর, চকলেট খেতে দিলাম। শর্করার পরিমাণ ঠিক হলো। কিন্তু বাঁকের কারণে স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগল।

আম্মুর সঙ্গে আমি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

খাগড়াছড়ি নেমে নাশতা করেই শুরু হলো আমাদের পাহাড় ভ্রমণ। আহা, কী সুন্দর রাস্তা! পাহাড় ভয় পাওয়া আমার আম্মু মুগ্ধ হয়ে পাহাড়ি রাস্তা দেখলেন। আর আমি দেখলাম আমার আম্মুকে। মনে হচ্ছিল, আমি যেন আমার মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে এসেছি। এ যাত্রায় পায়ের ব্যথার কথা প্রায় ভুলেই গেলেন। সাজেকে নেমে রিসোর্টের রুমে ঢুকতেই আরেক মুগ্ধতা। বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে সারি সারি পাহাড় আর মেঘ। শিশুদের মতো খুশি হয়ে কাছের মানুষদের ভিডিও কলে রুম আর পাহাড় দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আর আমি বারবার শুধু তাঁকে দেখছি। আর ভাবছি, এ ভ্রমণের অর্থ, সময়, দুশ্চিন্তা—সব উশুল।

বিকেলে আবার বের হলাম। হেঁটে হেঁটে সাজেক দেখব। ছোট্ট জায়গাটা দুজন মিলে বেশ মজা করেই ঘুরে দেখলাম। আগেও আমি সাজেকে এসেছি, তাই আম্মুকে ঘুরিয়ে দেখানোর জায়গাগুলো ঠিক করেই রেখেছিলাম। রাত ১১টার দিকে চলে গেলাম হেলিপ্যাডে। আকাশভরা তারার মেলা, সঙ্গে গানের আসর। আর রাতের অন্ধকারে আমার মায়ের চোখে আনন্দের ছটা।

রাতে খুব ভালো ঘুম হলো। সকালেই আবার বের হয়ে পড়লাম। গন্তব্য খাগড়াছড়ি। পায়ের ব্যথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্পট ষোড়শী কিশোরীর মতো উপভোগ করলেন আম্মু। আর আমি তাঁর চঞ্চলতা উপভোগ করলাম।

মাঝে অবশ্য মা-মেয়েতে কিছুটা মনোমালিন্য হলো। আম্মু যেখানেই যায় কিছু না কিছু কেনাকাটা করে। আমি আবার ঘুরতে গিয়ে কেনাকাটা একদম পছন্দ করি না। শুরুটা এ নিয়েই হলো। এরপর বাসে ওঠার সময় আমার দায়িত্বহীনতার প্রশ্ন সামনে এল। আম্মুকে নিয়ে যেহেতু বের হয়েছি, সঙ্গে সর্বক্ষণ একটা ব্যাগ রাখতে হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল তাঁর ওষুধ, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, ডায়াবেটিস মাপার যন্ত্র, পর্যাপ্ত শুকনা খাবারের সঙ্গে আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস। সেই ব্যাগটা ভুলে হোটেলের গেটে রেখে এসেছি। বাসে ওঠার সময় খেয়াল হলো। সঙ্গে সঙ্গে নেমে গিয়ে ব্যাগটা আবার নিয়েও আসি। এই মনোমালিন্য এখন মধুর মনে হয়। কারণ, এ ভ্রমণই যে আম্মুর সঙ্গে আমার অন্যতম সুন্দর স্মৃতি।