ফেসবুক ছাড়া কেমন আছি

ফেসবুক এসে প্রমাণ করে দিয়েছে, বন্ধুত্বের কোনো বয়স নেই, সম্পর্কের ব্যবধান নেই, দূরত্বের বাধা নেইআঁকা: আরাফাত করিম

‘ফেসবুক ছাড়া থাকা যায় নাকি!’ আমি ফেসবুক ব্যবহার করি না, তথ্যটা জানার পর অন্যরা চোখ কপালে তুলে ঠিক এ প্রশ্নটাই করে। নিজের কপাল চোখ দিয়ে দেখা যায় না, তাই বুঝতে পারি না, এটা আমার কপালের লিখন কি না! পরিচিতজনেরা এ নিয়ে এখন অবশ্য অবাক হয় না। তবে অতি ঘনিষ্ঠজনেরা জানে, আমার মোবাইলে ফেসবুক অ্যাপটাই নেই। কেউ কেউ অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলে, ‘আসলেই ব্যবহার করেন না?’ চুপ করে থাকলে মনে করে, আমি হয়তো নিজেকে আড়াল করছি। আর একই রকম জবাব দিলে ভাবে, আমি হয়তো তাঁকে ‘ফেসবুক বন্ধু’ বানানোর ব্যাপারে আগ্রহী নই।

ফেসবুক বন্ধু! অনেক রকম বন্ধু আছে। একসময় জানতাম, স্কুলে যারা এক ক্লাসে পড়ে, তারাই বন্ধু হয়। পরে জানলাম, মা–বাবাও ভালো বন্ধু হতে পারে। আরও পরে বুঝেছি, যে কেউই যে কারও বন্ধু হতে পারে। তবে ফেসবুক এসে প্রমাণ করে দিয়েছে, বন্ধুত্বের কোনো বয়স নেই, সম্পর্কের ব্যবধান নেই, দূরত্বের বাধা নেই। বন্ধুত্বের এই ব্যাপারটা আমার কাছে দারুণ মনে হয়। বহুদিনের চেনা মানুষ, যাদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই অনেক দিন, তাদেরও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে ফেসবুকে। আর নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে ফেসবুকে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ তো হয়ই। ব্যস্ত জীবনে এখন আর সবার সঙ্গে সরাসরি দেখা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তা ছাড়া বন্ধু যদি হাজার হাজার হয়, তবে এটি অসম্ভবপ্রায় এক ব্যাপার। যোগাযোগের এই জটিল কাজটিকে সহজ করে দিয়েছে ফেসবুক। এখানে হয়তো সরাসরি ‘ফেস’ দেখা যায় না, তবে ‘বুকে’র অনুভূতি খানিকটা টের পাওয়া যায়। সবকিছু মিলিয়ে ভালোই তো।

তা ছাড়া ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে জাতীয়-আন্তর্জাতিক সব ধরনের বিষয় মানুষ ফেসবুকে শেয়ার করে। আবার ফেসবুকের পরিচিতি ও প্রচারকে ব্যবহার করে অনেকে ব্যবসাও করে। ফেসবুককেন্দ্রিক ছোট-বড় দল, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানও আছে, যারা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এক হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ, জ্ঞানচর্চা, ব্যবসা কিংবা জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফেসবুক প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমার মতো কিছু মানুষের কাছে ফেসবুক অপরিহার্য নয়। কারণটা ফেসবুক ব্যবহারকারীরাই ভালো জানেন।

একবার ফেসবুকে ঢুকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যায়। কী ভয়ংকর কথা! সময়কে টাকা দিয়ে কেনা যায় না; তাই বলে সময়ের কোনো দাম নেই? নিজের খবর জানাতে ও অন্যের খবর জানতে যদি এত সময় ব্যয় হয়, তবে তো আতঙ্কিত হতেই হয়। তা ছাড়া ফেসবুকে এমন অনেক খবর ও তথ্য ছড়িয়ে থাকে, যার কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র নেই। কিংবা ধরুন, কেউ যখন নিজের ছবি আপলোড করে কিংবা কোনো স্ট্যাটাস দেয়, তখন সেখানে লাইক-কমেন্ট পড়তে থাকে। ব্যক্তিগত এই প্রকাশের মধ্যে নিশ্চয়ই সবাই আনন্দ খুঁজে পায়; কিন্তু এর মধ্যে আমি উপভোগের কিছু দেখি না। একজন আজ দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছে, পোষা বিড়ালটাকে লাল মোজায় কেমন মানিয়েছে, এসব বিষয় জানার চেয়ে জানার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। তা ছাড়া একজনের স্ট্যাটাস এবং কমেন্ট নিয়েও অনেকের মধ্যে মন–কষাকষির ব্যাপার ঘটে। অনেক সময় কাদা–ছোড়াছুড়ি চলতে থাকে। এমনকি স্ট্যাটাস, কমেন্ট এসব থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তির মতো ঘটনাও ঘটে। কাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো হলো, কাকে ফ্রেন্ড করার পর ব্লক করা হলো, এসব নিয়েও ‘ফেস’ দেখাদেখি বন্ধ হয়, ‘বুকে’ কষ্ট জমা হয়। ফেসবুক অনেক ক্ষেত্রে দাম্পত্যের কিংবা গভীর সম্পর্কের বিশ্বাসেও চিড় ধরায়। সবকিছু দেখেশুনে বড় করে নিশ্বাস ফেলে মনে মনে বলি, ‘যাক বাবা! ফেসবুক নেই, বেঁচে গেছি।’ পুরোটাই আমার কাছে সাধ করে কষ্ট পাওয়া আর বিপদ ডেকে আনার মতো ব্যাপার মনে হয়।

এমনকি দেশ-বিদেশের সংবাদ জানার জন্যও ফেসবুক ভালো উপায় হতে পারে না। দৈনিক পত্রিকারই অনেক সংবাদ পড়ার মতো সময় হয় না, সেখানে ফেসবুক থেকে সংবাদ নির্বাচন করে পড়া সময়ের আরও অপচয়। এটা এক ধরনের নেশা, যেটা এক ঘরের দুজন মানুষের সহজ সম্পর্ককেও নষ্ট করছে, আবার ঘুমের সময়কে নষ্ট করে কাজ আর স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করছে। তবে শুরু থেকেই ফেসবুক ব্যবহার না করার কারণে এই জগৎ এখনো রহস্যময় মনে হয়। রহস্যময় এই জগতের অনেক কিছু তাই এখনো ঠিকমতো জানা হয়নি। প্রোফাইল, স্ট্যাটাস, স্টোরির মতো টার্মগুলো এখনো ঠিকমতো বুঝি না। বুঝি আর না–ই বুঝি, এ নিয়ে আফসোস নেই। বরং অনেকের অবস্থা দেখে মনে হয়, ফেসবুক ছাড়া ভালোই আছি।

তারিক মনজুর, শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়