>পুরো ট্রেন সেদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের দখলে। দ্বিতীয় ব্যাচের প্রবীণ থেকে শুরু করে সদ্য পাস করা তরুণও ছিলেন। সে এক জাদুর ট্রেন! মনে হচ্ছিল, হ্যারি পটারের মতো সাড়ে ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দেয়াল ভেদ করে বুঝি সবাই এই ট্রেনের যাত্রী হয়েছেন। ট্রেনের চাকা ঘুরতেই কিশোর, তরুণ, বুড়ি—সবার বয়স হলো কুড়ি! একেকটা বগি যেন একেকটা ক্লাসরুম হয়ে গেল।

আমার মা ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫তম ব্যাচের ছাত্রী। ১৯৮৩ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর খবর পেয়ে কদিনের জন্য তাঁর মোবাইল ফোনটা বেশ সরব হয়ে উঠেছিল। দেখছিলাম, একটু পরপরই ফোন আসছে। বন্ধুদের কে কে যাচ্ছেন, নাম নিবন্ধন করা হলো কি না, চট্টগ্রাম যাওয়ার টিকিটের কী ব্যবস্থা, কোথায় থাকা হবে...চলছিল নানা আলোচনা। ১৮ নভেম্বর ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে জোট বেঁধে, ১৭ নভেম্বর সকালে সোনার বাংলা ট্রেনে মা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রওনা হলেন। আর তাঁর সঙ্গী হলাম আমি।
পুরো ট্রেন সেদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের দখলে। দ্বিতীয় ব্যাচের প্রবীণ থেকে শুরু করে সদ্য পাস করা তরুণও ছিলেন। সে এক জাদুর ট্রেন! মনে হচ্ছিল, হ্যারি পটারের মতো সাড়ে ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দেয়াল ভেদ করে বুঝি সবাই এই ট্রেনের যাত্রী হয়েছেন। ট্রেনের চাকা ঘুরতেই কিশোর, তরুণ, বুড়ি—সবার বয়স হলো কুড়ি! একেকটা বগি যেন একেকটা ক্লাসরুম হয়ে গেল। সেই ক্লাসে গলা ছেড়ে গান গাওয়া ‘ব্যাকবেঞ্চার’ যেমন আছেন, আছেন সিরিয়াস ভঙ্গিতে আলাপরত সুবোধ ছাত্ররাও।

আমার মায়ের সঙ্গে তাঁর পুরোনো বন্ধুদের কথা হচ্ছিল হলজীবন নিয়ে। সারা রাত কত গল্প করতেন, কী কী রান্না করে খেতেন...স্মৃতিচারণা ছাড়াও কত কথা জমা হয়ে আছে। রান্না প্রসঙ্গে একজনের মনে পড়ে গেল, ‘আরে! আমি তো পেঁয়াজু ভেজে এনেছি! গল্প করতে করতে ভুলেই গিয়েছিলাম।’ সেই খালামণি পেঁয়াজু বের করলেন। মা বের করলেন কমলা। আরেকজনের ব্যাগ থেকে পিঠা বের হলো। দেখা গেল সবাই বন্ধুদের খাওয়াবেন বলে কিছু না কিছু নিয়ে এসেছেন। খালা-মামাদের তুমুল উৎসাহে একের পর এক খাবারের বাটিগুলো খালি হলো। এই একটা দিনের জন্য কোলেস্টেরল, প্রেশার, সুগারের হিসাব সবাই যেন বেমালুম ভুলে গেলেন! গল্প করতে করতে এক মামা হাসছিলেন হো হো করে। বেরসিকের মতো পাশ থেকে একজন মনে করিয়ে দিলেন, ‘আস্তে! হার্টটা যে কিছুদিন আগে মেরামত করিয়েছ, সেটা মাথায় রেখো।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মা প্রথমেই গিয়েছিলেন তাঁর হলে, নিজের পুরোনো রুমে। বর্তমান বাসিন্দারা সাদরেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সেখানে আমি মায়ের সঙ্গে ছিলাম না। কিন্তু অনুমান করতে পারি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতে গেলেই তাঁর যেভাবে চোখ ভিজে যায়, পুরোনো ঠিকানায় গিয়ে নিশ্চয়ই বারবার চোখ মুছতে হয়েছে।
সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে খাবারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু অত বড় লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার খাওয়ার ধৈর্য বা ইচ্ছে, কোনোটাই মা আর তাঁর বন্ধুদের ছিল না। তাঁরা দল বেঁধে চলে গেলেন ক্যাম্পাসের বিখ্যাত ঝুপড়িতে। ঝুপড়ির খাবারে পেট যতটা না ভরল, তার চেয়ে বেশি ভরল মন।
আমার মা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন ৩৩ বছর আগে। ক্যাম্পাস ছাড়ার সময় নিশ্চয়ই বন্ধুরা একে অপরকে কথা দিয়েছিলেন, নিয়মিত যোগাযোগ হবে, কথা হবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতোই এই ৩৩ বছরে ‘কেউ কথা রাখেনি’। টুকটাক যোগাযোগ হয়েছে, কিন্তু সবার সঙ্গে না। মাত্র দুই দিনে তাঁরা এত বছরের জমানো কথাগুলো বলে ফেলতে চেষ্টা করলেন। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, তাঁদের পুরো আনন্দযজ্ঞ হয়ে গেল কোনো সেলফি তোলা, চেক ইন দেওয়ার ‘ঝক্কি’ ছাড়াই।
ফিরেছি রাতের ট্রেনে। ট্রেনের দুলুনিতে আমার যখন চোখ বুজে এসেছে, তখনো শুনতে পাচ্ছিলাম, তাঁদের আড্ডা চলছেই। চলছে জাদুর ট্রেন...।