স্যার এফ আর খানের শহরে

ছোটবেলায় স্কুলের বইয়ে পড়েছিলাম, ‘শিকাগো কেন ওপরের দিকে বাড়ে?’ আরও পড়েছিলাম, একজন বিশ্বখ্যাত আর্কিটেক্ট স্যার ফজলুর রহমান খানের কথা। তাঁর নকশায় সৃষ্টি সিয়ার্স টাওয়ারের কথা, যে সিয়ার্স টাওয়ার বিশ্বের বুকে টানা ২৪ বছর সবচেয়ে উঁচু ভবন ছিল। শিকাগো শহরে গিয়ে আমাদের দেখার সৌভাগ্য হলো সেই ঐতিহাসিক ভবনটির।

এক পলকে শিকাগো শহর
ছবি: লেখক

শিকাগো, আমেরিকার তিনটি বড় শহরের কথা বললে চলে আসবে যার নাম। ট্যুরিস্টদের আকর্ষণের কেন্দ্রভূমি। আকাশছোঁয়া ভবনের শহর। নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শহর। ওহাইওর মতো শিকাগো নামটিও আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের দেওয়া। রেড ইন্ডিয়ানরা বন্য পেঁয়াজকে বলত ‘শেকাগেহ’। এ অঞ্চলে বিশেষ ধরনের এই পেঁয়াজের অতিফলন ছিল। সেখান থেকে এই শহরের নাম হয় শিকাগো।

শিকাগো শুধু আমেরিকায় কেন, সারা পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের তীর্থভূমি। কারণ ১৮৮৬ সালে এই শহর থেকে একদিন যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘মে দিবস’-এর। শিকাগোতে শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্প্যানিকেরা সমানুপাতিক হারে বাস করে। প্রত্যেকে আলাদা এলাকায় থাকে। আছে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশিদের এলাকাও, যার পোশাকি নাম ডেটন অ্যাভিনিউ। তবে সবাই বলে ’দেশি’ এলাকা।

আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাওর বাড়ি
ছবি: লেখক

আমেরিকার জীবিত প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় যে মানুষটি, সেই বারাক ওবামাও থাকতেন এখানে। তিনি এই শহরের সিনেটর ছিলেন। এখান থেকেই তিনি আমেরিকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে হোয়াইট হাউসে চলে যান। বর্তমানে তিনি ওয়াশিংটনে এক ভাড়া বাসায় থাকেন। সেই বাড়িটি ‘মিউজিয়াম’ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের মতো অনেক ট্যুরিস্ট প্রতিদিনই ওবামার বাড়িটি দেখতে আসেন।

বাঙালি স্থপতি স্যার এফ আর খান
ছবি: সংগৃহীত

তবে সিয়ার্স টাওয়ারে (যার বর্তমান নাম উইওলস টাওয়ার) গিয়ে দেখলাম, সেখানে ট্যুরিস্ট যেন উপচে পড়া। এক দিন আগে টিকিট কিনে রাখতে হয়। আমাদের শিকাগো সফরের দ্বিতীয় দিনে গেলাম সেখানে। গাইডরা প্রথমে আমাদের ধাপে ধাপে ১০৩ তলায় নিয়ে গেলেন। ওখান থেকে দেখলাম উঁচু ভবন, নদী, লেক মিলে অনিন্দ্যসুন্দর শহরটাকে। ভাবতেই গর্ব হলো যে ভবনটি একজন বাঙালির নকশা দিয়ে সৃষ্টি। এই ভবনের সামনে স্যার এফ আর খানের নামে একটি রাস্তাও আছে।

নেভি পিয়ারে গেলাম প্রথম দিন। মানুষের মিছিল সর্বত্র। তবে করোনার কারণে সবার মুখে মাস্ক থাকতেই হবে। প্রথম টিকিট কেটে গেলাম শিকাগো রিভার ক্রুজে। সেখানে নদীপথে খোলা ডেক থেকে উপভোগ করলাম দুই পাশের শহরকে। একজন ‘ন্যারেটর’ চমৎকারভাবে বর্ণনা করছিলেন সব। লেক মিশিগানের যাত্রাটা আরও উপভোগ্য ছিল। নামে ’লেক’ হলেও সমুদ্রের মতোই আদিগন্তহীন। বিশাল সব ঢেউ ডুবিয়ে দিচ্ছিল অদম্য সার্ভারদের। দামি সব ইয়াট মনে করিয়ে দিচ্ছিল হলিউডের মুভির দৃশ্য।

১০৩ তলা সিয়ার্স টাওয়ার থেকে শিকাগো শহর
ছবি: লেখক

শিকাগো ইলিনয় স্টেটের সবচেয়ে জনবহুল শহর। আর পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার হিসেবে তৃতীয়। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী শিকাগোর জনসংখ্যা ২৭ লাখ। এই শহরের আরও অনেক নাম আছে। যেমন ‘উইন্ডি সিটি’, ‘সি টাউন’ ‘সিটি অব দ্য বিগ শোল্ডার’, ‘সেকেন্ড সিটি’, ’মাই কাইন্ড অব টাউন’ প্রভৃতি। ১৭৮০ সালে জিন বাপ্টিসটে পয়েন্ট ডু স্টেবল শহরটির পত্তন করেন।

লেক মিশিগানের তীরে অবস্থিত শিকাগো শহর উনিশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এসে দ্রুত বর্ধিত হয়। গ্রেট লেক ও মিসিসিপি নদী নিকটবর্তী হওয়ায় শহরটিকে নয়নাভিরাম রূপ এনে দিয়েছে। ১৮৭১ সালে শিকাগোতে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল, যাকে বলা হয় গ্রেট শিকাগো ফায়ার। সেই সময় প্রায় এক লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছিল। তারপর শহরটি নতুনভাবে নির্মিত হয়। বর্তমানে শিকাগো পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ শহর।

শিকাগো হলো অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বাণিজ্য, শিল্প, শিক্ষা, টেকনোলোজি, টেলিকমিউনিকেশন ও যোগাযোগব্যবস্থার আন্তর্জাতিক কেন্দ্র। বহু বিশ্বসেরা কোম্পানির মূল অফিস এই শহরে, যেমন অলস্টেট, বোয়িং, ক্যাটারপিলার, এক্সিলোন, ক্রাফট হেইঞ্জ, ম্যাকডোনাল্ডস, মনডেলেজ ইন্টারন্যাশনাল, সিয়ার্স, ইউনাইটেড এয়ারলাইনস হোল্ডিস, ইউএস ফুডস ও ওয়ালগ্রিন।

সিয়ার্স টাওয়ারের ১০৩ তলায় লেখক
ছবি: সংগৃহীত

২০১৮ সালে ৫৮ মিলিয়ন মানুষ শিকাগো সফর করেন, যেটা একটি নতুন রেকর্ড। ২০১৮ সালে ৩২ শহরের ১৫০০ মানুষের ওপর একটা জরিপ চালানো হয়েছিল, সেখানে দেখা গেছে ‘টাইম আউট সিটি’ হিসেবে শিকাগো বিশ্বের নামার ওয়ান। এত কিছু দেখার আছে শিকাগোতে যে এক মাস ঘুরলেও শেষ হবে না। উল্লেখযোগ্য হিসেবে বলা যায় মিলেনিয়াম পার্ক, নেভি পিয়ার, ম্যাগনিফিসেন্ট মাইল, দ্য আর্ট ইনস্টিটিউট অব শিকাগো, মিউজিয়াম ক্যাম্পাস, দ্য উইলিস (সিয়ার্স) টাওয়ার, গ্র্যান্ট পার্ক, দ্য মিউজিয়াম অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি, লিঙ্কন পার্ক জু প্রভৃতি।

সিয়ার্স টাওয়ার
ছবি: লেখক

শিকাগো সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ভিজুয়াল আর্টস, সাহিত্য, সিনেমা, থিয়েটার, কমেডি (বিশেষভাবে ইম্প্রোভাইশনাল কমেডি), খাবারদাবার ও সংগীত (বিশেষভাবে জ্যাজ, ব্লুজ, সোল, হিপ-হপ, গ্যাসপেল ও ইলেকট্রনিকস ড্যান্স মিউজিক যেখানে হাউস মিউজিক অন্তর্ভুক্ত)। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতেও শিকাগো সেরা। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়সে বহু শিক্ষার্থী উচ্চতর শিক্ষার মাধ্যমে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। শিকাগো শহরে আমেরিকার সব পেশাদার খেলারই ‘মেজর প্রফেশনাল লিগ’ আছে। বাস্কেটবলে পুরো আমেরিকায় সেরা হলো শিকাগো।

১৮০০ শতাব্দীর মধ্যভাগে এলাকাটি আমেরিকান আদিবাসী পোটাওয়াটোমিদের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল, যারা জায়গাটি মিয়ামি এবং সোক ও ফক্স আদিবাসীদের কাছ থেকে দখল করেছিল। শিকাগোতে প্রথম আদিবাসী নয়, স্থায়ী বাসিন্দা হলেন জঁ বাতিস্ত পোয়াঁ দ্যু সাব্ল। দ্যু সাব্ল আফ্রিকা ও ফরাসি বংশধর ছিলেন। ১৭৮০-এর দশকে তিনি আফ্রিকায় পৌঁছেছিলেন। তিনি সাধারণত ‘শিকাগোর প্রতিষ্ঠাতা’ হিসেবে পরিচিত।

নেভি পিয়ার ফেরিস হুইল
ছবি: লেখক

১৮৭১ সালে গ্রেট শিকাগো ফায়ার ৪ মাইল (৬.৪ কিলোমিটার) লম্বা এবং ১ মাইল (১.৬ কিলোমিটার) প্রশস্ত একটি এলাকা ধ্বংস করে দেয়। যেটা সেই সময়ে শহরটির একটি বড় অংশ ছিল। রেলপথ ও স্টকায়র্ডসহ বেশির ভাগ আগুন থেকে বেঁচে গিয়েছিল। পূর্ববর্তী কাঠের কাঠামোর ধ্বংসাবশেষের ওপরে ইস্পাত ও পাথরের আরও আধুনিক স্থাপনা নির্মাণ করা হয় পরবর্তী সময়ে। বিশ্বব্যাপী নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ স্থাপন করবে এসব। ইস্পাতের কাঠামো ব্যবহার করে ১৮৮৫ সালে শিকাগো বিশ্বের প্রথম আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ করে।

শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে নদী
ছবি: লেখক

শিকাগোর সমৃদ্ধ অর্থনীতি বিপুলসংখ্যক ইউরোপীয় ও পূর্ব আমেরিকার অভিবাসীদের আকৃষ্ট করেছিল। ১৯০০ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, শিকাগোর ৭৭ শতাংশের বেশি অধিবাসী বিদেশে জন্মগ্রহণকারী কিংবা বিদেশে জন্মগ্রহণকারী পিতামাতার মাধ্যমে জন্ম নেওয়া। জার্মান, আইরিশ, পোলিশ, সুইডিশ ও চেকরা ছিল এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে ১৯২০ সালের পরে অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দক্ষিণ থেকে বহু আফ্রিকান আমেরিকান শিকাগোতে আসতে শুরু করে। ১৯৩০ সালের মধ্যে আফ্রিকানদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৪ হাজার ১০৩ থেকে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৯০৩ জনে পৌঁছায়। এই বৃহৎ অভিবাসনের একটি অসাধারণ সাংস্কৃতিক প্রভাব ছিল, যা শিকাগো ব্ল্যাক রেনেসাঁ নামে পরিচিত।

গ্যাংস্টারদের রাজত্ব ও জাতিগত দাঙ্গা ছিল উনিশ শতকের শুরুতে। ১৯২০-এর দশকে শিকাগোর রাস্তায় দেখা যেত এল ক্যাপন, ডিওন বানিওন, বাগস মোরান এবং টনি আকার্ডোর মতো গ্যাংস্টারদের নিজেদের মধ্যে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছে।

এডলার প্লানেটোরিয়াম
ছবি: লেখক

শিকাগো শহরের ৪৫ শতাংশ মানুষ শ্বেতাঙ্গ, ৩২.৯ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ, ২৮.৯ শতাংশ হিস্প্যানিক বা ল্যাটিনো এবং ৫.৫ শতাংশ এশিয়ান। তবে জনসংখ্যার ৭১ শতাংশ খ্রিষ্টান, ২২ শতাংশের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, বাকি ৭ শতাংশের মধ্যে আছে ইহুদি, মুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। ১৮৯৩ ও ১৯১৩ সালে বিশ্ব ধর্মের প্রথম সংসদ অনুষ্ঠিত হয় এ শহরে। স্বামী বিবেকানন্দ সে সম্মেলনে বক্তব্য রেখে বিশ্ববাসীর কাছে হিন্দুধর্মের কথা তুলে ধরেন।

রিগলে বেসবল ফিল্ড
ছবি: লেখক

শিকাগো বিশ্বের উন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী একটি শহর। এই শহরের অর্থনীতি শিকাগো স্কুল অব ইকোনোমিকসের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছে। এই স্কুল থেকে ১২ জন অর্থনীতিবিদ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, পর্যটন, স্থাপত্য, খাবারের বিশিষ্টতা—সব দিক থেকে শিকাগো অনন্য। আমেরিকার একটি সেরা ক্রীড়া শহরও এটি। বোস্টনের পাশাপাশি এটি একমাত্র শহর, যেটি ১৮৭১ সাল থেকে সব ধরনের পেশাদার ক্রীড়া নিয়মিতভাবে আয়োজন করে আসছে। শিকাগো বুলস বিশ্বের স্বীকৃত ও জনপ্রিয় বাস্কেটবল দলের মধ্যে একটি। শিকাগোর বর্তমান মেয়র হলেন রাহম এমানুয়েল।

নিউইয়র্ক সিটি ও লস অ্যাঞ্জেলেসের পর শিকাগো উত্তর আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম মিডিয়া বাজার এবং একটি প্রধান মিডিয়া হাব। সিবিএস, এবিসি, এনবিসি ও ফক্স—প্রতিটির একটি হাই ডেফিনিশন টেলিভিশন স্টেশন আছে শিকাগোতে। এখান থেকে অনেক নামকরা টক শো যেমন দ্য অপরাহ উইনফ্রে শো, স্টিভ হার্ভে শো, দ্য রোজি শো, দ্য জেরি স্প্রিঞ্জার শো, দ্য ফিল ডোনাহু শো, দ্য জোন্স শো পরিচালিত হয়। পারফেক্ট স্ট্রেঞ্জার্স, শিকাগো হোপ, দ্য গুড ওয়াইফ, শিকাগো ফায়ারসহ বহু জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালের সেট এখানে।