মধ্যাকাশে অমত্য আলোর নাচন

শহর থেকে দূরে অরোরার নিচেছবি: রিসালাত রহমান

ছজনের কামরা। তিনটি করে বাঙ্কবেড, দুই পাশে। আমরা চারজন। দুই কন্যা বিভোর ও রোদেলা, ওদের মা আর আমি। সাড়ে সতেরো ঘণ্টার যাত্রা। স্টকহোম থেকে আবিস্কো অস্ট্রা পর্যন্ত। ঠিক বারো ঘণ্টা পর ট্রেন বদলাতে হবে বোডেনে।

দীর্ঘ ভ্রমণ নিয়ে যতটা নয়, তার চেয়ে এ মুহূর্তে বেশি ভাবিত আমি, আর দুজন কে আসবেন কামরায়। জেনেভা থেকে ট্রেনে জুরিখ, সেখান থেকে দুই ঘণ্টায় উড়ে এসেছি স্টকহোম, আগের দিন সন্ধ্যায়। বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব মোরশেদ মিল্লাতের ভীষণ আন্তরিকতা আর চাপাচাপিতে স্টকহোমে ওর বাসায় উঠেছি। আগেই বলেছি, আমাদের মূল গন্তব্য আবিস্কো। মিশন নর্দার্ন লাইটস বা উত্তুরে আলো। অনেকে বলেন, অরোরা বোরিয়ালিস। সংক্ষেপে শুধু অরোরা।

অরোরা বা মেরুজ্যোতি
ছবি: লেখক

প্রথমে বেটার হাফ রূপার, পরে আমাদের সবার বুনো স্বপ্ন-অরোরা সন্দর্শন। মাঝ আকাশে গভীর রাতে সবুজ, নীল, গোলাপি, লাল আর কমলা আলোর নাচন। গত ক বছরে বই আর পত্রপত্রিকার বর্ণনায় স্বপ্নটাকে বাড়তে দিয়েছি। ভিডিও দেখিনি ইচ্ছা করেই। স্বচক্ষে দেখার আনন্দ মাটি যেন না হয়।

এরই মধ্যে জেনেছি, উত্তুরে আলোর জন্য সেরা পীঠস্থান নরওয়ের ট্রমসো। কানাডার ইউকন, আমেরিকার আলাস্কা, গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড আর সুইডেনের ল্যাপল্যান্ড।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু শাহীন ট্রমসোতে অধ্যাপনা করছে। ওর আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ারই চিন্তা ছিল। বাদ সাধল মোরশেদের প্রোফাইল পিক-প্রেক্ষাপটে উজ্জ্বল সবুজ জ্যোৎস্না। কদিন আগে ল্যাপল্যান্ড ঘুরে এসেছে ওরা। ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলে প্ল্যান বদলে ফেলি। ট্রমসো নয়, যাচ্ছি সুইডিশ ল্যাপল্যান্ড আবিস্কোতে। তরুণ কূটনীতিকই নিজে ড্রাইভ করে পৌঁছে দিয়েছে স্টকহোম সেন্ট্রাল স্টেশনে। ছাড়ার মিনিট বিশেক আগেই খুঁজে নিই নিজেদের কামরা। কে না কে আসেন, এ আশঙ্কা যেমন ছিল, তেমনি আশাও ছিল। করোনাকালে যাত্রী তেমন থাকার কথা নয়। আমাকে ভুল প্রমাণ করে আমাদের প্রায় পরপরই এলেন, বছর পঁচিশের এক তরুণ। হাই–হ্যালো হয়নি। এসেই আনমনে বসেছিলেন।

স্টেশনে লেখক ও তাঁর পরিবার
ছবি: রিসালাত রহমান

নিচের আর মাঝের চারটি বাঙ্ক আমাদের। তরুণ নিশ্চয় ওপরের কোনোটিতে যাবেন। আবার এ–ও হতে পারে, ভিনদেশি পরিবারের সঙ্গে ভ্রমণ, তার জন্য অত আনন্দদায়ী হবে না ভেবে নিজেই অন্য কোনো কামরা খুঁজে নেবেন। ব্যাটা এতই চুপচাপ, আমাদের ইচ্ছা হলো না বরফ গলানোর। আরও একটা ভুল প্রমাণ করে একটু পর নিজেই বিছানা পেতে শুয়ে পড়ল ওর বাঙ্কে। যাক, একজন অন্তত নেই, এই যখন ভাবছি, তখনই সহাস্যে প্রবেশ বিশালদেহী প্রৌঢ়ের। আচরণে আগের জনের উল্টো। এসেই বললেন, ‘তোমরা নিশ্চয় ইন্ডিয়ান, আমি ইন্ডিয়ায় দুবছর ছিলাম। রাজস্থানে। ড্রিলিং কোম্পানির নির্বাহী।’ বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হলো কিছুটা। আমাদের পর্যটন সম্ভাবনা আর তার ফিরে যাওয়া নিয়ে।

আমাদের মিশন শুনে বেশ উৎসাহী হলেন। বললেন, ‘সুইডেনের দেড় কোটি মানুষের অনেকেই অরোরা দেখেনি। তোমরা নিশ্চয় দেখবে! আবিস্কোতে আরেকটা দারুণ জিনিস— আইস হোটেল। বরফ আর তুষারে তৈরি ঘর। তাপমাত্রা শূন্যের নিচে না থাকলে এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই দায়। বলাবাহুল্য, এটি স্থায়ী স্থাপনা নয়। প্রতিবছরই শীতকালে নির্মিত হয়। পর্যটকেরা এসব হোটেলে থাকেন, বরফের বিছানায় ঘুমান। পশমের কম্বল, জ্যাকেট—এসব নিয়েই অবশ্য।’

কিরুনা রেলস্টেশন
ছবি: লেখক

গালগল্প গাঢ় হতেই টের পেলাম, ভদ্রলোক একটু পান করেই উঠেছেন ট্রেনে। টের পেয়ে আড্ডায় একটু জল ঢেলে দিই। জানাই যে দুই কন্যার ঘুম পেয়েছে। দূরের পথ। ভদ্রলোক বুঝলেন বলেই মনে হলো। জানালেন, তাঁর নাম জোনাস মিরজেল। এক রকম জোর করেই তাঁর ই–মেইল দিয়ে বললেন, এরপর এলে যেন আগে থেকে জানাই। আমাদের আতিথ্য দিতে পারলে খুশি হবেন তিনি। এ–ও জানালেন, নামবেন ভোরের দিকে। কাজ আছে বলে ঘুমাবেন না। ট্রেনের খাবারঘরে কাজ করবেন ল্যাপটপে।

জোনাস চলে যাওয়ার পরপরই আমরা শুয়ে পড়ি। আমি মাঝের এক বাঙ্কে। মা-কন্যাদ্বয় নিচে বিছানা ভাগাভাগি। ক্লান্তি ছিল, আমি পত্রপাঠ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

সকালে রূপার কাছে শুনেছি এক মজার গল্প। রাত একটার দিকে জোনাস কামরায় ফিরেছিলেন। বিশাল বপু নিয়ে তিনতলা বাঙ্কে ওঠার চেষ্টা করেননি ঈষৎ মদ্যপ ড্রিলিংম্যান। মেঝেতেই শুয়ে পড়েন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নাসিকাগর্জন।

ভোরের আগেই নেমে যান কোনো এক স্টেশনে। সকালে এ গল্প শুনে আমরা হেসেছি অনেক। আবার এই ভয়ও ছিল যে ঘুমের ঘোরে বা অ্যালকোহলের ঘোরে যদি মশায়ের একটি পা উঠে যেত আমাদের বিছানায়!

আবিস্কো অস্ট্রা রেলস্টেশন
ছবি: লেখক

বেলা এগারোটায় ট্রেন পৌঁছায় বোডেনে, স্টকহোম থেকে সোজা উত্তরে সাড়ে সাত শ কিলোমিটার যাওয়ার পর। ট্রেন বদলে আরও চার শ যেতে হবে, উত্তর-পশ্চিমে।

আবিস্কো অস্ট্রা স্টেশনে যখন নামি, তখন বিকেল পাঁচটা— পড়ুন রাত পাঁচটা। এখানে এ সময়ে সূর্য ডুবে যায় দেড়টার দিকে। হ্যাঁ, আপনারা যাকে বেলা দেড়টা বলে জানেন।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উত্তরাংশে এই মৌসুমে সূর্যোদয় সকাল ১০টায় আর সূর্যাস্ত ১টায়। তিন ঘণ্টার দিন। আর বাকি ২১ ঘণ্টাই দীর্ঘ রাত। দিন-রাতের এই জটিল হিসাবে কখন ব্রেকফাস্ট আর কখনোই–বা লাঞ্চ-ডিনার করব ভাবছি।

স্টেশনের অদূরেই হোটেল। তিন দিন থাকার প্ল্যান আমাদের। রিসেপশনে জানলাম, অরোরা দেখানো নিয়ে বেশ কয়েক রকম প্যাকেজ ট্যুর আছে। অন্যান্য অ্যাক্টিভিটিও আছে। আমাদের পরামর্শ দেওয়া হলো, ‘১৭ ঘণ্টা ট্রেনে ছিলে, আজ বরং তোমরা বিশ্রামই নাও। ডিনারের পর চাইলে লেকের দিকে যেতে পারো। আর পরদিন সন্ধ্যার জন্য বুক করতে পারো অরোরা কার চেজিং ট্যুর।’

গেস্ট হাউস
ছবি: লেখক

তাঁর পরামর্শ মেনে সুপারস্টোর থেকে গ্রোসারি নিয়ে আসি। পরমানন্দে রুটি গো-মাংস দিয়ে ভূরিভোজ সেরে ফেলি। ভাগ্যিস, মোর্শেদ আর ফারিয়া ভাবি মাংস রেঁধে দিয়েছিলেন। এখানে খাবারের বন্দোবস্ত তেমন উত্তম নয়। ডিনারের পরই লেকের দিকে রওনা হই। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মতো হবে। ঘন অন্ধকার হোটেল থেকে দেড় কিলোমিটার দূরের টর্নেট্রাস্ক লেকে, অন্ধকার, নির্জন। একটু ভয় ভয় করছে। চাঁদের অবছা আলোয় লেক দৃশ্যমান। দিনের আলোয় এখনো দেখা হয়নি টর্নেট্রাস্ক লেক। আবছায়া ধরে কিছুটা সামনে যাই। অন্ধকারেও বেশ টের পাচ্ছি, লেকের বড় এক অংশে পানি জমে রয়েছে।

লোকালয়, হ্রদ আর পাহাড়ে অনিন্দ্য মিতালী
ছবি: লেখক

অনতিদূরে প্রায় হঠাৎ জ্বলে ওঠে এক চিলতে আলো। একটু চমকে যাই আমরা। এমন পিনপতন নীরবতা! দশাসই কোনো সিরিয়াল কিলার বেরিয়ে এসে সলিলে সমর্পণ করলে চিহ্নই হয়তো থাকবে না আমাদের। নাহ্‌, গাড়ির আবছা আলোয় দুটি শিশুকেও দেখলাম। তার মানে, এরা আমাদেরই মতো অরোরা দেখতে এসেছে। প্রচণ্ড শীতের ভয়ে গাড়িতে অপেক্ষা করছে। আর আমি কী না কী ভাবছি!

কোথায় অরোরা, কোথায় কী? মিনিট বিশেক কাটিয়ে রাতের মেঘলা আকাশ ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি।

পরদিন সন্ধ্যায় অরোরা চেজিং। গাড়িতে উঠেই গাইড মেয়েটার কাছে জানতে চাই, অরোরা চেজিং মানে কী? জানালো, ও দিনভর এ নিয়ে গবেষণা করেছে, আজ কখন কোন স্পট থেকে অরোরা দৃশ্যমান হবে। আমাদের নিয়ে সেই সব স্পটে দৌড়াবে। আমাকে বলল, ওই যে পুবের আকাশে তাকাও। দেখতে পাচ্ছ যে এক ফালি মেঘ উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছে, তার মানে, আমরা আরও উত্তরে গেলে মেঘমুক্ত আকাশ পাব।

দূরে ওই দেখা যায় আলপস পর্বতমালা
ছবি: লেখক

মিনিট দশেক ড্রাইভ করে একটা খোলা জায়গায় পার্ক করল। আমাদের সবার চোখ ঊর্ধ্বাকাশে অরোরা খুঁজছে। সত্যি বলতে কী, তেমন কোনো রঙের খেলা চোখে পড়ল না। গাইড সান্ড্রা যতই বলল, ওই যে ওখানে, মেঘের একটু বাঁ পাশে, সবুজ আলোর রেখা কি দেখতে পাচ্ছ না? না–সূচক মাথা নাড়ি আমরা। অন্তত এটা তো স্বীকার করবে, আজ আকাশে অনেক তাড়া!

অমনি ওপরের দিকে তাকাই। সত্যিই, অজস্র তারার মেলা আজ। এমন তারকাজ্জ্বল নিঃসীম আকাশ শেষ কবে দেখেছি, মনে করতে পারলাম না।

সান্ড্রা বলল, চলো যাওয়া যাক, আরেকটা স্পট আছে, সেখান থেকে হয়তো দেখতে পাবে। যেতে যেতে সান্ড্রার গল্প শুনলাম। মেয়েটা গোথেনবার্গের। জানাল, গোথেনবার্গের সঙ্গে স্টকহোমের প্রতিযোগিতা শতাব্দী পুরোনো। দুই শহরই নিজেদের সেরা মনে করে। সান্ড্রার মত, গোথেনবার্গে ভিড়ভাট্টা কম, মানুষ অনেক বেশি বন্ধুবৎসল, মহাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে নিকটবর্তী, জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলক কম, ফুটবল আর সংগীতেও এগিয়ে। পরেরবার তবে ওখানেই বেড়াতে যাব। এই বলে তর্ক থেকে মুক্তি চাইলাম।

হ্রদের ওপাশে তুষার ঢাকা আলপস
ছবি: লেখক

সান্ড্রা আর ওর বয়ফ্রেন্ড—দুজনেই এই ট্যুর কোম্পানিতে কাজ করে। তুষার আর অরোরা ভালোবাসে বলে বছরের এ সময়ে ওরা উত্তরাংশে চলে আসে। মাস তিনেক থেকে পয়সা কামিয়ে ফিরে যায়। জানাল, সমস্ত সঞ্চয় উজাড় করে পর্যটনে বিনিয়োগ করেছে ফিনল্যান্ড আর নরওয়েতে। করোনাভাইরাস সর্বনাশ করেছে ওদের। এখন টিকে থাকাই দায়। স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য আসা যেসব ছাত্রছাত্রী আটকা পড়েছে, ট্যুরিস্ট বলতে তো শুধু ওরাই। আর আমাদের মতো অল্প কজন, যারা ছুটছে অরোরা স্বপ্নের পেছনে।

৯টার দিকে হোটেলে ফিরে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করল সান্ড্রা। নাহ্‌, অরোরা দেখা তেমন জমল না।

রাত ১০টার দিকে মোরশেদের ফোন, স্যার! সোলার অ্যাক্টিভিটি হচ্ছে অনেক। এখনই অরোরা শুরু হতে পারে। মোরশেদ লাইটস, ওভার ল্যাপল্যান্ড ওয়েবসাইটে লাইভ দেখেছে। আমিও ওয়েবসাইটে চোখ বুলিয়ে দ্রুত শীতের পোশাক পরে নিলাম। ক্যামেরা আর ট্রাইপড যেন ভুলে না যাই, বলে দিয়েছিলেন ফারিয়া ভাবি। সেলফোনের ক্যামেরা আজকাল এত ভালো হয়েছে, আমরা বেড়াতে গেলে এখন আর ক্যামেরা নেই না। কিন্তু অরোরা ফটোগ্রাফি ভিন্ন জিনিস। ট্রাইপড ছাড়া ভালোভাবে ক্যাচ করা যাবে না।

রোদেলার পেছনে গাঢ় সবুজ দিগন্তরেখা
ছবি: লেখক

প্রথম ক্লিকেই বুঝে গেলাম, ক্যামেরার চোখ অন্য। রোদেলার পেছনে গাঢ় সবুজ দিগন্তরেখা। পল্লবশূন্য বৃক্ষ আর মেঘের ওপারে সবুজ তীব্র আলো। খালি চোখে রং তত স্পষ্ট নয়, যতটা ক্যামেরায়। সান্ড্রা বলে দিয়েছিল। শহর থেকে যত দূরে পারো, চলে যেয়ো। তা না হলে শহরের লাইটিং কমলা রঙের স্পায়েলিং এফেক্ট তৈরি করতে পারে। আমরা লেকের দিকে পা চালাতে থাকি। পথের পাশে নির্জন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে থাকি অরোরা বোরিয়ারলিস। আর চলতে থাকে ক্যামেরার ক্লিক। কখনো শহরের লাইটিং, তারার, কখনো গাড়ির আলোয় বদলে দিচ্ছিল। আর অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছিল আসল চেহারা। লেক পর্যন্ত আর গেলাম না।

সস্ত্রীক লেখক
ছবি: রিসালাত রহমান

ভালোই উপভোগ করেছি মাঝরাতের সবুজ আর ধূসর আকাশ। কিন্তু ঠিক মন ভরল না। আর মাত্র এক দিন বাকি। না হলে এই স্মৃতি নিয়েই ফিরতে হবে।

আবিস্কোতে আমাদের শেষ সন্ধ্যা। কিছুক্ষণ পরপরই বেরিয়ে দেখে আসছি। আর ল্যাপল্যান্ড ওয়েবপেজের লাইভ সম্প্রচারের ওপরও চোখ রাখছি। রাত আটটা থেকেই মনে হচ্ছে একটু একটু করে আকাশের রং বদলাচ্ছে। ডিনার দ্রুতই সেরে নিলাম। যাতে বেরিয়ে পড়তে সময় বেশি না লাগে।

৯টার দিকে প্রায় আচমকা হোটেলে উত্তেজনা। অরোরা, নদার্ন লাইটস, শব্দগুলো কানে আসছিল। দ্রুত তৈরি হয়ে লেকের দিকে যাত্রা করলাম। ততক্ষণে ওখানে অনেকেই পৌঁছে গেছেন। লেকের উত্তর পাশে অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় অবস্থান নেই আর তাকাই আকাশের দিকে। মনে হচ্ছে, ধূসর আর সবুজ আলোর রেখা, রংধনুর মতো। ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে আলো। ছড়িয়ে পড়ছে পুরো আকাশে। কখনো পুব থেকে পশ্চিমে। কখনো দিগন্তরেখা ঘেঁষে, কখনো উত্তর থেকে মধ্যাকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত।

লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে বর্ণাঢ্য জোৎস্না বা আলোর নাচন দেখছি
ছবি: লেখক

লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে বর্ণাঢ্য জোৎস্না বা আলোর নাচন দেখছি। কখনো পত্র-পল্লবহীন বৃক্ষশীর্ষে, কখনো উত্তরের দূর আকাশে, কিরুনা শহরের দিকে, কখনো লেকের অন্য পাশে। সবুজ ধনুকাকৃতি জ্যোৎস্নার প্রতিবিম্ব লেকের স্বচ্ছ জলে পড়ছে। কোনো কোনো অংশ শুভ্র তুষাররাজির ওপর পড়ে অপূর্ব আবহ তৈরি করেছে।

দিগন্ত থেকে বেরিয়ে পড়েছে আলোর কয়েকটি বর্ণিল ছটা
ছবি: রিসালাত রহমান

কখন ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক ভুলে বিভোর আমরা একবার উত্তর, আরেকবার মধ্যাকাশে তাকিয়ে আছি, বলতে পারব না। হঠাৎ মনে হলো, দিগন্ত থেকে বেরিয়ে পড়েছে আলোর কয়েকটি বর্ণিল ছটা। যেন প্রদীপ থেকে বেরিয়ে এসেছে বর্ণিল দৈত্য। আবার কখনো মনে হচ্ছে বীর সালাহউদ্দিন আইউবির ধনুক। আবার কখনো পরশুরামের কুঠার। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে রং। আর আকৃতিও। কখনো সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো, কখনো চাররঙা রংধনু-সবুজ, বেগুনি, গোলাপি আর লাল। আলোর তীব্রতা বেড়ে চলেছে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। তবে রঙের শেড একের পর অন্য। হালকা থেকে গাঢ়। আবার হালকা। কখনো ঘন সবুজ। কখনো টিয়া পাখি সবুজ। কখনো কলাপাতা সবুজ। সবুজেরই যেন এক শ রকম শেড। সঙ্গে অন্য রং।

এ রং যে আকাশে অচঞ্চল, তা নয়। ভাসছে, খেলছে, নাচছে। অভূতপূর্ব! অনিন্দ্যসুন্দর! কীভাবে বর্ণনায় আনব এই স্বর্গীয় আলোর নাচন!

হঠাৎ মনে হলো, ধ্রুপদি নৃত্য হচ্ছে চোখের সামনে। পুরো আকাশই যেন তার মঞ্চ। কখনো মনে হচ্ছে, শুধু নৃত্য নয়, সংগীতও চলছে যেন। কিংবা সংলাপ। সবুজ-লাল-বেগুনি আলো যেন কথা কইতে চায় বিমুগ্ধ দর্শকের সঙ্গে। আর দর্শক ভাবছে, কী উপায়ে ভাষায় প্রকাশ করবে স্বর্গীয় এই রূপ।

ফিরতি পথে লেখক ও তাঁর পরিবার
ছবি: রিসালাত রহমান

সৃষ্টিকর্তারকে সর্বান্তকরণে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই। আলোর নাচন, বর্ণালি জ্যোৎস্না যেন স্রষ্টার পেলব তুলিস্পর্শে প্রাণ পেয়েছে।

ভাষার কী সাধ্য সেখানে পৌঁছায়?

লেখক: জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদর দপ্তরে কর্মরত।