চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ছোট বোন প্রমিলা খাড়কির কীর্তিপুরের বাড়ির ছাদে সান্ধ্য আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। দূর পাহাড় থেকে আসা ঠান্ডা বাতাস আর চারপাশের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে পারিবারিক আবেগময় গল্প তখন অন্য মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। আড্ডা-গল্পের একফাঁকে উঠে এল নেপালের ঐতিহ্যবাহী গাই–যাত্রা উৎসবের কথা। প্রমিলা বলল, এটি মূলত নেপালের নেওয়ার সম্প্রদায়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।
এই উৎসব নেপালি ভাদ্র মাসে পড়ে (সৌর ক্যালেন্ডারে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি) এবং ৮–১০ দিন ধরে চলতে থাকে। মূলত বিগত বছরের মৃত ব্যক্তিদের স্মরণে কাঠমান্ডু উপত্যকায় নেওয়ার সম্প্রদায় গাই পূজা করে থাকে। তবে নেওয়াররা ছাড়াও এ উৎসবে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সবাই বেশ হাসিখুশিভাবে গৌরবের সঙ্গেই অংশগ্রহণ করে থাকে। তাই আকর্ষণীয় এই উৎসবের সময় নেপালি ঐতিহ্যবাহী গান, লাঠিনাচ, কমেডি ইত্যাদি দেখা যায়। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বোন প্রমিলা খাড়কি বলল, আমাকে সে এবারের গাই–যাত্রায় নিয়ে যাবে।
ঘুম থেকে খুব ভোরে উঠে কোনোমতে প্রস্তুতি নিয়ে মধু, ডিম, আলুর দম, হিমালয়ের চমরী গাইয়ের দুধের পনির, পাউরুটি ও চা দিয়ে নাশতা সেরে প্রমিলা খাড়কি, সুস্মিতা অধিকারী, রুদ্র সুবেদী, রোহিত গিরি ও আমি ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কীর্তিপুরের নেওয়ারদের এলাকার উদ্দেশে। গিয়ে দেখি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রঙিন টুপি, মুখোশ ও কাপড় পরে রাস্তায় খেলা করছে এবং হাঁটছে, স্থানীয় নেওয়াররা সংগৃহীত নদীর পানি দিয়ে গরুকে গোসল করাচ্ছে, বিশেষ করে সেগুলোর লেজ, পায়ের খুর বেশি করে পরিষ্কার করছে। গোসল করানোর পর গরুকে লাল টিকা ও সুন্দর মালা দিয়ে সাজানো হলো এবং প্রচুর সবুজ তাজা ঘাস ও ছোলার ভুসি খাওয়ানো হলো।
এরপর কিছু ঘরোয়া আচার–অনুষ্ঠান ও পূজা শেষে মিছিল করে গরুকে কাঠমান্ডু উপত্যকায় নিয়ে যাওয়া হলো কুচকাওয়াজের জন্য। স্থানীয় একজন নেওয়ারের কাছে জানা গেল, গরু না পাওয়া গেলে ছোট ছেলেরা গরুর মতো পোশাক পরে এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে প্রার্থনা করে থাকে। যাহোক, হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখলাম, অনেকেই নানা রকম মুখোশ পরে উত্তেজিত হয়ে মিছিলে ঢুকে পড়েছে এবং তারা ইচ্ছাকৃতভাবে মন্দির, দেবতাদের মূর্তি ও অন্যান্য পবিত্র স্থানের মধ্য দিয়ে হাঁটল। যখন কুচকাওয়াজ পাশ দিয়ে গেল, তখন অনেকেই গরুর মালিকদের ও মুখোশ পরা ছেলেদের খাবার, উপহার ও নগদ অর্থ প্রদান করল। এটা বিশ্বাস করা হয় যে এই ধরনের দান নাকি তাদের পরবর্তী দিনগুলোতে সৌভাগ্য বয়ে আনে।
খানিকটা বিশ্রামের জন্য ভিড় ঠেলে কুচকাওয়াজ ও বিভিন্ন জটলা পেরিয়ে প্রাচীন এক মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মনে হলো, মন্দিরের গভীর প্রাচীনতা ও আধ্যাত্মিকতা আমাদের এর সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। ওদিকে রোহিত গিরি তখন উৎসবের নানা আঙ্গিকের ছবি তোলায় মহাব্যস্ত; এই ফাঁকে রুদ্র সুবেদী নেপালি গাই–যাত্রার পটভূমি সম্পর্কে আমাকে গল্পের ছলে বলে যেতে লাগল। সপ্তদশ শতাব্দীতে নেপালের রাজা প্রতাপ মাল্লা তাঁর ছোট ছেলেকে হারিয়েছিলেন। রানি মনের দুঃখে সারা দিন কেঁদেছিলেন।
তাই রানিকে উজ্জীবিত করার জন্য রাজা এই গরু উৎসব বা গাই–যাত্রার আয়োজন করেছিলেন। রঙিন পোশাক পরা লোকজন ও সজ্জিত গরু হলো একটা নির্দিষ্ট বছরের মৃত ব্যক্তিদের প্রতীক। রাজা শুধু চেয়েছিলেন রানি বুঝুক যে তিনিই একমাত্র নন, যিনি আত্মীয়স্বজন হারিয়েছেন, বরং অনেক মানুষই তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে। মৃত্যু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা এবং এটি কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। যাত্রা, বাদ্যসংগীত, মুখোশনৃত্যের মাধ্যমে তাই সেই গাই–যাত্রা অনন্য হয়ে উঠেছিল। উৎসবের বিভিন্ন আয়োজনে রানি শেষ পর্যন্ত হেসেছিলেন এবং তাঁর ছেলে হারানোর ক্ষতি মেনে নিয়েছিলেন।
রুদ্র আরও যোগ করল, হিন্দুধর্মের প্রাচীন কিংবদন্তি অনুসারে মৃত্যুর দেবতা যমরাজ এই দিনে স্বর্গের প্রবেশদ্বার রক্ষার জন্য কালো কাক পাঠাতেন। গেটের ঠিক বাইরে লাখ লাখ আত্মা যমের বিচারকে গ্রহণ করার জন্য অপেক্ষা করত এবং তাদের পুনর্জন্ম সম্পূর্ণভাবে তাদের অর্জিত যোগ্যতা দ্বারা নির্ধারিত হতো।
পৌরাণিক কাহিনিতে স্বর্গের রাস্তাটি অনুসরণ করা অত্যন্ত কঠিন ছিল এবং এখানে মৃত ব্যক্তিকে জ্বলন্ত নদী পার হতে হবে। তাই নেওয়াররা ছাড়াও বেশির ভাগ নেপালি বিশ্বাস করে, যদি তাদের আত্মীয়রা গরুর পাল ধরতে পারে, তাহলে স্বর্গযাত্রা অনেক সহজ হয়ে যাবে এবং স্বর্গের দরজা বছরে শুধু একটি দিনের জন্য মৃত ব্যক্তিদের জন্য খোলা থাকে। অতএব প্রতিটি পরিবার, যারা গত বছর প্রিয়জনকে হারিয়েছে, তাদের কাঠমান্ডুতে এই বিশাল গাই–যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে হবে।
যাহোক, গান ও নাচের তালে তালে মিছিলে এগিয়ে চলেছে। আমরাও তার পেছনে আবারও হাঁটতে শুরু করলাম। মিছিলটি শহর প্রদক্ষিণ করে শহরতলির বিভিন্ন অংশ ও অলিগলিতে প্রিয়জনদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি দেখানোর জন্য গেল। প্রিয়জনেরা ফল, মিষ্টি ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী ছোট ছোট প্যাকেটে করে উপহার দিল মিছিলের সবাইকে। গলির মাঝে বা ফাঁকা জায়গায় রংবেরঙের মুখোশ পরে ঘিতাং ঘিসি নামে একটি চমৎকার সাংস্কৃতিক নৃত্যও হলো। এ ছাড়া লাঠির লড়াই, জাদুর খেলা, পলো দিয়ে আটকে ফেলাসহ বিভিন্ন আকর্ষণীয় আয়োজন এই উৎসবকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছিল। নাচ, গান, বাদ্যবাজনা, হাসি-আনন্দের মধ্য দিয়ে তাই গাই–যাত্রা অংশগ্রহণকারীদের মনকে খুশি ও আন্তরিকতায় ভরিয়ে তুলেছিল।
গাই–যাত্রার দীর্ঘ মিছিল ও নানান আয়োজন থেকে বেরিয়ে একসময় আমাদের মনে হলো, পেছনের ভিড়ের মধ্যে রেখে এলাম একটা সম্প্রদায়ের গভীর বিশ্বাস, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বৈচিত্র্যময় মুহূর্তগুলোকে। এসব অসাধারণ মুহূর্ত পরম যত্ন জমে রইল গভীর স্মৃতির মণিকোঠায়!
ছবি: লেখক