আমার পড়াশোনার জন্য বাবা জমি বিক্রি করেছেন, হালের গরু বিক্রি করেছেন, ঋণ নিয়েছেন, তবু আমাকে হারতে দেননি
সদ্যই বাবাকে হারিয়েছেন কেউ, কেউবা সেই শৈশবে, কারও বাবা আছেন বৃক্ষের মতো ছায়া হয়ে। তবে সবার বেড়ে ওঠায় মিশে আছে বাবার আদর, শাসন, অনুপ্রেরণা। প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয় বাবা দিবস। সেই হিসাবে কাল বাবা দিবস। দিনটি উপলক্ষে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে ছাপা হয়েছে বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কয়েকজন সন্তানের লেখা। এখানে তেমনই একটি লেখা।
নওগাঁর বদলগাছীর প্রত্যন্ত এক গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা। বাবা আফজাল হোসেন পুরোদস্তুর একজন প্রান্তিক কৃষক। আমার জীবনেরও বড় একটি সময় বাবার সঙ্গে কৃষি কাজ করে কেটেছে। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত মাঠে কাজ করতাম, এরপর বাড়ি ফিরে রেডি হয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে ফিরেও বাবাকে সাহায্য করতে মাঠে যেতাম। গরু না থাকলে বাবা আর ছেলে মিলে মই দেওয়া, মাটি কেটে উল্টে দেওয়া—সবই করতাম। ধানখেতে নিড়ানি দিতে দিতে বাবার কাছ থেকে তাঁর ছেলেবেলার গল্প শুনতাম। কাজ করতে করতে যখন স্কুলের সময় হয়ে যেত, তখন তিনি নিজেই বলতেন, ‘যাও স্কুলে। আমি জীবনে যে সুযোগটি পাইনি, তোমরা সেটা হারিয়ে ফেল না।’
বাবার বয়স যখন ১০ কি ১১ বছর, তখন তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন। এরপর তাঁর কাঁধে চাপে সংসারের ভার। তাই স্কুলের আঙিনায় আর কোনো দিন পা মারাতে পারেননি। তবে সব সময় মনে হতো আমার পড়াশোনা না জানা বাবা চিন্তা ও চেতনায় কোনো শিক্ষিত মানুষের চেয়ে কম নন।
বাবাকে বুঝেছি বলেই তাঁর কথা কখনোই ফেলতাম না। একদিন এসএসসি পাস করলাম। স্কুলের সর্বোচ্চ ফলাফল আমার ঝুড়িতে থাকলেও কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে সংকট দেখা দিল। দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ভর্তির টাকা থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে যে খরচ হবে তার সংকুলান করা কঠিন। গ্রামের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি বাবাকে বুঝিয়েছিলেন, চাকরির পাশাপাশি জমিজমা থাকার পরও তাঁরা সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হিমশিম খাচ্ছেন। আমার বাবার না আছে চাকরি, না তেমন জমিজমা। তাহলে কীভাবে তিনি আমাকে কলেজে পড়াবেন। এর চেয়ে ভালো হয়, রাজশাহীতে আমাকে প্যারামেডিকসে ভর্তি করালে দুই-তিন বছরে পাস করে গ্রামে ওষুধের দোকান দিয়ে দিব্যি চলতে পারব।
আমরা তিন ভাই-বোন কাছাকাছি বয়সী। সবাইকে পড়াশোনা করাতে হিমশিম খাচ্ছেন মা-বাবা। অনেকের পরামর্শে একদিন আমাকে রাজশাহী শহরে নিয়ে গেলেন। বাবা–ছেলে সেবারই প্রথম রাজশাহী শহর দেখলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া গ্রামের একজনের ছাত্রাবাসে গিয়ে উঠলাম। কথা ছিল পরের দিন কলেজ থেকে ফরম তুলে ভর্তির প্রস্তুতি নেব। কিন্তু ওই দিন সন্ধ্যায় রাজশাহী প্যারামেডিকেল কলেজ ঘুরে আসার পর কিছুতেই আমার মন সায় দিল না। আমি কিছুটা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবাকে বললাম, ‘আমি এখানে ভর্তি হব না, সাধারণ কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হব।’
বাবার সীমাবদ্ধতা আমি জানতাম, কিন্তু পড়াশোনার খরচ জোগানো যে কঠিন, তা বাবা বুঝতে দিতে চাইতেন না। আমার শক্ত অবস্থান দেখে পরদিন বাসায় ফেরার পথে বাবা আমাকে একটি গল্প শোনালেন, ‘কেউ যদি ঢাকায় যেতে চায়, তাহলে তাকে হয় বাসস্ট্যান্ড অথবা ট্রেনস্টেশনে যেতে হবে। এখন তুমি যদি সেখানে পৌঁছাতে না পারো, তাহলে কীভাবে যাত্রা করবে?’
রাজশাহী থেকে নওগাঁয় পৌঁছার পর তিনি সাহস করে পকেট থেকে ২০ টাকা বের করে দিয়ে বললেন, ‘যাও কলেজের ভর্তি ফরম কিনি নিয়ে আসো। তোমার পড়াশোনার জন্য বসতভিটা বিক্রি করতে আমার সমস্যা হবে না।’
এই যে সাহসটুকু নিয়ে বাবা আমাকে এগিয়ে দিয়েছেন, সেই এগিয়ে যাওয়া আর কেউ থামাতে পারেনি। আমার পড়াশোনার জন্য বাবা খেতের জমি বিক্রি করেছেন, গাছ বিক্রি করেছেন, হালের গরু বিক্রি করেছেন, ঋণ নিয়েছেন, তবু আমাকে হারতে দেননি। আর হারতে দেননি বলেই কৃষক বাবার সন্তান পরিচয় দিতে সব সময় গর্ববোধ করেছি। সেই গর্ব নিয়েই এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। অক্ষরজ্ঞানহীন বাবাটাকে জীবনে না পেলে হয়তো সায়েন্টিস্টই হতে পারতাম না!
বাবার আদর্শে আমার ছোট ভাই-বোনও বড় হয়েছে। আমার মতো ভাইটাও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছে আর বোনটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। আমাদের জীবনের যাবতীয় অর্জনে মিশে আছে আমার কৃষক বাবার আদর্শ।