ডিগ্রি কা লাড্ডু

মিউনিখ শহর
ছবি: উইকিপিডিয়া

১.
আঙুল গুনে বলতে গেলে বেশ ক’বছর আগের কথা। ডানে-বামে বসা মেয়ে দুটো ফ্যাচফোচ করে কাঁদছে। ইনুনি–বিনুনি দিয়ে মরাকান্না জুড়ে দেওয়ার কী হলো বুঝলাম না। পরীক্ষা তো আমারও খারাপ হয়েছে। বিরক্তিটা চেপে খাতা-কলম গুছিয়ে বেরিয়ে এলাম গ্রোসহাডের্ন হাসপাতালের লেকচার হল থেকে। মেয়েগুলোও বেরিয়েছে। রুমালে নাক মোছার ফোঁওওৎ শব্দে করিডোরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। জোরসে পা চালিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি।  

হাসপাতালের কাছে রেলস্টেশন
ছবি: উইকিপিডিয়া

টোস্টার বিল্ডিং ছেড়ে স্টেশনের কাছের বেঞ্চিটায় এসে বসেছি। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রোসহাডের্ন হাসপাতালটা এখান থেকে আসলেই পাউরুটির টোস্টারের মতো দেখায়। যেন এই বুঝি স্প্রিং করে মচমচে পাউরুটি লাফিয়ে উঠবে। কার মাথায় যে এমন বলিহারি নকশার বুদ্ধি এসেছিল। এখানে রোগী আসবে আর এপিঠ–ওপিঠ ভাজা ভাজা হতে থাকবে। হাসপাতালটিকে লোকে চেনেও টোস্টার বিল্ডিং নামে। বানিয়ে বলছি না এক রত্তি।

রোগী না হয়েও এই মুহূর্তে কান থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ফেল মানে নির্ঘাৎ ফেল। প্রায় সাদা খাতা জমা দিয়ে এসেছি। পিএইচডি করতে এসে যে ছয় মাস অন্তর পরীক্ষায় বসতে হবে, এমনটা জানা থাকলে এত হুজ্জত করে এই জার্মান দেশে আসতামই না। তা–ও আবার ওপেন বুক কায়দায় পরীক্ষা। নামকরা মেডিসিন জার্নালে ছাপা হওয়া একটা সায়েন্টিফিক পেপার সবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন সব সেখান থেকেই করা। তারপরও লাড্ডু মেরে এলাম।

‘এই পেপারে যে এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে, সে ব্যাপারে তোমার মতামত কী? পরীক্ষাগুলো আর কীভাবে করলে আরও ভালো হতো বলে মনে করো? কী কী ফাঁক রয়ে গেছে সংক্ষেপে বলো…’ ইত্যাদি। সারা জীবন বইয়ের পাতা চিবিয়ে মানুষ হয়েছি। পেটভর্তি পুঁথিগত বিদ্যা। নিজস্ব মতামতটা যে কী বস্তু, সেটা তিন কোনা নাকি চার কোনা, লাল না নীল—এর কিছুই ঠাহর করতে না পেরে আবোল–তাবোল আর হযবরল কী সব লিখে দিয়ে এসেছি।

তিরিক্ষি মেজাজে মুখ ভচকে আছি। এর ভেতর মেয়েগুলো আবার এসে জুটেছে। আনা আর আন্দ্রেয়া। কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে বোলতার কামড় খাওয়া চেহারা হয়েছে তাদের। ‘আমাদের এত স্ট্রেস দেওয়ার জন্য পুরো গ্র্যাজুয়েশন স্কুলকে সু করা উচিত না, বলো?’। জবাব না দিয়ে কি করে পাশ কাটানো যায়, ভাবছি। বহু কষ্টে এই অবধি আসা। শ খানেক প্রফেসর আর ডজন ডজন রিসার্চ স্কুল বরাবর দরখাস্তের পর বহু আরাধ্য স্কলারশিপ একখানা জোটানো গেছে। এখন সু–টু করে পিএইচডি করার সুযোগটা এক্কেবারে ঘেঁটে দিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরলে আর মুখ দেখানো যাবে না। ছি–ছিৎকার পড়ে যাবে।

পাউরুটির টোস্টার আকৃতির গ্রোসারডের্ন হাসপাতাল, মিউনিখ
ছবি: উইকিপিডিয়া

‘আমি আর এখানে পড়বই না, ছেড়েছুড়ে বাড়ি চলে যাব একদম।’ আনার কথাটা শুনে দুঃখের ভেতরেও হাসি পেল। বললাম, ‘তোমার বাড়ি তো জার্মানিতেই, তুমি আর যাবে কই? যাবার তো কথা আমার। ওয়ানওয়ে টিকেট কেটে ভোঁ বাংলাদেশ।’

আনা ক্ষান্ত না দিয়ে বলেই চলল, ‘গবেষণা–টবেষণা আমাকে দিয়ে হবে না। গ্রামে ফিরে গিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে ভেড়ার খামারই করব। ব্ল্যাক ফরেস্টের এক অজগাঁয়ে খামারবাড়ি আছে। প্রচুর ভেড়া আমাদের।’ চুপ করে গাঁজাখুরি কথাবার্তা শুনে যাচ্ছি। দেশে গিয়ে কবুতর কিংবা ব্রয়লার মুরগির ফার্ম দেওয়ার বুদ্ধিটা হালকা ঝিলিক মেরে গেল। তবে তার আগে তো রিকশাওয়ালার সঙ্গে বিয়েটা ঠেকাতে হবে।

আমাদের অতি শোকের বিশেষ কারণ আছে। গুজব শোনা যাচ্ছে, এটা প্রকারান্তরে একটা স্ক্রিনিং টেস্ট। এই পরীক্ষায় যারা ডাব্বা মারবে, তাদের মানে মানে বিদায় করে দেওয়া হবে। মুশকিলে পড়লাম। স্কলারশিপ তো দেখছি স্বাধীনতার মতো নাজুক। স্বাধীনতা নাকি অর্জনের চাইতে রক্ষা করা কঠিন। বৃত্তি একটা কোনোমতে বাগিয়ে হাজার মাইল ঠেঙ্গিয়ে পড়তে আসার পর এখন যদি এরা পরীক্ষা নামক মিহি ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ফেলে দিতে চায়, তাহলে গলায় মাদুলি ঝুলিয়ে সন্ন্যাসী বনে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।

অন্য পাশ থেকে গ্রোসারডের্ন হাসপাতাল, মিউনিখ
ছবি: উইকিপিডিয়া

কিন্তু যা হওয়ার তা হয়ে গেছে বোধ হয়। নিরুপায় যে যার মতো বেঁকেচুরে কেতরে বসে আছি। কারও কাঁধ ঝুলে গেছে, কারওবা মাথায় হাত মাতমের ভঙ্গিতে। পলকবিহীন শূন্য দৃষ্টিতে মাছের মতো কোন দিকে যেন তাকিয়ে আছি। সময়জ্ঞান আর নেই। দূরের গির্জায় ঘণ্টা বাজল ঢং ঢং। এমন সময়ে আচমকাই ভুঁইফুড়ে এক চিড়িয়ার উদয়। আপাদমস্তক কালো আলখাল্লা আর গলায় ঝোলানো বিশাল ক্রুশটা দেখে পরিচয় বুঝতে অসুবিধা হলো না। সন্ন্যাসের নাম নেওয়ামাত্র সন্ন্যাস হাজির।

আন্দ্রেয়ার ফরসা হাতে গাছের শিকড়ের মতো আঁকাবাঁকা নীলচে সবুজ রগগুলো তাক করে থিয়েটারি কায়দায় সংলাপ ছুড়ল সন্ন্যাসী বাবা, ‘এই যে হতাশা, এই যে গ্লানি, এ কিন্তু আমাদের পাপের ফল, জানো? শিরায় শিরায় নীল পাপ বইছে, দেখতে পাচ্ছ?’ সম্ভাব্য সুদীর্ঘ লেকচারটা থামিয়ে দিতে পাশ থেকে আন্দ্রেয়া বেফাঁস বলে ফেলল, ‘আরে ধ্যাত, শিরায় শিরায় তো কার্বন ডাই–অক্সাইড। পাপ আসলো কোত্থেকে?’

বুড়ো একটুও দমে না গিয়ে এক গাল হেসে লিফলেট বাড়িয়ে ধরল এক তাড়া। ‘যিশুর দেখানো পথে একবার এসেই দেখো না। সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে।’ এবার সেক্যুলার জার্মানির ঘোর নাস্তিক আনা আর আন্দ্রেয়া বুড়োটাকে হ্যাট্ না ভ্যাট্ কী যেন বলে ধমকে উঠল। চক্ষুলজ্জায় পড়ে কাগজগুলো আমিই হাতে নিলাম। বুড়ো প্রায় কথা আদায় করে নিল যেন সামনের রোববার বান্ধবী দুজনকে নিয়ে গির্জায় যাই। শিরার নীল পাপমোচন বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ হবে।

লিফলেট ভাঁজ করে গোটা চারেক উড়োজাহাজ বানিয়ে এদিক–সেদিক উড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম ফেল্টুস দলের তিন সদস্য। কিছু একটা খেতে হবে। বেশি দুঃখে পড়ে বেহিসাবি ধরনের খিদে পেয়ে গেছে। স্টেশনের সঙ্গে লাগানো চাইনিজ টং আছে একটা। সেখানে গিয়ে হামলে পড়লাম। মচমচে ভাজা চাওমিন যদি মনে একটু বল জোগায়, এই আশায়। উপর্যুপরি কয়েক প্লেট নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম ম–ম ঘ্রাণটা সঙ্গে নিয়ে। মন খারাপের দাওয়াই হিসেবে কতগুলো আইসক্রিমও হাপিশ করে দেওয়া হলো। একে একে বেকারির কেক-পেস্ট্রি, চিনি ঠাসা কফি—কিছুই বাদ গেল না। ‘খেয়ে মরে যাব’–জাতীয় আত্মঘাতী চিন্তা পেয়ে বসেছে আজ।

হাতের মুঠোয় গবেষনার ইঁদুর।
ছবি: লেখিক

চিন্তাটাকে আর বাড়তে না দিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিলাম ওদের কাছ থেকে। কালই দেখা হচ্ছে। সামনের সেমিস্টারের ক্লাস বিরতি ছাড়াই আবার শুরু হবে। সারা দিন ল্যাবের খাটুনির পর ঘণ্টাখানেক বাস-ট্রেন ঠেঙ্গিয়ে শহরের আরেক প্রান্তের ক্যাম্পাসে বিকেল থেকে রাত অবধি ক্লাস। নয়েহেরবার্গ আর গ্রোসারডের্ন ক্যাম্পাস দুটোর মাঝে ঢাকা-টু-কুমিল্লার দূরত্ব। এই আপ-ডাউন অত্যাচারের বুঝি শুরু-শেষ বলে কিছু নেই। ফোঁওওওস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

সুযোগ বুঝে ফকফকে আকাশ ঘুটঘুটে কালো মেঘ ডেকে এনে বৃষ্টি নামিয়ে দিল। ভিজে চুপসে ফিরতি ট্রেন ধরলাম কোনোমতে। ঠান্ডা লাগিয়ে জ্বর বাধানো যাবে না কিছুতেই। কারণ, ল্যাবে কাল ৩৫টি ইঁদুর অপেক্ষায় থাকবে আমার হাতে খুন হওয়ার জন্য। প্রথমে সিরিঞ্জে চোঁ করে টেনে তাদের রক্ত শুষে নেব। তারপর ছোট ছোট ফুসফুসগুলো খুলে ফর্মালিনে চুবিয়ে দেব টুপ্। বাহ্, পরীক্ষায় ফেল করার হতাশাকে হঠাৎ পাশবিক আনন্দে পাল্টে ফেলে বেশ নির্ভার লাগছে। ক্রূর হাসি ছেয়ে গেল একান–ওকান। (চলবে)

লেখক: পোস্ট ডক্টরাল গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি