যান্ত্রিক জটিলতা ভুলতে ছুটে গিয়েছিলাম জঙ্গলে। যেনতেন জঙ্গল নয়, একেবারে গহিন জঙ্গলে। স্থানীয় অধিবাসী ছাড়া যেখানে আর কারও পায়ের ছাপ খুব একটা এখনো পড়েনি, যেখানে এখনো দোকান নামের প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটার কেন্দ্রটির প্রচলনই হয়নি, যারা এখনো নৌকাই দেখেনি চর্ম চোখে—গাড়ি, ট্রেন তো দূরের জিনিস!
আমাদের যাত্রাপথের ট্রেইলটা রহস্যময়, তিন পাশে পাহাড়ঘেরা এলোমেলো খাঁজের ভেতরে সরসর শব্দে বয়ে চলা টলটলে নীল পানির এক বিশাল ঝিরিপথের আবাস এই ট্রেইলে। একেকটা পথের শেষ হয় আর সেটার থেকে জন্ম নেয় আরও তিনটা নতুন পথের, বিশাল আকৃতির গোল মায়াবী পাথরগুলো কেড়ে নেয় সমস্ত মনোযোগ, ঝিরি পথের দুপাশজুড়ে গড়ে উঠেছে পাহাড়ি জনপদ-অর্ধনগ্ন স্থানীয় বাসিন্দারা আলাভোলা, সহজ–সরল। মানুষগুলোর সোজাসাপ্টা জীবনযাপন ভুলিয়ে দেয় যাত্রাপথের সব ক্লান্তি।
এই পথ দিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের নজরে এসেছে মৃত, অর্ধমৃত, জীবন্ত অনেকগুলো ঝরনা। যাদের মধ্যে ‘ঝনঝইন্না ঝরনা’, ‘তামাংঝিরি জলপ্রপাত’, ‘পালংঝিরি জলপ্রপাত’ কেড়ে নিয়েছে আর সব সৌন্দর্য।
বান্দরবানের এই ট্রেইলটা আমার কাছে অন্য সব ট্রেইল থেকে আলাদা, কারণ এই ট্রেইলে আমি মনের মতো ঘুরতে পেরেছি, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে মাছ ধরতে পেরেছি, তাদের মাটির ঘরে চাঁদনি রাত কাটিয়েছি, তীব্র শীতের মধ্যে কাঁপতে প্যান্ট-গেঞ্জি ভিজিয়ে ঝিরি পার হয়েছি, শুধু গামছা পরে উদোম গায়ে গোসল করেছি অজানা গর্তে, খিদের জ্বালায় কলাপাতা খেয়েছি পেট ভরে। অনেক কিছু পাওয়ার এই ট্রেইলের প্রতি ভালোবাসাটা তাই একটু বেশি। এই ট্রেইলে দোছড়ি পাড়ার ‘সিন্ধু মণি’ নিজের বাড়ির উঠোনে নতুন আনারস লাগিয়েছেন, ছোট আম দেখিয়ে বলেছেন, ‘এই গাছটা তোমাদের জন্য। আম পাকলেই তোমরা এসে যত পারো খেয়ে নেবা।’
সেবারের যাত্রাটা অন্য যেকোনো ভ্রমণের থেকে আলাদা ছিল। আমরা গিয়েছিলাম মোট আটজন। এমন আটজন, যাদের কাছে অসাধ্য কিছু নেই। সবাই সাঁতার পারে, পাহাড়ে উঠতে পারে, জানে রান্না করতে, মাছ ধরতে, নৌকা বাইতে। আমাদের মধ্যে কারোই ক্যামেরা ছিল না বলে আফসোসের শেষ ছিল না। তবে ট্রিপ শেষে মোবাইলের ক্যামেরায় নিয়ে আসা নীলাভ সৌন্দর্যগুলোকে এরপর যতবার দেখেছি, ততবারই মুগ্ধ হয়েছি, মুগ্ধ করেছি আশপাশের সবাইকে।
সেখানের মানুষ এই একবিংশ দশকেও অর্ধনগ্ন, রোগে-শোকে লতা-পাতার রস খায়, পানির পিপাসা পেলে গাছের ছাল ছিলে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে, গাছপাকা পেঁপের জন্য দাম দিতে চাইলে অনেকক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে ভাঙা বাংলায় বলে তিনটা পেঁপের জন্য পাঁচ টাকা দেন! বরইয়ের বাগানে গেলে বলে যা মন চায় পেড়ে খেয়ে ফেলেন। মাছ ধরতে গেলে বলে, আমরা তো সারা জীবন খাই, আপনারা এক দিনের মেহমান, ধরেন মাছ, যত মন চায় ধরেন।
এই মানুষগুলোর মনে কোনো লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ কিচ্ছু নেই যেন।
চলতে চলতে গেলাম এক পাহাড়ি পাড়ায়, নাম ‘রালাই পাড়া’, বান্দরবানের গহিনে টোয়াইন খালের ধার বেয়ে হাজার ফুট ওপরে এই পাড়ার অবস্থান। এই পাড়াটা আর সব পাড়া থেকে আলাদা একটা কারণে, এইখানে সব ধরনের মাদকদ্রব্য বহন এবং সেবন নিষিদ্ধ, পাড়ার কারবারি আমাদের আস্ত একটা খাসি জবাই দিয়ে বরণ করে নিলেন, যখন শুনলেন আমরা আন্ধারমানিক যাব, তখন চোখ কপালে তুলে বললেন সে তো অনেক দূরের পথ, কীভাবে যাবেন এত দূর! এরপর কথায় গল্পে অনেক দূর গড়াল, ভোরে তিনি একজনকে এনে আমাদের সামনে দাঁড় করালেন, বললেন, ‘এর নাম লিংক্লাং, এ আপনাদের পথ দেখাবে।’
আগের সন্ধ্যাবেলাতেই মাহফুজের হাত থেকে বাংলাদেশের পতাকা রঙের ব্রেসলেটটা খুলে নিয়ে নিজের হাতে পড়েছিল লোকটা, তখন ভালোভাবে খেয়াল করিনি। এখন দেখলাম, ভোর ছয়টার আবছা আলোতে চোখের সামনে ফুটে উঠল লিংক্লাংয়ের দেহটা।
ধুপ করে যেন গডমাস্টবিক্রেজি চলচ্চিত্রের নায়ক লাফিয়ে চলে এল আমাদের চোখের সামনে, একেবারে শীর্ণকায়, ছোটখাটো, রোদে পোড়া কঠিন দেহের মানুষটি নিজের বুকে চাপড় দিয়ে বলল, ‘লিংক্লাং, বন্ধু’... সেই থেকে সে আমাদের বন্ধু।
একজন মানুষ কীভাবে মাত্র তিন দিনে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে, কীভাবে শহুরে প্রযুক্তি আশীর্বাদপুষ্ট ছেলেগুলোর প্রাণের মানুষ হয়ে উঠতে পারে, তা শিখিয়েছে এই লিংক্লাং। ভোর ছয়টা থেকে আমরা যখন হাঁটতে হাঁটতে কাতর, ব্যাগে খাবার বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই, তখন ‘বন্ধু’ তার ঝোলা খুলে ঘর থেকে নিয়ে আসা কলাপাতায় মোড়ানো চার মুঠো গরম ভাত খুলে আমাদের আটজনের দিকে মেলে ধরে বলে, ‘খা। সবাই খেতে পারবে তো, আমি পারবে, আপনি পারবে, সব পারবে, খা।’ বড় গাছের ঘন জঙ্গলে যখন কোথাও এক ফোঁটা পানি আর নেই, সে তার দা দিয়ে একটা গাছের ছাল উঠিয়ে বলল, ‘নে, পানি আছে তো, পানি।’ চরম অবিশ্বাস নিয়ে কাঁপা হাতে বাকল নিয়ে মুখে ভরলাম, অমনি অদ্ভুত একটা মিষ্টতায় ভরে গেল মুখ, ঠোঁটের কোনা বেয়ে পানির ফোঁটা চুইয়ে পড়ল টপটপ করে। কি অদ্ভুত যোগাযোগ!
ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়া বিশাল পাতিলে স্যুপ রান্না করা হলো, কিন্তু চামচ একটা, কাজেই সিদ্ধান্ত হলো একজন করে খাবে, রাক্ষুসে খিদে নিয়ে সবাই মিলে গোল হয়ে বসলাম পাতিলের চারপাশে, অমনি শুনি ঠক ঠক আওয়াজ! বন্ধু আমাদের বাঁশ কাটছে, দেখতে অনেকগুলো গ্লাস বানিয়ে ফেলল বাঁশ দিয়ে, সঙ্গে আবার চিকন বাঁশ কেটে বানাল পাইপ। আমাদের হাতে তুলে দিয়ে স্যুপের পাতিলের দিকে ইশারা করে বলল, ‘খা।’
কী আর স্যুপ খাব! তাজ্জব হয়ে বসে রইলাম সবাই বাঁশের গ্লাস ধরে। পাইপ মুখে নিয়ে স্যুপের ভেতরে ভরে টান দিলাম, আহ, কী বিস্ময়!
*লেখাটি ভ্রমণ নিয়েপ্রথম আলোর বিশেষ আয়োজন ‘বর্ণিল বেড়ানো ২০২০’ থেকে নেওয়া