তাঁর হাত ধরেই আসে আর্চারিতে দেশের প্রথম ব্যক্তিগত পদক, দিয়া–আলিফদের কোচও তিনি

এশিয়া কাপে আর্চারিতে সোনা জিতেছেন বাংলাদেশের আবদুর রহমান আলিফ। বিকেএসপির এই ছাত্রের কোচ নূরে আলম। বাংলাদেশে আর্চারির শুরু থেকেই খেলাটির সঙ্গে আছেন তিনি। তাঁর হাত ধরেই আসে আর্চারিতে দেশের প্রথম ব্যক্তিগত পদক। বিকেএসপিতে আর্চারি বিভাগ চালু হলে তাঁকেই দেওয়া হয় কোচের দায়িত্ব। তাঁর তত্ত্বাবধানেই ঠিক হয়েছে শেখ সজীব, তামিমুল ইসলাম, দিয়া সিদ্দিকী, আবদুর রহমান আলিফদের তীর-ধনুকের নিশানা। তাঁর জীবনের আরও গল্প শোনাচ্ছেন সজীব মিয়া

বিকেএসপির আর্চারি বিভাগে শুরু থেকেই কোচের দায়িত্ব পালন করছেন নূরে আলমছবি: রাজীব কুমার দেব

শিষ্যদের খেলা থাকলে ভীষণ চাপে থাকেন নূরে আলম। ২০ জুনেও তাঁর একই অবস্থা হলো। এশিয়া কাপ আর্চারিতে জাপানের মিয়াতা গাকুতোর সঙ্গে লড়ছিলেন বাংলাদেশের আবদুর রহমান আলিফ। সাভারে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) বাসায় বসে বারবার জানার দেখছিলেন পয়েন্টে কতটা এগোল আলিফ। একসময় দেখলেন তাঁর ছাত্র জিতে গেছে। চোখে আর পানি ধরে রাখতে পারলেন না। পাশে থাকা মেয়ে এগিয়ে দিলেন টিস্যুর বক্স।

সেদিনের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে ২৩ জুন দুপুরেও যেন ধরে এল তাঁর গলা। বললেন, ‘আমার আসলে ওরকমই হয়।’

প্রতিদিন সাতসকালে মাঠে যান নূরে আলম। ছাত্রছাত্রীদের তির–ধনুকের সবক দিতে দিতে দুপুর ১২টা বেজে যায়। তারপর বাসায় ফেরেন। খাবার খেয়ে আবার বেলা তিনটায় ছুটে যান মাঠে। কোচিংয়ের পাশাপাশি বিকেএসপির আর্চারি বিভাগের প্রধান হিসেবে দাপ্তরিক কাজও করতে হয়, সেসব সারতে সারতে সন্ধ্যা। প্রথমে খেলোয়াড় ও পরে কোচ হিসেবে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এভাবেই আর্চারির সঙ্গে পথচলা। সেদিন দুপুরে মাঠে যাওয়ার পথে ফোনের ওপ্রান্ত থেকে শোনালেন সেই পথচলার গল্প।

এশিয়া কাপে আর্চারিতে সোনা জয়ী শিষ্য আবদুর রহমান আলিফের সঙ্গে কোচ নূরে আলম
ছবি: বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশন

আর্চারিতে খো খো ক্যাপটেন

নূরে আলমের বেড়ে ওঠা পাবনার সাঁথিয়ায়। স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়ে ২০০০ সালে ঢাকায় এসে ভর্তি হন সরকারি বাঙলা কলেজে। অনার্সে বিষয় বাংলা। পড়াশোনার পাশাপাশি বিএনসিসির (বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর) সদস্য হিসেবে যুক্ত হন। কলেজের খো খো দলেও নাম লেখান। বছর কয়েক পরে এই খো খো দলের অধিনায়ক হন নূরে আলম। এর মধ্যেই একটি ঘটনা তাঁকে আর্চারির দুনিয়ায় নিয়ে গেল।

২০০৩ সালের কথা। ঢাকায় বসেছে আর্চারি আসর। বিএনসিসির স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে গেলেন নূরে আলম। ছোটবেলায় তির-ধনুক নিয়ে কত খেলেছেন। কিন্তু এটা যে প্রতিযোগিতামূলক একটা খেলা, সে সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। সেদিনই আর্চারির প্রতি ভালো লাগা তৈরি হলো। আয়োজকদের বলে রাখলেন, এরপর খেলা হলে যেন নূরে আলমকেও ডাকা হয়।

২০০৪ সালে বাংলাদেশে আর্চারি অ্যাসোসিয়েশনের যাত্রা শুরু হলো। অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হলেন বিএনসিসি বাঙলা কলেজের ইউনিটপ্রধান ফারুক ঢালী। তাঁর হাত ধরেই আর্চারি দলে ভিড়ে গেলেন নূরে আলম। জাতীয় দল নিয়ে শুরুতে এক মাসের ক্যাম্প করা হলো। প্রশিক্ষণ দিলেন ভারতীয় এক কোচ। তারপর নিজেদের মধ্যেই প্রতিযোগিতা হলো। সেখানে চতুর্থ হলেন নূরে আলম।

এভাবেই নতুনদের গড়ে তোলেন কোচ নূরে আলম
ছবি: রাজীব কুমার দেব

একই বছর প্রথম জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেলেন আলম। মাস দুয়েক পরই অনার্স ফাইনাল। দ্বিধায় পরে গেলেন আলম। বিএনসিসির সদস্য আর খো খো দলের ক্যাপটেন হিসেবে কলেজে তাঁর ভালো পরিচিতি ছিল। শিক্ষকেরাও আদর করতেন। নূরে আলম পরীক্ষার আগে ক্যাম্পে যেতে চান শুনে শিক্ষকদের কেউ কেউ বললেন, ‘২০ বছর পড়াশোনা করে এত দূর এসেছে। এই সব কি ‘আছারি-মাছারি’ খেলতে? পরীক্ষা দিয়ে চাকরির পড়া পড়ো। ’

নূর আলম বলেন, ‘আর্চারি দেশে নতুন। খেলাটা সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা ছিল না। এই খেলা খেলে ভবিষ্যৎ নষ্ট, এর বেশি কিছু কেউ ভাবতে পারত না। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যাম্পে অংশ নেব। মনে মনে ভাবলাম, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রতিবছর অনার্স পাস করেন। জাতীয় দলের সদস্য হওয়ার সুযোগ কয়জন পান?’

১৫ দিনের ক্যাম্পে রাঙামাটি চলে গেলেন। ঢাকা থেকে সঙ্গী আরও ১০-১২ জন। স্থানীয় পর্যায় থেকে অংশ নিলেন আরও কয়েকজন তরুণ। সরঞ্জাম তেমন নেই। কোরিয়া থেকে উপহার পাওয়া চারটি রিকার্ভ আর ভারত থেকে কেনা বাঁশের তীর-ধনুক ভাগাভাগি করে চলল প্রশিক্ষণ।

প্রশিক্ষণ শেষ করে এসে পড়ায় মন দিলেন। নোট সরবরাহ করে বন্ধুরা সহায়তাও করল। এভাবেই অনার্স পরীক্ষা দিলেন নূরে আলম।

‘বাংলার আর্চারি’ নামে নূরে আলমের লেখা বই
ছবি: সংগৃহীত

খেলতে খেলতেই কোচ

আর্চারিতে নূরে আলম ধীরে ধীরে ভালো করতে থাকলেন। ২০০৪ সালেই বাংলাদেশ আনসারে খেলোয়াড় কোটায় নিয়োগ পেলেন। আনসারের আর্চারি দলের পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়েও অংশ নিতে থাকলেন নানা প্রতিযোগিতায়।

২০০৫ সাল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান আর্চারিতে অংশ নিলেন নূরে আলমেরা। সেই আসরে ভুটান, নেপাল, সিঙ্গাপুরের মতো দেশকে পেছনে ফেলে নতুন গড়া দলটি হলো সপ্তম। ২০০৬ সালেই পদকের সন্ধান পেল বাংলাদেশ দল। সে বছর কলম্বো এসএ গেমস থেকে একটি দলীয় ও একটি ব্যক্তিগত ব্রোঞ্জ পেল বাংলাদেশ। দেশের প্রথম ব্যক্তিগত সেই পদকটি নূরে আলমের হাত ধরেই এল। পরের বছর ভারতের জামশেদপুর কমনওয়েলথ আর্চারিতে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী প্রতিযোগিতায় পরাজয় এখনো মনে রেখেছেন নূরে আলম। এভাবেই নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চলতে থাকে বাংলাদেশ আর্চারি দল। দলের হয়ে কখনো সফল হলেন, কখনো পেলেন পরাজয়ের কষ্ট, কিন্তু তির-ধনুক ছাড়লেন না নূরে আলম।

খেলার পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যান নূরে আলম। ২০০৭ সালে মাস্টার্স পাস করেন। তার আগেই অবশ্য কলেজের সহপাঠী রাবেয়া আক্তারের সঙ্গে যৌথজীবন শুরু করেছেন। তাঁদের ঘরে এসেছে এক ছেলে।

২০০৮ সালেই জানা যায় বিকেএসিতে আর্চারি বিভাগ খোলা হবে। বিকেএসপি থেকে কোচ চাওয়া হলে নূরে আলমের নাম প্রস্তাব করে বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশন। ২০১০ সালের সাফ গেমস সামনে রেখে বিকেএসপিতে তখন জাতীয় আর্চারি দলের ক্যাম্প চলছিল। ক্যাম্পে থাকতেই একদিন বিকেএসপির তৎকালীন মহাপরিচালকের তরফ থেকে ডাক পেলেন নূরে আলম। জীবনবৃত্তান্ত সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দেখা করলেন। পর দিন ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা তাঁর সাক্ষাৎকার নিলেন। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি কোচ হিসেবে বিকেএসপিতে নিয়োগ পেলেন। নূরে আলম বলছিলেন, ‘বিকেএসপির কোনো বিভাগের প্রধান হতে ন্যূনতম স্নাতক হতে হয়। সে সময় আমি ছাড়া আর্চারির আর কোনো খেলোয়াড় স্নাতক করেননি। কোচ হিসেবে আমার ডাক পাওয়ার এটাও একটা বড় কারণ।’

২০০৯ সালের বিকেএসপির প্রথম ব্যাচে আর্চারির ছাত্র ছিলেন শেখ সজীব। পরের বছর দক্ষিণ এশীয় গেমসে দেখা গেল নূরে আলমের পাশাপাশি তাঁর ছাত্র শেখ সজীবও অংশ নিয়েছেন। ছাত্র-শিক্ষক দুজনই সে আসরে পদক জেতেন। সেই থেকে বিকেএসপিতে আর্চারির কোচ নূরে আলম। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে আছেন সোনাজয়ী তামিমুল ইসলাম, আশিকুজ্জামান, হীরামণি, রাজিয়া আক্তার শাপলা, দিয়া সিদ্দিকীরা। তিনি জানালেন, বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলা ৩৬ তিরন্দাজ সরাসরি তাঁর শিষ্য।

নূরে আলমের এখন একটাই স্বপ্ন, ‘আমার কোনো স্টুডেন্টের হাত ধরে আসুক অলিম্পিক পদক।’

আরও পড়ুন