ক্ষুদ্র দেশ ভ্যাটিকানে

পর্যটকদের সহজে চলাচলের সুবিধার্থে ইতালির রোম নগরীতে ‘হোপ অন হোপ অফ’ নামের বাস সার্ভিস রয়েছে। মূলত দ্বিতলবিশিষ্ট এসব বাসের ওপর ছাদ নেই। তাই পর্যটকেরা সহজেই বিভিন্ন স্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পটগুলো দেখে দেখে পুরো নগরী ভ্রমণ করে থাকেন। আর যেখানে মন চায়, সেখানে নেমে যান। আমাদের বাস ভ্যাটিকান সিটির প্রবেশমুখে আসতেই নেমে পড়লাম চটপট।

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় এই দেশের নাম জেনেছিলাম আমি। সেই থেকে মনে মনে দেশটি ভ্রমণের সংকল্প আমাকে পেয়ে বসেছিল। যাহোক, ইতালিতে এসে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম নগররাষ্ট্র ভ্রমণের সুযোগটি হাতছাড়া করলাম না।

তিবের নদীর কূল ঘেঁষে ভ্যাটিকান সিটি অবস্থিত। এই নদী পুরো রোম নগরীর মাঝবরাবর চলে গেছে। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটি। দেশটি আসলে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান তীর্থস্থান। মাত্র ৪৯ হেক্টর আয়তনের এই ক্ষুদ্র দেশে জনসংখ্যা কমবেশি ৮২৫–এর মতো। পোপশাসিত এই দেশের প্রধান হলেন পোপ ফ্রান্সিস, যিনি জন্মসূত্রে আর্জেন্টাইন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি খ্রিষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ‘পোপ’ (২৬৬তম) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯২৯ সালে ইতালির সরকারের সঙ্গে লাতেরান চুক্তির আওতায় এই পোপীয় রাষ্ট্রের সৃষ্টি।

সেন্ট পিটার্স স্কয়ার
ছবি: লেখক

সিটির প্রবেশমুখের একটু আগে হাতের বাঁ দিকে বিখ্যাত চিত্রকর লেওনার্দো দা ভিঞ্চির স্মরণে ‘মিউজিও লেওনার্দো দা ভিঞ্চি এক্সপেরিয়েন্স’ নামের একটি গ্যালারি চোখে পড়ল। রাস্তার দুপাশে সারি সারি ভ্রাম্যমাণ দোকান বসিয়েছেন বিভিন্ন দেশের অভিবাসীরা। তাঁরা সেখানে বিভিন্ন স্যুভেনির বিক্রি করছেন।

নগরীর প্রবেশমুখে দাঁড়ালে একটি বিশাল আকৃতির অট্টালিকা চোখে পড়ে। এটি হলো সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা, ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থস্থান। কোনো পোপ মারা গেলে অথবা অবসরে চলে গেলে এই অট্টালিকার ব্যালকনি থেকেই নতুন নির্বাচিত পোপ দেখা দেন। এই দৃশ্য দেখার জন্য সারা পৃথিবীর মানুষ টেলিভিশনে চোখ রাখেন। আর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাথলিক ধর্মীয় নেতারা এ দেশে এসে জড়ো হন।

১৬২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশাল ও প্রাচীন অট্টালিকা বিশ্ব ঐতিহ্যগুলোর একটি
ছবি: সংগৃহীত

১৬২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশাল ও প্রাচীন অট্টালিকা বিশ্ব ঐতিহ্যগুলোর একটি। প্রায় ২০ হাজার মানুষের সমাগম হতে পারে এ দালানে। অট্টালিকাটির সামনে যে বিশাল মাঠ, তাকে বলা হয় সেন্ট পিটার্স স্কয়ার।

ভ্যাটিকান মিউজিয়াম
ছবি: লেখক

এক পাশে রয়েছে মিউজিয়াম, আরেক পাশে রয়েছে ভ্রমণকারীদের জন্য তথ্যকেন্দ্র এবং স্কয়ারের দুপাশে দুটি বিশাল আকৃতির পানির ফোয়ারা। এই দেশে রয়েছে মাত্র ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র রেলপথ, যার নাম সিটাডেল ভ্যাটিকানো। তবে এই রেল কোনো যাত্রী বহন করে না, মালামাল বহন করে শুধু। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বর্ণের নারী-পুরুষ-শিশু–যুবা এসেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটি পরিদর্শনে। প্রতিবছর এই দেশে ভ্রমণ করেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রায় সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন মানুষ।

আমাদের পেছনে কিছু ধর্মীয় যাজককে দেখলাম। তাঁরা দর্শনার্থীদের আশীর্বাদ করে দিচ্ছেন। দেশটি খুব ক্ষুদ্র হতে পারে, কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে যা যা থাকা দরকার, তার প্রায় সবকিছুই আছে এ দেশে। আছে নিজস্ব পতাকা, মানচিত্র, নিজস্ব টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও। পৃথিবীর প্রায় ৪০টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় তাদের রেডিও থেকে ধর্মীয় বাণী প্রচার করা হয়ে থাকে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্যাথলিক গির্জাগুলো এই পোপীয় রাষ্ট্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

তিবের নদীর কূল ঘেঁষে ভ্যাটিকান সিটি অবস্থিত
ছবি: লেখক

ভ্যাটিকান সিটি নগররাষ্ট্রটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত নয়, কিন্তু সেনজেনভুক্ত। এ ধরনের আরও চারটি রাষ্ট্র রয়েছে—আন্দোরা, মোনাকো, সান মেরিনো ও লিচেনস্টেইন। এসব দেশে প্রবেশ করতে নতুন করে কোনো ভিসা লাগবে না। তবে এই দেশ ২০০৪ সাল থেকে ইউরোকে মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করেছে আর এর অফিশিয়াল ভাষা হচ্ছে লাতিন।

সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার একপাশে দেখলাম সুইচ গার্ডের দুজন সদস্য। লাল, হলুদ ও নীল—এই তিন বর্ণ দিয়ে তৈরি একটি অদ্ভুত ইউনিফর্ম পরা ২৫–৩০ বছরের যুবক। একটি বিষয় আপনাদের জানিয়ে রাখি, ভ্যাটিকান সিটির যাঁরা নিরাপত্তা দেন, তাঁদের বলা হয় সুইচ গার্ড। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী এটি, সদস্যসংখ্যা মাত্র ১৩৫।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সুইচ গার্ডের সব সদস্য সুইজারল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী যুবক। প্রায় আধা ঘণ্টা পর খেয়াল করলাম, সুইচ গার্ডের কয়েকজন সদস্য একজন দলনেতার নেতৃত্বে মার্চপাস্ট করে এগিয়ে আসছেন গার্ডরুমের পাশ থেকে। আমি ছবি তুলতে চাইলে আমার বন্ধু বারণ করলেন, অনুমতি ছাড়া তাঁদের ছবি তোলা ঠিক হবে না।

ফোয়ারার সামনে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

ভ্যাটিকান সিটিতে রয়েছে সুন্দর একটি বাগান। সবুজের মধ্যে বিভিন্ন রঙের ফুলে ছেয়ে আছে সেটি। দর্শনার্থীরা বসে, দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। ভ্যাটিকানের বিখ্যাত জাদুঘরে রয়েছে ইতালিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত সব চিত্রকরের অঙ্কিত ছবি, বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য, ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মের ইতিহাস, ঐতিহ্যসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম। নিঃসন্দেহে যেকোনো ভ্রমণকারীর ভালো লাগবে এটি ঘুরে দেখতে।
হাঁটতে হাঁটতে গলা শুকিয়ে গেল। একটু দূরে দেখলাম বিভিন্ন রঙের ফুল দিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করা হচ্ছে। বিক্রেতাকে একটু বয়স্ক মনে হলো। দেখে মনে হয়, অনেক দিন ধরে এখানে আইসক্রিম বিক্রি করছেন তিনি। ছয় ইউরো দিয়ে দুটি আইসক্রিম হাতে নিয়ে দুই বন্ধু ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম ভ্যাটিকানের বিভিন্ন স্থাপনা।


লেখক: উপসচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।