ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিভাগ থেকেই ইন্টেলে অন্তত ২২ জন

বাঁ থেকে মাকসুদুর রহমান, তাহমিনা আক্তার ও সাদ্দাম হোসেন। ঢাবির ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের এই তিন অ্যালামনাইয়ের মতো আরও অনেকেই কাজ করছেন ইন্টেলে।
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের যত প্রতিষ্ঠান সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরি করে, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালীগুলোর একটি ইন্টেল করপোরেশন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অন্তত ২২ জন স্নাতক বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে আবার ৯ জনই কাজ করেন সদর দপ্তরে। শুধু যে ব্যক্তিগত দক্ষতা বা পরিশ্রম দিয়েই এক বিভাগের এতজন ইন্টেলে যুক্ত হয়েছেন, তা নয়। বিভাগের শক্তিশালী শিক্ষাক্রম, গবেষণার পরিবেশ, অ্যালামনাইরাও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন।

স্নাতকেই গড়ে উঠেছে ভিত্তি

ইন্টেল করপোরেশনে জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন তাহমিনা আক্তার। ঢাকা সিটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই রসায়নের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। সেই আগ্রহ থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে ভর্তি হন। ক্লাস শুরু হওয়ার পর মজা পেয়ে যান। তাই পিএইচডির সময়ও গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নেন সেমিকন্ডাক্টরের উপাদান। জীবনের মোড় ঘোরানোর ক্ষেত্রে বিভাগের বড় ভূমিকা আছে বলেই মনে করেন এই প্রকৌশলী। বলছিলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ার সময়ই বিভিন্ন বিষয় গভীরভাবে শেখার সুযোগ পেয়েছি। কেমিক্যাল প্রসেস, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সের ধারণা থেকে শুরু করে বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনার দক্ষতা স্নাতক থেকেই তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে শিখতে পারার এই বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা আমাকে সেমিকন্ডাক্টর তৈরির প্রক্রিয়া ও উপাত্ত বিশ্লেষণের জটিলতাগুলো ভালোভাবে বুঝতে সহায়তা করেছে। এসবই ক্যারিয়ারের প্রতিটি ধাপে কাজে এসেছে।’

একই বিভাগের অন্তত ২২ জন এমন নামী প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পাওয়া যে স্রেফ কাকতালীয় কিছু নয়, তাহমিনার কথাতেও সেটি বোঝা গেল। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিভাগের অ্যালামনাইদের নেটওয়ার্ক বেশ ভালো। নিজের জায়গা থেকে বলতে পারি, এখানে যোগ দেওয়ার পর আমার যত জুনিয়র এখানে পড়তে এসেছে, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, আমি তাদের পরামর্শ দিয়েছি। আমাদের বিভাগের পাঠ্যক্রমও পথটা অনেক সহজ করে দিয়েছে। তাত্ত্বিক বিষয়ের পাশাপাশি আমরা ল্যাবে অনেক কাজ করি, যেগুলো আমাদের এই পর্যায়ে এসে অনেক সাহায্য করেছে।’

ইন্টেলের অভিজ্ঞতা

ইন্টেল করপোরেশনে কাজ করতে হলে সেমিকন্ডাক্টর তৈরির প্রক্রিয়া ও উপাত্ত বিশ্লেষণ বিষয়ে গভীর ধারণা থাকতে হয়। বর্তমানে প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন মুহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন। বলছিলেন, ‘আমার ডক্টরাল গবেষণা ছিল সেমিকন্ডাক্টর উপকরণ নিয়ে, তাই পরবর্তী প্রজন্মের সেমিকন্ডাক্টর চিপের উন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহী ছিলাম। ইন্টেল আমাকে সেই সুযোগ দিয়েছে।’ সুযোগ পাওয়াটা অবশ্য খুব সহজ ছিল না। কেননা সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকে সবচেয়ে উন্নত ও জটিল উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই যাঁরা সেমিকন্ডাক্টর প্রক্রিয়া ও ডিভাইসের উন্নয়নের জটিল চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করতে পারেন, বিশ্লেষণ ও সমাধানের দক্ষতা যাঁদের আছে, কর্মী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁদেরই গুরুত্ব দেয় ইন্টেল। সব পরীক্ষা উতরেই আজকের অবস্থানে পৌঁছেছেন সাদ্দাম হোসেন।

ইন্টেলের কাজের পরিবেশও অনেক কিছু সহজ করে দেয় বলে মনে করেন মাকসুদুর রহমান। তিনিও বর্তমানে প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন। বলছিলেন, ‘ইন্টেলের কাজের সংস্কৃতি সত্যিই অসাধারণ। ম্যানেজার ও সহকর্মীরা সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। যেকোনো জটিল সমস্যা সমাধানে তাদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা থাকে। এখানে আপনি নানা ধরনের পেশাদারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাবেন, যেমন টেকনিশিয়ান, শিফট ইঞ্জিনিয়ার, প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ার। এই অভিজ্ঞতা আপনাকে চিপ তৈরির জটিল প্রক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করবে এবং সমস্যাগুলো সমাধান করার দক্ষতা অর্জন করতে সহায়তা করবে।’

চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ইন্টিগ্রেশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন হাসান উল ইকবাল। ইন্টেলে কাজের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও বললেন তিনি। তবে এসব চ্যালেঞ্জই তাঁর ক্যারিয়ারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পাঠ ছিল। বিশেষত ইন্টেলের দ্রুতগতির কর্মপরিবেশে ঘন ঘন যোগাযোগ তাঁর জন্য প্রথমে একটি বড় বাধা ছিল। কিন্তু সময় এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এ সমস্যা তিনি কাটিয়ে উঠেছেন।

ইন্টিগ্রেশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন হাসান উল ইকবাল
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

হাসান বলেন, ‘সেমিকন্ডাক্টরশিল্প আগামী কয়েক দশকে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে।’ এই শিল্পে উচ্চপর্যায়ে যেতে চান তিনি এবং বাংলাদেশের সেমিকন্ডাক্টরশিল্পকে উন্নত করতেও অবদান রাখতে চান। বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ এখনো তৈরি নয়। তবে আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশে চিপ ডিজাইনিং, অ্যাডভান্সড প্যাকেজিং এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত দিকগুলোর ভালো সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের যুবসমাজ চাইলে সেমিকন্ডাক্টরশিল্পে ভালো করতে পারে। আমি তাঁদের সাহায্য করতে চাই।’

তারিকুল ইসলাম ও আশরাফ শুভ, তাঁরাও কাজ করছেন নামী এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে। দুজনই ঢাবির একই বিভাগের স্নাতক।
ছবি: সংগৃহীত

নতুনদের জন্য পরামর্শ

যাঁরা সেমিকন্ডাক্টরশিল্পে কাজ করতে চান, তাঁদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন—জানতে চেয়েছিলাম এই তরুণদের কয়েকজনের কাছে।

সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ইন্টেলের মতো বিশ্বমানের কোম্পানিতে কাজ করতে হলে শিক্ষার্থীদের প্রাসঙ্গিক প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে হবে। ইন্টার্নশিপ ও বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জন, এই শিল্প সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য রাখা, এসবও জরুরি। বিশ্লেষণের সক্ষমতা, সমস্যা সমাধান এবং যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি উদ্ভাবনের প্রতি প্যাশন আলাদা হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।’

তাহমিনা আক্তার সব সময় শেখার আগ্রহ রাখার পরামর্শ দিলেন। তিনি বলেন, ‘সব সময় নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। গবেষণার ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়াতে হবে, সমস্যা সমাধানের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং, ডেটা অ্যানালাইসিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শিখুন, এই দক্ষতাগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং প্রযুক্তি খাতে কাজ করার জন্য খুব প্রয়োজন। এ ছাড়া নেটওয়ার্কিং এবং যোগাযোগদক্ষতাও গড়ে তুলুন।’

আরও পড়ুন