বিশ্বের সবচেয়ে বড় দৌড় প্রতিযোগিতায় আমিও ছিলাম
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যারাথন ‘নিউইয়র্ক সিটি ম্যারাথন’। গত নভেম্বরে হয়ে গেল ৫১তম আয়োজন। এতে অংশ নেন ১৩১টি দেশের প্রায় ৫০ হাজার প্রতিযোগী। তাঁদেরই একজন বাংলাদেশের প্রশান্ত রায়
গত বছরের মার্চের ঘটনা। একদিন সকালে মুঠোফোন খুলে দেখি নিউইয়র্ক সিটি ম্যারাথন আয়োজকদের মেইল। বার্তাটা আমার সকালটাকেই রাঙিয়ে তুলল। লাখ লাখ আবেদনকারীর মধ্যে আমিও একজন সৌভাগ্যজন লটারি বিজয়ী। এর অর্থ আমি নিউইয়র্ক সিটি ম্যারাথন ২০২২-এ অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি।
বাসস্টেশনে বাঙালি কায়দা
৬ নভেম্বর ২০২২। সকাল ছয়টা বাজলে কী হবে, বাইরে ঘোর অন্ধকার। নিউইয়র্কে দুই সুহৃদের বাসায় রেডি হয়ে সহযাত্রী বাবুর (মোহাম্মদ ইসলাম) অপেক্ষায় বসে আছি। জ্যামাইকা থেকে সে রওনা হয়েছে। দুজনেই ম্যারাথনে অংশ নিচ্ছি। একসঙ্গে স্টার্টিং পয়েন্ট বা দৌড় শুরুর জায়গায় যাওয়ার কথা। নিউইয়র্ক দুজনের কাছেই অচেনা। তারপরও স্বদেশি দুজন মানুষ একসঙ্গে পথ চললে সাহস পাওয়া যায়।
অল্প সময়ের মধ্যেই বাবু এল। তৈরি হয়ে দুজনে পথে নামলাম। গাড়িতে স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের ফেরিঘাটে পৌঁছালাম সকাল পৌনে আটটায়। লিবার্টি অব স্ট্যাচু পেরিয়ে ওপারে পৌঁছাতে বাজল সাড়ে আটটা। এরপর কিছুটা হেঁটে বাসস্টেশন। স্টেশনে হাজার হাজার দৌড়বিদ। নিউইয়র্কের সব হলুদ রঙের স্কুলবাসগুলো কাজে লাগানো হয়েছে। একটার পর একটা বাস ছেড়ে যাচ্ছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর বাসে ওঠার সুযোগ পেলাম। ভদ্রভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে সেটাও হতো না। ধৈর্যচ্যুতি হলে বাবুকে বললাম, একটু বাংলাদেশি স্টাইল কাজে লাগাতে হবে!
ঠেলেঠুলে সাইড দিয়ে ঠিকই বাসে উঠে পড়লাম।
৬ কিলোমিটার বাসযাত্রা। বাস থেকে নেমে একটু সামনে এগোতেই চোখে পড়ল বড় বড় বক্স, রানাররা যেখানে গায়ের অতিরিক্ত জামাকাপড়-জুতা রেখে দিচ্ছেন। ম্যারাথনের ওয়েবসাইটে নির্দেশনা ছিল, বেশ ঠান্ডা থাকবে, সবাই যেন গরম পোশাক পরে আসি এবং দৌড়ের আগে এগুলো রেখে দিই। একটু পর পর বড় বক্স ভরা জামাকাপড় নিয়ে যাচ্ছে আয়োজকেরা। পুরোনো কাপড়ের দোকানে এগুলো দান করা হবে।
বাবু আর আমার দৌড়ের সময় আলাদা। তাই দুজনের স্টার্টিং পয়েন্টও আলাদা। ১০টায় বাবুকে বিদায় দিয়ে আমার পয়েন্টের দিকে এগোলাম। এলাহি কাণ্ড। একপাশে বিখ্যাত সব খাদ্য ও পানীয় ব্র্যান্ডের বুথ। এনার্জি ড্রিংক, এনার্জিবার, সকালের খাবার দিয়ে সাজানো সব বুথ। সবই ফ্রি। এক কাপ গ্যাটোরেড ড্রিংকস খেয়ে এসআইএসের বুথ থেকে দুটি এনার্জিবার পকেটে নিলাম। রাতে ঘুম হয়নি, এক কাপ কফি হলে ভালো হতো। একটু ডানে তাকাতেই দেখি কফি-চায়ের বুথ। এক কাপ কফি হাতে নিয়ে একটু বসলাম।
আমার দৌড় শুরু সাড়ে ১১টায়। শুরুর আগে কোনো প্র্যাকটিসই তো হলো না, ভাবছিলাম একটু স্ট্রেচিং করব কিন্তু চারপাশের এলাহি কাজকারবার দেখে তা-ও আর করা হলো না।
উৎসবের দৌড়
১০টা ৫৫ মিনিটে রেসারদের যাত্রা শুরু হলো। সবাই হাততালি দিয়ে তাঁদের উৎসাহিত করল। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের ভেরাজানো-ন্যারো ব্রিজের গোড়ায়। এখান থেকেই দৌড় শুরু হবে।
৩ কিলোমিটারের ব্রিজ পার হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্রুকলিনের ফোর্ট হ্যামিলটনে প্রবেশ করলাম। ভেবেছিলাম ব্রিজ পার করে একটু সমতল রাস্তায় স্বচ্ছন্দে দৌড়াতে পারব। তা না, অনবরত চড়াই-উতরাই। আগের দিন ফোনে এখানকার দৌড়বিদ খালিদ বলছিলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে প্র্যাকটিস করে নিউইয়র্কে দৌড়ানো কষ্টকর।’ তার কথা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। কিন্তু তাতে আমার সমস্যা নেই। যত সময়ই লাগুক, ৪২ দশমিক ২০ কিলোমিটার পথ আমি পাড়ি দেবই দেব।
নভেম্বরের শুরুতেই সাধারণত নিউইয়র্কে শীত নেমে আসে। আয়োজকেরাও তা-ই জানিয়েছে। কিন্তু এবার মনে হলো উল্টো। সেদিন তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে। ৫ কিলোমিটার পার করার পরই উত্তাপটা টের পাওয়া গেল। প্রতিটা হাইড্রেশন পয়েন্ট থেকে ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস যতটা না নিলাম, তার চেয়ে বেশি মাথায় পানি ঢাললাম। এতটাই গরম যে এলিট রানারদের কয়েকজনকেও দেখলাম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে যে উৎসবের আমেজ দেখেছিলাম, সামনে গিয়ে মনে হলো তা মহোৎসবে রূপ নিয়েছে। রাস্তার দুই পাশে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দাঁড়িয়ে আছে হাজারো মানুষ। ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মা-বাবা, বয়স্করাও বাদ যাননি। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নেচেগেয়ে, বিভিন্ন স্লোগান-সংবলিত প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে উচ্ছ্বাসে মুখরিত চারদিক। হাই ফাইভ দেওয়ার জন্য হাত উঁচিয়ে রাখা ছেলেমেয়েদের কারও সঙ্গেই হাত মেলানো বাদ রাখিনি। একজন রানারের সঙ্গে হাত মেলাতে পারার তৃপ্তিটা তাঁদের চোখেমুখে স্পষ্ট। ম্যারাথনটাকে এখানে শুধু একটা দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন মনে করা হয় না। সাধারণ মানুষ থেকে সরকারি দপ্তরের কর্তাদের আচরণেও বোঝা যায়, ম্যারাথন একটি লাইফস্টাইল। তাই এটা যেমন পৃথিবীর এলিট অ্যাথলেটদের দৌড় প্রতিযোগিতা, ঠিক তেমনি সব বয়সী মানুষদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক উৎসবও। তাই সময়ের বাঁধাধরা কোনো নিয়মও নেই। আয়োজকদের কথা, যাঁরা দ্রুত পৌঁছানোর, তাঁরা ঠিকই পৌঁছাবেন। বাকিরা তাঁদের সাধ্যমতো সময়ে পৌঁছাক। কিন্তু সবাই সুস্থ থাকুক।
ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যা ৬টা ১৯। পতাকা নিয়ে সেন্ট্রাল পার্কের ফিনিশ লাইন ক্রস করার পর একজন ভলান্টিয়ারের মুখে ‘জয় বাংলা’ শুনে তাকালাম। আচমকা বাংলা ভাষা তা-ও আবার ‘জয় বাংলা’ শুনে দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে গেল, আবেশে শিহরিত হলো শরীর-মন। ছেলেটাকে বললাম, ‘তুমি নিশ্চয়ই বাংলাদেশি!’
‘হ্যাঁ, কনগ্র্যাচুলেশন ভাইয়া।’
ছেলেটার নাম নাদিম। মনে হলো কত–না আপন। বিদেশবিভুঁইয়ে কারও মুখে বাংলা শব্দ শোনার অনুভূতি অনন্য। কোনো কিছুর সঙ্গে এর তুলনা চলে না।