চার বছর পর ফেসবুক অ্যাকটিভেট করে লিখলাম, ‘প্রশাসন ২৩তম’

প্রথম বিসিএসেই নিজের প্রথম পছন্দ প্রশাসন ক্যাডারে ২৩তম হয়েছেন যশোরের মেয়ে রিফা তামান্না। খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) পড়াশোনা করেছেন তিনি। তাঁর মুখ থেকে সেই যাত্রার গল্প শুনেছেন জিনাত শারমিন

অনেকে আগে থেকেই ঠিক করে রাখে যে সে বিসিএস দেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একাডেমিক ক্যারিয়ারটা নামমাত্র চালিয়ে যায় আর লাইব্রেরিতে বসে বিসিএসের প্রস্তুতি নেয়। আমার বিষয়টা মোটেও সে রকম ছিল না। আমি যখন ইসিই (ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং) তৃতীয় বর্ষে পড়ি, তখন বুঝতে পারলাম, আমার বিষয়ে বাংলাদেশে চাকরির অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। হয় দেশের বাইরে থিতু হতে হবে, নতুবা দেশে বিসিএস দিয়ে চাকরি করতে হবে। চতুর্থ বর্ষে পড়তে পড়তে আমার অনেক বন্ধুবান্ধবীই বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি কিছু বুঝে উঠতে না পেরে অনার্স শেষ করে সোজা মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে যাই।

রিফা তামান্না
ছবি: সংগৃহীত

মাস্টার্সে অন্য সব বিষয় ঠিকঠাকই ছিল, তবে থিসিসটা ভোগাচ্ছিল। এর ভেতর শুরু হলো মহামারিকাল, লকডাউন। তখন একাডেমিক পড়াশোনার চাপ একটু কম থাকায় আউটসোর্সিং শুরু করলাম। ভালোই আয় করছিলাম। কাজটা পারছি বলেই মনে হলো, আমি যেকোনো সময় জীবনে ব্যর্থ হলে আউটসোর্সিংয়ের কাছে ফিরতে পারব। সময় থাকতে থাকতে অন্তত একটা বিসিএস ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে দিয়েই দেখি কী হয়। আমি তখন যশোরের শার্শায়, আমাদের বাড়িতে। বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য মোটেও সেটা উপযুক্ত জায়গা নয়। কেননা, সেখানে কোনো কোচিং তো নেইই, বইপত্রও পাওয়া যায় না। শার্শার লাইব্রেরিতে ঠিকমতো কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সও পাওয়া যায় না। অনেকেই গ্রুপ স্টাডি করে বিসিএসের প্রস্তুতি নেয়। আমার সেই সুযোগও নেই। একে তো আমি অন্তর্মুখী, তার ওপর ওখানে আমার পরিচিত আর কেউ বিসিএসের জন্য পড়াশোনা করছে কি না, সেটাও আমি জানি না।

২০১৯ সালে ৪১তম বিসিএসের ফরম পূরণ করি। আর ফেসবুক বন্ধ করে দিই। আমি কখনোই ফেসবুকে বেশি একটা সময় কাটাই না। তবে যেটুকুই সময় কাটাই, তাতেই সময় আর মনোযোগ দুটোই নষ্ট হচ্ছিল। আমার ছোটমামা থাকতেন যশোরে। যখন যে বই লাগত, তাঁকে জানাতাম। তিনি দুই দিনের ভেতর কোনো একটা পরিবহনে পাঠিয়ে দিতেন। ডিসেম্বরে প্রিলিমিনারি। আমি কখনো কোনো ডেমো পরীক্ষা দিইনি। তাই বুঝতে পারছিলাম না আমার প্রস্তুতি কেমন। তবে আমার মনে হচ্ছিল, ভালোই। প্রিলির সপ্তাহ দুয়েক আগে জানতে পারলাম, মডেল টেস্টের জন্য বই পাওয়া যায়। আমি কিনেও এনেছিলাম। তবে পরীক্ষা দিয়ে কেমন পাচ্ছি, সেটা আর চেক করে দেখিনি। যদি কম পাই, তাহলে মনোবল ভেঙে যেতে পারে। সেটা আসল পরীক্ষার ক্ষেত্রে খারাপভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রিলি পরীক্ষা দিয়ে মনে হলো ভালোই হয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না হবে কি না। কয়েকজন বলাবলি করছিল, ২০০–এর ভেতর ১২০ পেলে নাকি মোটামুটি সেফ। আমার মনে হলো এর চেয়ে অনেক বেশি পাব। তাই লিখিত পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। লিখিত পরীক্ষা দিই। গণিত, বিজ্ঞান এগুলো ভালো হয়েছে। সব মিলিয়ে ভালোও হয়নি, খারাপও হয়নি, এ রকম মনে হচ্ছিল। লিখিত পরীক্ষার কিছুদিন পর আমার বিয়ে হয়ে যায়। আমার জন্য এটা একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছিল। কেননা, আমি তখন কেবল পড়াশোনা করে যাচ্ছিলাম। আব্বু-আম্মু ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথা বলতেও ভালো লাগত না। খুব কম কথা বলতাম। ভাইভার জন্য কথাবার্তায় যে রকম সহজ-সাবলীল হওয়া দরকার, সেটা ছিল না। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি খুলনায় চলে আসি। সবার সঙ্গে গল্প, কথাবার্তা হওয়ায় দুই বছর কেবল একা একা পড়াশোনা করার ফলে যে জড়তা তৈরি হয়েছিল, সেটা কেটে যায়। তবে মক ভাইভা দিয়ে মন ভেঙে গিয়েছিল। কেননা, তখন আমার ওই আত্মবিশ্বাস ছিল না। ব্যবস্থাপত্রের মতো করে আমাকে লিখে দেওয়া হয়েছিল, দিনে ১০ ঘণ্টা পড়বেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে মাসখানেক লেগে গেল আত্মবিশ্বাস জড়ো করতে। ভাইভা ভালোই হয়েছিল। ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের উত্তর দিতে পেরেছিলাম। রেজাল্টের জন্য টেনশন হচ্ছিল। আসলে বিসিএস এমন একটা পরীক্ষা যে প্রথম যিনি হয়েছেন, তারও একই রকম টেনশন থাকে।

রেজাল্টের দিন যখন বিকেল পর্যন্তও রেজাল্ট হলো না, ভাবলাম সেদিন আর হবে না। আগামীকাল হয়তো দেবে। এদিকে আমার হাজবেন্ড ওই দিন আগে আগে অফিস থেকে চলে আসে। বারবার পিএসএসির যে পেজে রেজাল্টের ফাইল আপলোড হবে, সেটা রিফ্রেশ করছিল। সন্ধ্যার দিকে ও বলল, ‘আমি একটু নিচে থেকে ঘুরে আসি।’ নিচ থেকে যখন ফিরল, ওর চোখমুখে খুশি। মিলিয়ে নেওয়ার জন্য বলল, ‘তোমার রোলটা কত, বলো তো?’ আমি তো আর ভয়ে বলি না। পরে ও নিজেই বলল, ‘এইটা না?’ আমি বললাম হ্যাঁ। তখন ও জানাল যে আমি প্রশাসনে ২৩তম হয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে আমার আব্বা-আম্মাকে ফোন করে জানাল। আমিও শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরে ছুটে গেলাম। আমার শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে রেজাল্ট জানালাম। ততক্ষণে আমার আম্মু আমাকে দেখার জন্য ভিডিও কল দিয়েছে। তখন আমি, ভিডিও কলের ওপাশে আমার আম্মু-আব্বু, আমার হাজবেন্ড, সবার চোখে পানি, আনন্দাশ্রু। প্রায় চার বছর পর ফেসবুক অ্যাকটিভেট করে পোস্ট দিলাম, ‘প্রশাসন, ২৩তম।’ প্রশাসন ক্যাডারদের একটা গ্রুপে যোগ দিলাম। অবশ্য আইডি আবার ডিঅ্যাকটিভেট করে দিয়েছি। আমি আসলে ফেসবুক ছাড়া বাঁচতে শিখে গেছি। আমার আর দরকার নেই। অযথা। একেবারে শুরুতে একটা অনলাইন বিসিএস কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। আমি সেখানে এতটাই অনিয়মিত ছিলাম যে রেজাল্ট হওয়ার পর কোচিং থেকে সবাইকে কমবেশি ফোন করে খোঁজ নিয়েছে, নিজেদের বিজ্ঞাপন আর প্রচারের জন্য। আমাকে কেউ ফোন করেনি।

প্রথমত বলব, আমি লাকি। আমার চেয়ে মেধাবী ও পরিশ্রমী আরও অনেকে আছেন, যাঁদের হয়তো হয়নি। তাই সবকিছুর সঙ্গে ভাগ্যটা লাগবেই। দ্বিতীয়ত, বিসিএস এককথায় ধৈর্যের পরীক্ষা। লম্বা সময় ধরে ধৈর্য ধরে থাকতে হয়। সে সময় কাছের মানুষের সমর্থন ছাড়া পার করা খুবই কঠিন। আমি দুই বাড়িতেই সেটা সমানভাবে পেয়েছি। ৪১তম প্রিলি আর লিখিত যখন দিয়েছি, তখন আমি পরীক্ষার হলে আর আমার আম্মু বাইরে। এদিকে ৪৩ আর ৪৪তমর লিখিত পরীক্ষার সময় একইভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমার শাশুড়ি। বিয়ের পর আমার ননদের বাচ্চা হলো। তিনি ওই সময়টা তাঁর মায়ের কাছে, মানে আমার শাশুড়ির কাছে চলে আসেন। আমরা একই বাসায় ছিলাম। আমার শাশুড়ি সে সময়ও নিশ্চিত করেছেন আমার পড়াশোনার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। আমি আর আমার হাজবেন্ড, আমরা কুয়েটের পুরোনো বন্ধু। আমরা যখন বিয়ে করতে চাই, আমাদের দুজনার কারোরই জব ছিল না। মজার ব্যাপার হলো, বিয়েতে দুই পরিবারের কেউ আপত্তি করেননি। বিয়ের পরই আমার হাজবেন্ডের কুয়েটেই নবম গ্রেডের সরকারি চাকরি হয়। আর আমারও হলো। আমি এর জন্য আমার ছোট মামা থেকে শুরু করে দুই পরিবারের সবার কাছে কৃতজ্ঞ।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন