অক্সফোর্ডের আভিজাত্যে

অক্সফোর্ড সত্যিকারেই পীঠস্থান। প্রতিটি ইমারত বহন করে চলেছে সময়ের স্মৃতিচিহ্ন। পাঠাগারগুলোতে পায়ের ধুলা পড়েছে অসংখ্য মনীষীর। পথে পথে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের মণিকাঞ্চন। সেখানে দুদণ্ড সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা আসলেই যেন শারদ ভোরের আরুষির মতোই।

তিনশো বছরের পুরোনো রেডক্লিফ ক্যামেরা

শান্ত টেমস নদীর কূল ঘেঁষে মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজপ্রাসাদের মতো
আইনস্টাইন আর পরাবাস্তব গল্প এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম আবিংডন রোড ধরে। যে সড়ক আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল প্রাচীন নগরী অক্সফোর্ডের আভিজাত্য আর জৌলুশের আরও গভীরে।
হাঁটতে হাঁটতে মধ্যগগনে থাকা ব্রিটিশ গ্রীষ্মের তাপে ক্লান্ত শ্রান্ত আমরা হালকা জিরিয়ে নিলাম অক্সফোর্ডের বিখ্যাত বাবল পানীয়ের দোকান বাবলিওলজিতে। তারপর আবার হাঁটা। দুপাশের প্রাচীন প্রাসাদের বিশাল বিশাল ভবনে কাঠের খোদাই করা রাজফটক আর ভাস্কর্যগুলো জানিয়ে দিচ্ছিল জ্ঞানবিজ্ঞানের পাশাপাশি প্রাচীন অক্সফোর্ডের শিল্পচর্চার বারতা।

রেডক্লিফ ক্যামরা আর অলসোলস কলেজের সামনে সস্ত্রীক লেখক

বাবলিওলজি থেকে বেরিয়ে হাইস্ট্রিট ধরে একটু সামনে গিয়ে হাতের বাঁয়ে সেন্ট মেরি প্যাসেজ দিয়ে ঢুকেই চক্ষু একেবারেই ছানাবড়া। চোখের সামনে সতেরো শতকের বিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন রেডক্লিফ ক্যামেরা। মনে হলো দাঁড়িয়ে আছি অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষ্ণ নদীর তীরবর্তী কোল্লুড় খনি থেকে উত্তোলিত বিখ্যাত সেই কোহিনুরসমৃদ্ধ বিশালাকার কোনো রাজমুকুটের সামনে, যাকে হার্ট অব অক্সফোর্ডও বলা হয়। বিখ্যাত রয়্যাল ফিজিশিয়ান জন রেডক্লিফের নামে তৈরি এই রেডক্লিফ ক্যামেরার নির্মাণকাজ শুরু হয় সতেরোশো সাঁইত্রিশ সালে। ১২ বছরের তুমুল কর্মযজ্ঞের পরে ১৯৪৯ সালে শেষ হয় রেডক্লিফ ক্যামেরার নির্মাণকাজ।

রেডক্লিফ ক্যামেরা মূলত এক বিশাল গ্রন্থাগার। ছয় লাখ বইসমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে বসে গত ৩০০ বছরে গবেষণা করেছেন জগদ্বিখ্যাত গবেষকেরা। মজার ব্যাপার হলো, এই রেডক্লিফের চারপাশে ঘিরে রয়েছে পনেরো শতকের বিখ্যাত বোডলিয়ান লাইব্রেরি, চার্চ অব সেন্ট মেরি দ্য ভার্জিন, ব্রাসনজ কলেজ আর অল সোলস কলেজ। প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থাপনা যেন জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য–সংস্কৃতি আর স্থাপত্য দিয়ে ঘিরে ধরে আছে রেডক্লিফ ক্যামেরাকে। অথবা চারপাশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠা‌ রেডক্লিফ ক্যামেরাকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে শিক্ষার পথ ধরে।

১৪৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত অল সোলস কলেজ ওফ অক্সফোর্ড

করোনাকালীন বিধিনিষেধ থাকার কারণে ভেতরে ঢুকতে না পারলেও প্রচুর ছবি তুলে আনলাম। আমার ছোট মেয়েটা খালি পায়ে হাঁটল ৩০০ বছরের পুরোনো এমন শিক্ষা চত্বরের ইট বিছানো প্রাঙ্গণে। এক ভ্রমণে এর থেকে আর বেশি কী–ই বা আশা করা যায়।

রেডক্লিফ ক্যামেরার চৌকাঠ পেরিয়ে হানা দিলাম বোডলিয়ান লাইব্রেরির দরজায়। অক্সফোর্ডের বোডলিয়ান লাইব্রেরি ইউরোপের পুরোনো লাইব্রেরিগুলোর একটি। পনেরো শতকের মাঝামাঝিতে কিং হেনরি অষ্টম যখন প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারক অধ্যাপক মার্টিন লুথারের লেখা বই পুড়িয়ে ফেলেন তাঁর নির্বাহী আদেশে এর বছর পঞ্চাশেক পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বোডলিয়ান লাইব্রেরি তৈরি হয়েছিল সেই বই পোড়ানোর প্রতিবাদস্বরূপ।

বিখ্যাত বোডলিয়ান লাইব্রেরির সামনে

ষোলো শতকের শুরুর দিকে যাত্রা শুরু করা এই লাইব্রেরিতে সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত সংগ্রহ করে চলেছে ব্রিটেনের যেকোনো প্রেস থেকে প্রকাশিত হওয়া সব বই। বর্তমানে বোডলিয়ান লাইব্রেরিতে সংগৃহীত আছে ১৩ মিলিয়ন বই।

প্রাচীন কমার্শিয়াল লাইব্রেরি ব্লাকওয়েল

এই লাইব্রেরির ঠিক উল্টো দিকে আছে ১৮৭৯ সালে যাত্রা করে আরও একটি কমার্শিয়াল লাইব্রেরি, যার নাম ব্ল্যাকওয়েল লাইব্রেরি। দেড় শ বছরের অধিক পুরোনো এই লাইব্রেরিতে গিয়ে অন্তত একটা বই সংগ্রহ করার লোভ সামলানো কঠিন।
সঙ্গে ছিল সাবেক সহকর্মী মার্জিয়া, যে বর্তমানে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছে ডেটা সায়েন্টিস্ট হিসেবে। তার বদৌলতে ৩৩ শতাংশ মূল্যহ্রাসে কেনা হলো প্রাচীন শিল্পকলার ওপরে একটি বই। আর হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা হলো লাইব্রেরির আনাচকানাচে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ইতিহাস আর ঐতিহ্যের বিবিধ রতন।

বোডলিয়ান লাইব্রেরির উল্টো পাশেই ব্রিজ অব শাইখ্যাত হার্টফোর্ড কলেজ। হার্টফোর্ড কলেজের দুটি ভবনকে আলাদা করে রেখেছিল নিউকলেজ লেন। সে সময়ে ব্যস্ত নিউ কলেজ লেন পাড়ি দিয়ে অপর পাশের ভবনে যাওয়াটাকে হার্টফোর্ড কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে মনে হলো সময়ের অপচয়। সেই ভাবনা থেকেই ভেনিসের ব্রিজ অব শাইয়ের আদলে নির্মাণ করা হয় এই ব্রিজ। এর প্রায় এক শ বছর পরে কেমব্রিজেও তৈরি হয়েছিল আরও একটি ব্রিজ অব শাই। সে গল্প করব অন্য কোনো দিন।
ব্রিজ অব শাই থেকে আপাতত গন্তব্য বিখ্যাত ডিভাইনিটি হল, যা স্থাপিত হয়েছে ১৪২৭ সালে।

ব্রিজ অব শাই

এখানে চৌদ্দ শতক থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জগদ্বিখ্যাত সায়েন্টিস্ট এবং মানবসভ্যতায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা গবেষকদের গবেষণাপত্র উপস্থাপন এবং পর্যালোচনা (থিসিস ডিফেন্স) করা হতো। হলের ভেতরে ঢুকেই এর ভাবগাম্ভীর্য আর ঐতিহ্যের গরিমা দেখে বুকের ভেতরটা শান্ত হয়ে গেল। সমস্ত সত্তাজুড়ে সত্যি একধরনের নির্বাণ বোধ হচ্ছিল। একজন গবেষক হিসেবে বারবার রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম শত শত বছরের পুরোনো ডিভাইনিটি হলের পাথরের শীতল বেঞ্চে বসে।

ডিভাইনিটি হলের ভেতরে। যেখানে প্রাচীন অক্সফোর্ডের বিখ্যাত গবেষকরা তাঁদের গবেষণাপত্র উপস্থাপন করতেন

ডিভাইনিটি হল থেকে যখন বেরোলাম, তখন সূর্য প্রায় পশ্চিমে। অস্তগামী সূর্যের সান্ধ্য আলোয় ডিভাইনিটি হলকে মনে হচ্ছিল নির্বাণ লাভের মহাপীঠস্থান। যে নির্বাণ ধরা দেয় শিক্ষা, গবেষণা আর আবিষ্কারের ধ্যানে কাটানো হাজারো বিনিদ্র রজনি শেষে কোনো এক শারদ ভোরের আরুষির মতো।

লেখক: পিএইচডি গবেষক ও প্রভাষক, ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, অ্যাংলিয়া রাসকিন ইউনিভার্সিটি, কেমব্রিজ

ছবি: লেখক