ইউরোপ ট্রিপ

বার্সেলোনাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা। হোটেলে গিয়ে খাবারের সন্ধানে আবারও সেই সেফ খাবার পায়েয়া। খেয়েদেয়ে আশপাশে ঢুঁ মারতেই দেখি বাঙালি দোকান! শিঙাড়া দেখে লোভ সামলাতে না পেরে কিনে নিয়ে খেতে খেতে শহর টহল দিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলের বারান্দা থেকে শহরের রঙিন আলো আর পুরোনো বিল্ডিংয়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মনে হলো ঘুমোনো দরকার, কাল মিলান যেতে হবে।

বার্সেলোনার পুরোনো সৌন্দর্য
ছবি: লেখক

আমাদের ফেরার রাস্তা ধরতে হচ্ছে মিলান ট্রানজিট রোমে যাওয়ার।

মিলানে ট্রেন পরিবর্তন করতেই এক ভারতীয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। তিনি এসেছেন তাঁর নতুন ইতালিয়ান গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে। ভারত থেকে অনলাইনে পরিচয়, নিজে বিপত্নীক, ডিভোর্সি। গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা হয়েছে, রোমে যাচ্ছেন রোম দেখতে। ভারতে ফেরার আগে ঘুরবেন। আমরাও রোমে ফিরে যাচ্ছি শুনে সফরসঙ্গী হয়ে গেলেন। বাকি কদিন এই বান্দাও আমাদের সঙ্গে জুড়ে গেলেন অভিভাবক হয়ে, বন্ধু হয়ে। আমাদের তাঁর বিয়ে, বিচ্ছেদ, নতুন প্রেম, পরিকল্পনা—সবকিছুর গল্প শোনালেন যে কদিন বাকি রোমে ছিলাম। আদর্শ, দর্শন, সাম্প্রদায়িকতা, সাবকন্টিনেন্টের সমস্যা কোনো কিছুই বাদ যায়নি আমাদের গল্পে। হয়তো কোনো দিন সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে আমরা আসলেই শুধু মানুষ হব! সেদিনের অপেক্ষায়। তবে সে জন্য বর্তমান নষ্ট করারও মানে হয় না।

স্বামীর সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

আমরা রোমে পৌঁছে আমাদের হোটেলে চলে গেলাম, তিনি গেলেন তাঁর হোস্টেলে কাছাকাছি কোথাও। কাল আমরা রোম ঘুরব জেনে সকাল সকাল আমাদের সঙ্গেই যাবেন জানালেন।

আবারও সেই কলোসিয়াম। রাস্তা ধরে হাটতে হাঁটতে রোমান ফোরাম, প্যালাটাইন হিল। দুপুরের খাবারও একসঙ্গে করে গেলাম পুরো রোম শহর ঘুরে বেড়াতে। হাজারো কোনা, স্কয়ার, মোড় ঘুরে রাতেই সিদ্ধান্ত হলো কাল ভ্যাটিকান সিটি যাব সবাই একসঙ্গে। এটিও আমাদের আইটেনারিতে ছিল না। ভাগ্যিস গিয়েছিলাম।

সেন্ট ব্যাসিলিকা চার্চ
ছবি: লেখক

মানবেতিহাস আমার কাছে ফ্যাসিনেটিং। ধর্ম, বর্ণ, মান, অভিমান আমার কাছে তুচ্ছ অথচ পৃথিবীর কাছে মূল্যবান! হানাহানি, হিংসা আর ভেদাভেদ দুনিয়ার আসল চালিকা শক্তি। সে জন্যই এত ভেদাভেদ। যতই ধর্ম, বর্ণ বা যা-ই নাম দিই, তার সে আমাদের ইগো, অহংকার, নিজেকে বড় আর সবাইকে তুচ্ছ ভাবার কারণ, আমার মতে।

ভ্যাটিকান!

সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের একাংশ
ছবি: লেখক

দুনিয়ার সবচেয়ে ছোট কিন্তু অসীম শক্তির অধিকারী একটি রাষ্ট্র! দুনিয়ার সব খ্রিষ্টান রাষ্ট্রপ্রধান এখানে এসে মাথা নিচু করে পোপের আশীর্বাদ নেন। ঠিক ধরেছেন! পোপের আবাস এখানেই। একটুখানি বাগানের মতো একটা জায়গা এ দেশটিরই অসীম ক্ষমতা! ক্যাথলিকদের তীর্থস্থান। দেশটির প্রধান পোপ। রংচংয়ে পোশাকের পুলিশ। মুসলমানদের কাছে মক্কা যা, খ্রিষ্টানদের কাছে ভ্যাটিকান তাই।

সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা চার্চ এখানে। ইউরোপের প্রতি শহরে যেখানেই চার্চে লোক যেতে দেখেছি, তাদের পিছু পিছু গিয়ে ভেতরের ডেকোরেশন দেখে এসেছি। কিন্তু এই সেন্ট পিটার্স চার্চের কাছে যেকোনো চার্চ ম্রিয়মাণ। কত বিলিয়ন ডলার এর পেছনে খরচ হয়েছে, ভেবেই মনে হলো ভুল ভাবছি। অতগুলো শূন্য গোনাও আমার মতো গরিবের পক্ষে অসম্ভব!

সেন্ট ব্যাসিলিকা চার্চের ভেতরে
ছবি: লেখক

না, পোপের সঙ্গে দেখা আমার হয়নি। আমরা ভ্যাটিকানে ঘোরাঘুরি শেষ করে বাইরের দোকানগুলো থেকে স্যুভেনির কিনে রোমে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলটা রোমের পিয়াজাগুলোতে ঢুঁ মারতে গেলাম। পিয়াজাগুলো যেন একেকটা চক। বিক্রেতারা বাঙালি।

ভ্যাটিকানের দর্শনার্থীরা
ছবি: লেখক

সন্ধ্যায় আবারও সেই রোমান ফোরামে বসে আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখছি শেষবারের মতো রোম শহর দেশে ফেরার আগে। গল্প করছি নবপরিচিত ভারতীয় বন্ধুর সঙ্গে। তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য মঙ্গল কামনা করে ডিনার শেষে রাতে হোটেলে ফিরলাম।
কাল সকালে আমাদের আপাতত ইউরোপ যাত্রা শেষ! ঘরে ফেরা, নীড়ে ফেরা। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি অপার মুগ্ধতা! পরে এলে আমাদের শিশুদের আনতে হবে। সেই ‘পরে’র প্রত্যাশায় স্বপ্ন নিয়ে ফিরতি ট্রেনে চড়ে বসলাম—এয়ারপোর্ট!