মানালির দিনগুলো

বয়ে চলেছে বিয়াস নদী। ছবি: কাজী শামসুল আরেফিন
বয়ে চলেছে বিয়াস নদী। ছবি: কাজী শামসুল আরেফিন

এবারের ভারত ভ্রমণে হিমাচল যাওয়ার পরিকল্পনা একেবারেই ছিল না। ছিল দিল্লি, আগ্রা আর গোলাপি শহর জয়পুর। কিন্তু হঠাৎ করেই মাথায় চাপল পাহাড় দেখতে হবে। দে ছুট মানালিতে। হিন্দিতে মানালিকে বলা হয় পৃথিবীর স্বর্গ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ হাজার ৭২৬ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ভারতের অন্যতম এই হিল স্টেশনটি তার মোহনীয় সৌন্দর্যের যে আভা ছড়িয়ে রেখেছে, তা সত্যিই স্বর্গতুল্য।
সারা রাত বাসযাত্রার ক্লান্তি নিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। ঘরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে জানালার পাশে রাখা চেয়ারে আয়েশ করে বসে চোখ বন্ধ করলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই টি-পটভর্তি চা চলে এল। চায়ের কাপ হাতে জানালার পর্দা সরাতেই সমস্ত ক্লান্তি উবে গেল মুহূর্তেই। বাইরের কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়ালাম। সারি সারি পাইনগাছ তাদের সুচালো মাথা নিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে। পাহাড়চূড়ায় সবে শীতের প্রথম বরফ জমতে শুরু করেছে। সবুজ পাহাড়ের ভাঁজগুলো ধীরে ধীরে ভরে উঠছে শুভ্রতার আবরণে।
নাশতা সেরে ১১টার দিকে হোটেলের লবিতে এসে বসলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতীয় এক দম্পতি আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাঁরা আমাদের আজকের দিনের ভ্রমণসঙ্গী। গাড়ি আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিল। টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ছুটে চলল গুলাবার উদ্দেশে।
পাহাড় কেটে তৈরি করা সর্পিলাকার রাস্তা। বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তবে লালচে পাহাড়ের বুক চিরে জেগে ওঠা সবুজ পাইনের সারি ঝুঁকির চিন্তা মুহূর্তেই ভুলিয়ে দেয়। তার সঙ্গে বিয়াস নদী আমন্ত্রণ জানায় অপার্থিব এক ভুবনে। পাহাড়ি নদী মানেই সৌন্দর্যের পসরা। তার ওপর সেখানে যদি থাকে র্যা ফটিংয়ের সুযোগ, তাহলে তো পোয়াবারো।
গুলাবা মানালির এক ছোট্ট গ্রাম। এর নামকরণ করা হয় কাশ্মীরের রাজা গোলাব সিংয়ের নামে। ২০ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা কিন্তু চলতে সময় লাগল প্রায় ২ ঘণ্টা। মানালির অন্যতম আকর্ষণ রোথাং পাস শহর, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩ হাজার ৫০ ফুট উচ্চতায়। কুলু, লাহাল, স্পিতি—এই তিন উপত্যকার সংযোগস্থল। মানালি থেকে ৫১ কিলোমিটার দূরে। বছরজুড়েই বরফ তার অস্তিত্ব স্বমহিমায় জানান দেয় রোথাং পাসে। তবে বেশির ভাগ সময়ই এই রাস্তা বন্ধ থাকে তুষারপাতের কারণে। বিধি বাম, এবারও রাস্তা বন্ধ।

পরবর্তী গন্তব্য সোলাং ভ্যালি। গুলাবা থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে। তবে গাড়িকে বেশ খাড়া ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে হচ্ছে। উপত্যকায় (ভ্যালি) পৌঁছানোর পর দেখি সবাই হাঁ করে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারখানা বুঝতে আকাশে তাকালাম। অনেক রঙিন বাজপাখি মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছে। উড়তে উড়তে একেবারে পাহাড়ের চূড়াকে স্পর্শ করে ফেলবে মনে হচ্ছে। ওমা, একটু পরে দেখি পাখিগুলো ছোঁ মেরে নিচে নেমে যাচ্ছে। সোলাং ভ্যালিতে এ রকম প্যারাগ্লাইডিং দেখে অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। শুধু কি প্যারাগ্লাইডিং! কেব্ল কার, স্কিয়িং কী নেই এখানে।
পরদিনের পরিকল্পনা আশপাশেই ঘোরাঘুরি আর র্যা ফটিং করা। শুরু করলাম হেরম্বা বা হাদিম্বা মন্দির দিয়ে। ম্যাল রোড থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে হেরম্বা দেবীর মন্দির। মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটা চমৎকার। বনের কাছাকাছি একটা জায়গায় আমাদের গাড়ি থেকে নামতে হলো। হেঁটে হেঁটে বনের ভেতরে ঢুকলাম। নির্জন সিডার বন। দারুণ সে অভিজ্ঞতা। মানালিতে দিনগুলো আসলে অন্যরকভাবেই কেটে যায়।

কীভাবে যাবেন
দিল্লির কাশ্মীরি গেট বাস টার্মিনাল থেকে মানালির বাস পাওয়া যায়। প্রায় ১৩ ঘণ্টার যাত্রা। দূরত্ব প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। হিমাচলের এসি ভলভোতে ভাড়া ১৪০০ রুপি, নন-এসিতে অনেক কম। মানালি যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় মে থেকে অক্টোবর। যাঁরা তুষারপাত দেখতে চান তাঁরা ডিসেম্বর-মার্চ যেতে পারেন।

কোথায় থাকবেন
ম্যাল রোডের আশপাশে অনেক হোটেল-মোটেল রয়েছে। তবে ওল্ড মানালিতে তুলনামূলক কম খরচে বেশ ভালো মানের হোটেল পাবেন। ভাড়া প্রতিদিন ৫০০ থেকে ২ হাজার রুপি। কেনাকাটা করতে পারেন ম্যাল রোডে।