হাতিরঝিলের রাস্তার গর্তে অটোরিকশা, দুজন আহত এবং একটি টুইস্ট
বিকল সিএনজিচালিত অটোরিকশাটা পাশ কাটিয়ে আমরা প্রায় চলেই যাচ্ছিলাম। আমার স্ত্রী (নুসরাত জাহান) রিজভী বলল, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, ভেতরে মানুষ আছে।’
ঝুম বৃষ্টির মধ্যে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলাম ধীরে ধীরেই। তাৎক্ষণিকভাবে মোটরসাইকেল থামাতেই রিজভী দৌড়ে গেল। অটোরিকশাটির সামনের উইন্ডশিল্ড ভেঙে রাস্তায় পড়ে আছে, সামনের চাকাটা গর্তে, দেখে মনে হচ্ছে কেউ বাহনটার ঘাড় মটকে দিয়েছে।
কাছে গিয়ে দেখি, চালক মাথা তুলতে পারছেন না। তবু বাঁ হাত দিয়ে গেট খুলে বের হওয়ার চেষ্টা করছেন। আমরা সাহায্য করতে এগিয়ে গেছি দেখে বৃষ্টির থেকে বাঁচতে যাত্রীছাউনিতে আশ্রয় নেওয়া দুজন চলে এলেন। তারপর চালককে বের করে যাত্রীছাউনির নিচে নেওয়া হলো। স্যাঁতসেঁতে জায়গাটাতেই তাঁকে শোয়ানো হলো। মাথা আর বুকে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছেন, কাতরাচ্ছেন।
এতক্ষণ খেয়াল করিনি, ভেতরে একজন যাত্রীও ছিলেন। চালকের মতো তিনিও বের হওয়ার চেষ্টা করছেন। এই দেখে কয়েকজন গিয়ে তাঁকেও বের করে এনে বসালেন। ওই ব্যক্তির কপাল কেটে গেছে, রক্ত ঝরছে। মনে হচ্ছে তিন-চারটি সেলাই পড়বে।
রক্তপাত থামাতে আমাদের হাতের কাছে তেমন কিছুই নেই। অগত্যা কাটা অংশ হাত দিয়ে চেপেই রক্তপাত ঠেকানোর চেষ্টা করা হলো। সড়ক বিভাজকে প্রচুর দূর্বাঘাস। কচিপাতা তুলে হাতের তালুতে পিষে যাত্রীর কপালে লাগিয়ে দিল রিজভী। তাঁর ব্যাগে ব্যথানাশক মলম ছিল, সেটিও দেওয়া হলো।
আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়া দরকার। একটি গাড়ি পেলে ভালো হয়। ৯৯৯-এ ফোন করলাম। রাত ৮টা ৫৫ মিনিটের দিকে হাতিরঝিল থানার সঙ্গে যোগাযোগ হলো। ঘটনাস্থলসহ (হাতিরঝিল চক্রাকার সড়কের রেড ক্রিসেন্ট অফিসের কাছাকাছি) বিস্তারিত শুনল। সব শুনে একজন এসআইকে (সাব–ইন্সপেক্টর) দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বলল। মিনিট দশেক পর দায়িত্বপ্রাপ্ত এসআই ফোন করেও ঘটনার বিস্তারিত জানলেন। শুনে বললেন, তাঁর সঙ্গে গাড়ি নেই, তাঁদের থানার অন্য টিমকে পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন।
রাস্তায় অটোরিকশাটি পড়ে আছে। বাহনটা ফেলে গেলে যদি হারিয়ে যায়? চালক তাই কোনোমতে গাড়ির মালিককে ফোন দিলেন। দুর্ঘটনার বিষয়টা জানালেন।
দুর্ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই ভয় পেয়েছেন। তখনো কাঁপছেন। ট্রমার মধ্যে ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছেন না। আশপাশ থেকে আরও লোকজন চলে এলেন। একদল কিশোর বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলছিল, তারাও এসে উৎসুক দৃষ্টিতে দাঁড়াল। কয়েকজন গিয়ে গাছের ডালপালা ভেঙে রাস্তাটার মুখে ফেলল, আরও দুর্ঘটনা ঠেকাতে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিলেন।
মিনিট দশেক পর এসআইকে ফোন করলাম। আগের মতোই তিনি বললেন, অন্য টিম গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।
অনিশ্চয়তার মধ্যে আর কতক্ষণ থাকা যায়! বুঝলাম, অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। বৃষ্টি একটু কমেছিল, আবার পড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যেই আহত যাত্রীকে একজনের বাইকে তুলে দিলাম। পাঠানোর সময় আহতজনের ফোন নম্বরটাও নিলাম। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো মগবাজারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে।
এদিকে চালক ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করছেন দেখে দুজন সহায়তা করলেন। তিনি বসলেনও। তাঁর লোকজন তখনো ধোলাইখালে। অন্য এক অটোরিকশাচালক নিজের গাড়ি থেকে নেমে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটা একপাশে চাপিয়ে রাখলেন। আমরা আহত চালককে মানসিক শক্তি জোগানোর জন্য বারবার বললাম, ‘আপনার তেমন কিছু হয়নি।’
এতে কাজ হলো। তাঁকে দেখে আগের চেয়ে সুস্থ মনে হলো।
এর মধ্যে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত এসআই ফোন করলেন। জানালেন, গাড়ি নিয়ে তিনি রেড ক্রিসেন্টের গেটের কাছে আছেন। বললাম, ‘৪৫ মিনিট পর আপনার গাড়ি দিয়ে আর কী হবে!’
এতে তিনি খুশিই হলেন মনে হলো।
আহত চালক দুজনের সহায়তায় ততক্ষণে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এক পা, দুই পা ফেলে হাঁটাহাঁটি করছেন। নিজের হাতে–বুকে মালিশ করছেন। তাঁর লোকজনও কাছাকাছি এসেছে জানালেন। আমরা বিদায় নিলাম। তিনি বিদায় দিতে গিয়ে কৃতজ্ঞতায় দুই হাত চেপে ধরলেন। চালকের চোখ ভেজা!
বাসায় ফিরে আহত যাত্রীকে ফোন করলাম। জানালেন, প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তিনি অপেক্ষা করছেন, ‘ডিপার্টমেন্টের লোক’ এলে তিনি হাসপাতালে যাবেন। ‘ডিপার্টমেন্টের লোক’ শুনেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি পুলিশে আছেন?’
‘জি ভাই, আমি এসআই।’