করোনার ভয়াল থাবা যেন আজ থমকে দিয়েছে মানুষের জন্মগত সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে। পুরো পৃথিবীকে যেনও সে এক হতাশার চাদরে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সংক্রমণ এড়ানোর জন্য বিকল্প কোনো উপায় নেই বলেই বাধ্য হয়ে আমাদের নিজেদের গৃহে বন্দী করে ফেলতে হচ্ছে। একদিকে প্রতিদিন সমগ্র পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ নতুন করে এ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছেন, অন্যদিকে ঝরে যাচ্ছে হাজারো প্রাণ।
তবুও একদল মানুষ আছেন, যারা কিনা কোনো ধরনের প্রতিকূলতার কাছে হার মানতে চান না। করোনা তাঁদের জীবনের গতিপথকে রোধ করতে পারে না কোনোভাবে। সব ভয় আর সব ঝুঁকিকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা ছুটে চলেন দূরের কোনো পাহাড়ে, যেখানে আকাশ নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে। করোনার ভয় তুচ্ছ করে আমিও সে দলে নাম লেখালাম।
ইউরোপের মাটিতে পা রাখার পর যেন নিজেকে পরিব্রাজক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এক আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল। তাই একটু একটু করে বেরিয়ে পড়লাম ইউরোপকে আবিষ্কার করার লোভে।
স্লোভেনিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুলটাইম শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে এবং একই সঙ্গে স্লোভেনিয়ার অস্থায়ী রেসিডেন্ট পারমিট থাকার সুবাদে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও সেন জেনের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর দরজা ছিল আমার কাছে ভ্রমণের জন্য সব সময় খোলা। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কিংবা সেন জেনের বাইরেও কিছু দেশ রয়েছে, যেখানে যাতায়াত করতে আমার কোনো ধরনের ভিসার প্রয়োজন পড়বে না। একসঙ্গে এতগুলো দেশ ঘোরার সুযোগ যেহেতু এসেছে, সেটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করব না, তা কি হয়?
তবে ছোটবেলা থেকে আমার মধ্যে গ্রিস ভ্রমণের স্বপ্ন ছিল। ক্লাস ফাইভে থাকতে শিখতে হয়েছিল, ইউক্লিডকে বলা হয় আধুনিক জ্যামিতি শাস্ত্রের উদ্ভাবক। এরপর তাঁর ছাত্র থেলিস এবং পরবর্তী সময়ে পিথাগোরাসের মাধ্যমে জ্যামিতি শাস্ত্রের উৎকর্ষ সাধিত হয়। ইউক্লিড, থেলিস ও পিথাগোরাস—এ তিনজনই ছিলেন গ্রিক, অর্থাৎ গ্রিসের অধিবাসী। এরপর আর একটু বড় ক্লাসের সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের মাধ্যমে জানতে পারলাম গ্রিক সভ্যতার কথা, যেটি এ বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সভ্যতার মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত। জানতে পারলাম সক্রেটিস, প্লেটো, থিওফ্রাটাস, অ্যারিস্টটল, আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট, অ্যারিস্টার্কাসসহ বিশ্ববরেণ্য অনেক মনীষীর কথা, যাঁদের কাছে এ মহাবিশ্ব চিরকালের জন্য ঋণী থাকবে। অর্থনীতি, পৌরনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান অর্থাৎ জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে শাখার কথাই বলি না কেন, সবকিছুতে গ্রিকদের অবদানের কথা জানতে পারি। এসব পরিচিতির বাইরেও গ্রিসের পরিচিতি রয়েছে, যেটা আমরা হয়তোবা সেভাবে জানি না।
গ্রিস হচ্ছে পূর্বাঞ্চলীয় অর্থোডক্স খ্রিস্টানিটির প্রধান তীর্থভূমি। একই সঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত গ্রিস ছিল পূর্ব ইউরোপের একমাত্র দেশ, যেখানে কমিউনিজমের কোনো ধরনের প্রভাব ছিল না। এ কারণে গ্রিস বলকান উপদ্বীপের অন্যান্য দেশ থেকে একেবারে স্বতন্ত্র। অথচ দেশটি ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে অনেক দেরিতে।
যদিও গত এপ্রিলে গ্রিসের রাজধানী এথেন্স এবং অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন দ্বীপ সান্তোরিনি যাওয়ার টিকিট কিনেছিলাম। কিন্তু করোনার কারণে সেবার গ্রিস ভ্রমণের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হয়েছিল।
গত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে জুনের দিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও তখন সেভাবে বিমান চলাচল স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। এর ফলে কোনো ঈদেই দেশে যেতে না পারার হতাশা, সেমিস্টার ফাইনালের ফল খারাপ হওয়া—এই সবকিছু নিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম গ্রিস ভ্রমণে বের হব। নতুন সেমিস্টার শুরুর আগের সপ্তাহকে বেছে নিলাম গ্রিস ভ্রমণের।
গ্রিসে যাওয়ার জন্য যেহেতু আগেই প্লেনের টিকিট কেনা হয়েছিল, তাই এবার নতুন করে আর টিকিট কিনতে হলো না। তবে করোনার কারণে গ্রিসের মূল আকর্ষণ অর্থাৎ গ্রিসের পর্যটন দ্বীপগুলো ভ্রমণের যে সুপ্ত বাসনা দীর্ঘদিন ধরে মনের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলাম, সেখান থেকে আপাতত সরে আসতে হয়েছিল।
গ্রিসে মূলত চারটি স্থানের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। প্রথম স্থানটি হচ্ছে রাজধানী এথেন্স, দ্বিতীয় স্থানটি হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর থেসালুনিকি বা সেলোনিকা, তৃতীয় স্থানটির নাম মিকোনোস এবং সর্বশেষ যে জায়গাটিতে যাওয়ার জন্য আমি বিশেষভাবে আগ্রহী তার নাম হচ্ছে সান্তোরিনি। তবে এবারের গ্রিস ভ্রমণ সেলোনিকা এবং এথেন্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছিল।
স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ইয়োজে পুচনিক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টটি হচ্ছে দেশটির একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তবে এর অবকাঠামো খুব বেশি একটা আশানুরূপ না হওয়ায় এবং একই সঙ্গে আয়তনে খুব বেশি বড় না হওয়ায় এখান থেকে তেমন একটা ফ্লাইটের দেখা মেলে না। সপ্তাহে হাতে গোনা কয়েকটা ফ্লাইট পরিচালিত হয় এ এয়ারপোর্ট থেকে। উল্লেখ করার মতো ফ্লাইট বলতে টার্কিশ এয়ারলাইনের ফ্লাইট, যেটি লুবলিয়ানা থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের অভিমুখে যাত্রা করে। লুবলিয়ানা থেকে এথেন্স কিংবা সেলোনিকার সরাসরি ফ্লাইট না থাকায় অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা থেকে গ্রিসের উদ্দেশে রওনা হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। রায়ান এয়ারে ভিয়েনার শোয়েচাট এয়ারপোর্ট থেকে থেসালুনিকি যাওয়ার টিকিটের দাম ছিল মাত্র ১১ ইউরো।
রায়ান এয়ার আমাকে ভাউচার আকারে আগের অব্যবহৃত টিকিট রিফান্ড করেছিল, যেটি ব্যবহার করে আমি অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা থেকে গ্রিসের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী থেসালুনিকিতে ফ্লাইটের টিকিট করি।
স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার দূরত্ব ৪০০ কিলোমিটারের মতো। বাসে লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনা পৌঁছাতে পাঁচ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। অন্যান্য সময় লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনায় পৌঁছানোর জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর বাস কিংবা ট্রেন পরিষেবা চালু থাকলেও করোনার কারণে এখন সে পরিষেবা অনেকটা সংকুচিত করে আনা হয়েছে। হয়তোবা এখন দিনে শুধু একটা বাস কিংবা একটা ট্রেন ছেড়ে যায় ভিয়েনার উদ্দেশে লুবলিয়ানা থেকে। ট্রেনে যাতায়াতের ক্ষেত্রে অনেক সময় নির্দিষ্ট স্টপেজ অন্তর অন্তর নেমে ট্রেন পরিবর্তন করতে হয়। গণপরিবহন সেবার মান সে অর্থে আশানুরূপ না হওয়ায় স্লোভেনিয়ায় সাধারণ মানুষ কার রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলোর ওপর বেশি নির্ভর করে দূরবর্তী কোনো গন্তব্যে যাতায়াতের ক্ষেত্রে।
২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার দিকে রওনা হলাম লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনার উদ্দেশে। এ যাত্রায় ভিয়েনা পৌঁছানোর জন্য স্থানীয় একটি কার রাইড শেয়ারিং কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। যাতায়াত ভাড়া পড়েছিল ৩০ ইউরোর মতো। যে মাইক্রোবাসে করে আমরা ভিয়েনার অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেটি ছিল আটজনের বসার মতো। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে একসঙ্গে চারজনের বেশি যাত্রীকে যাতায়াতের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
স্লোভেনিয়ার সঙ্গে অস্ট্রিয়ার সীমান্তের দৈর্ঘ্য ৩৩০ কিলোমিটারের মতো। এ ৩৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সীমান্ত এলাকায় হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি পয়েন্ট হচ্ছে যেকোনো দেশের নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত। বাকি পয়েন্টগুলো শুধু স্লোভেনিয়া ও অস্ট্রিয়ার নাগরিকেরা ব্যবহার করতে পারে। স্লোভেনিয়া থেকে অস্ট্রিয়ায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বর্ডার চেকপোস্টে আমাদের গাড়ি থামাতে বলা হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সীমান্তবর্তী চেকপয়েন্টগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ়।
অস্ট্রিয়ার সীমানায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাদের গাড়ি থামিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করে আলাদাভাবে কেন এ রকম একটি মুহূর্তে আমরা অস্ট্রিয়া যেতে চাচ্ছি। এরপর আমাদের সবার পাসপোর্টসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট চেক করে এবং আমরা যারা অস্ট্রিয়াতে প্রবেশ করেছি আমাদের সবার নাম ও আইডি নম্বর তাদের ডেটাবেইসে লিপিবদ্ধ করে।
স্লোভেনিয়া, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া—এসব দেশে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয় বলকান রাষ্ট্র বিশেষ করে সার্বিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়ার অভিবাসীদের মাধ্যমে। আমাদের গাড়িতে দুজন যাত্রী ছিলেন বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার অধিবাসী। অস্ট্রিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ তাঁদের কোনোভাবে অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করতে দিতে চাচ্ছিল না। বিশেষত করে তাঁদের কাছে করোনার নেগেটিভ সনদ না থাকায় সমগ্র পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছিল। পরে অবশ্য ১০ দিনের কোয়ারেন্টিনের শর্ত দিয়ে তাঁদের অস্ট্রিয়ায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
ভিয়েনা পৌঁছাতে আমাদের প্রায় রাত ১২টা বাজে। বুধবারের সে রাতটা আমার এক বড় ভাই পারভেজ মাহফুজের বাসায় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিই। ২৫ সেপ্টেম্বর থেসালুনিকির উদ্দেশে আমার ফ্লাইট।
লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।