৫০ হাজারের বেশি মানুষের কঙ্কালে সাজানো যে গির্জা

চেক প্রজাতন্ত্রের সেডলেক ওসারির পরিচিতি ‘কঙ্কালের গির্জা’ হিসেবে। ধারণা করা হয়, রোমান ক্যাথলিকদের এই উপাসনালয়ে ৫০ থেকে ৭০ হাজার মানুষের কঙ্কাল সাজানো আছে।

গির্জায় ঘুরতে আসা বিভিন্ন দেশের পর্যটকেরা
ছবি: লেখক

হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে একজন পরামর্শ দিলেন, আপনি তো ভ্রমণে এসেছেন, সেডলেক ওসারিতেও যেতে পারেন।

চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ থেকে এক ঘণ্টার পথ কুতনা হোরা এলাকা। এই এলাকাতেই রোমান ক্যাথলিক গির্জাটি। প্রাগের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। অথচ সেডলেক ওসারি আমার ভ্রমণের তালিকাতেই ছিল না!

স্থানীয় একটি ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে গির্জা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। গাড়িতে সঙ্গী ছিলেন বিভিন্ন দেশের আরও সাতজন পর্যটক। যাওয়ার পথে মনে হচ্ছিল গির্জা সম্পর্কে গুগল করে কিছু তথ্য জেনে নিই। কিন্তু ইচ্ছা দমন করলাম, আগে থেকে কিছুই জানব না সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই সিদ্ধান্তের সুফল অবশ্য আমি পেয়েছি। কারণ, গির্জায় যা দেখেছি, কৌতূহলী হয়ে জানার চেষ্টা করেছি, ইতিহাস পড়েছি।

সেডলেক ওসারির পরিচিতি ‘কঙ্কালের গির্জা’ নামে

শুরুটা গির্জার ফটক থেকে। মানুষের হাড় ব্যবহার করে সাজানো প্রবেশপথ। ভেতরেও কি এমন? তখনও জানি না কেমন হবে। তবে গির্জার ভেতরে ঢুকতেই চোখজোড়া ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। কঙ্কাল আর কঙ্কাল—মাথার খুলি, হাড়, দাঁত। এসবেই সাজানো ভেতরটা। এমন দৃশ্য শুধু ভৌতিক ছবিতেই আমি দেখেছি। সেখানকার পরিবেশও ভুতুড়ে। পর্যটকদের কেউ কোনো কথা বলছিলেন না। তাদের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল শুধু। কোথাও থেকে আসছিল ক্যামেরার শব্দ। গির্জার ভেতরের দৃষ্টিনন্দন জিনিসটি হলো কঙ্কালের বড় এক ঝাড়বাতি। বলা হয়ে থাকে, এই ঝাড়বাতিটি মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি। ঝাড়বাতিটির চারপাশে মানুষের মাথার খুলি দিয়ে সজ্জিত চারটি স্তম্ভ রয়েছে।

গির্জার ভেতরে কঙ্কালের ঝাড়বাতি

ঘুরতে ঘুরতে সেডলেক ওসারি বা ‘কঙ্কালের গির্জা’র ওপর প্রকাশিত বইয়ে চোখ বুলাচ্ছিলাম। সেখান থেকেই জানলাম, ওসারি অর্থ কঙ্কাল দিয়ে তৈরি কাঠামো। আক্ষরিক অর্থ ‘মৃতদের হাড় জমা করা’। ধারণা করা হয়, এই গির্জায় ৫০ থেকে ৭০ হাজার মানুষের কঙ্কাল সাজানো আছে। কেন এমনটা করা হয়েছে?

এর পেছনে আছে ঐতিহাসিক এক ঘটনা। এটি প্রথমে গির্জা ছিল না। সমাধিক্ষেত্র হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল ১১০০ সালের কোনো একসময়ে। তবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আরও পরে। জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে একটি প্রচলিত গল্প আছে। ১২৭৮ সালের কোনো একসময় হেনরি নামে একজন মঠ–অধ্যক্ষ জেরুজালেম গিয়েছিলেন। তাঁকে পাঠিয়েছিলেন চেক প্রজাতন্ত্রের বোহেমিয়া অঞ্চলের রাজা দ্বিতীয় ওটোকার। জেরুজালেম থেকে কিছু মাটি সঙ্গে নিয়ে ফেরেন ওই মঠ–অধ্যক্ষ। সেই ‘পবিত্র মাটি’ সমাধিক্ষেত্রের চারদিকে ছড়িয়ে দেন হেনরি। এরপর ওই এলাকার মানুষ পুণ্যলাভের আশায় মৃত্যুর পরে সেখানে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। ধীরে ধীরে সেডলেক সবচেয়ে জনপ্রিয় সমাধিক্ষেত্র হয়ে ওঠে।

কঙ্কাল দিয়ে এভাবেই সাজানো হয়েছে গির্জার ভেতরটা

১৪০০ সালের দিকে ইউরোপে ‘ব্ল্যাক ডেথ’-এর কারণে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। তাঁদের অনেককেই কুতনা হোরার এই সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়। একসময় ওই সমাধিক্ষেত্রে কাউকে সমাহিত করার মতো জায়গার সংকট দেখা দেয়। তখন ‘অস্থি সংরক্ষণাগার’ হিসেবে সেখানে একটি গির্জা নির্মাণ করা হয়।

কথিত আছে ১৫০০ সালের প্রথম দিকে একজন সন্ন্যাসীকে খুলি ও হাড়গোড় বের করা এবং তা বাছাইয়ের কাজ দেওয়া হয়। তিনি অস্থিগুলো জড়ো করে নান্দনিকভাবে সাজিয়ে রাখেন।

১৭০০ সালের দিকে স্থপতি জ্যান সান্তিনি আইচেল গির্জাটি পুনর্নির্মাণ করেন। তাঁর মতো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন গির্জার ভেতরে মৃত মানুষের হাড়গোড় ও কঙ্কাল সাজিয়ে রাখার দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৭০ সালে ফ্রান্তিশেক রিন্ত নামের এক কাঠমিস্ত্রি সমাহিত মানুষের কঙ্কাল, মাথার খুলি ও হাড় সাজিয়ে রাখার বিভিন্ন কাঠামো তৈরির দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় থেকেই এই গির্জা কঙ্কালের গির্জার নামে পরিচিতি পায়।