পুরোনো বুলিং কেন ভুলতে পারে না মানুষ

বুলিং কখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যেটা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন হয় কাউন্সেলিং, কখনো কখনো চিকিৎসাও।

চার ভাইবোনের মধ্যে শান্তার গায়ের রং তুলনামূলক চাপা। ছোটবেলায় বড় ভাই শাওনকে দেখিয়ে আত্মীয়রা বলাবলি করত, ছেলেটা এমন রং না পেয়ে শান্তা পেলে উপকার হতো। অন্তত বিয়ের সময় সমস্যা হতো না। কেবল গায়ের রঙের কারণে মনভরে রঙিন পোশাক পরতে পারেনি শান্তা। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত শান্তা এখন দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। কিন্তু এখনো মন খুলে পোশাক পরতে পারেন না। উজ্জ্বল কোনো রঙের পোশাক পরতে ইচ্ছা করলেই ছোটবেলায় শোনা আত্মীয়দের কথাগুলো কানে বাজতে থাকে। শান্তা নিজেও জানেন না এসব থেকে মুক্তির উপায় কী?

বুলিং শিশুর আত্মসম্মানে আঘাত করে
ছবি: সংগৃহীত

গণমাধ্যমে কাজ করেন মুনিরা। ১৩ বছরে তাঁর জীবনে নতুন নতুন বন্ধু এসেছে, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এখনো কোনো বন্ধুর সঙ্গে ভুল–বোঝাবুঝি হলে, বন্ধুর কথায় কষ্ট পেলে তিনি ফিরে যান ১৩ বছর আগে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টির করিডরে। যেখানে এমনই কিছু ভুল–বোঝাবুঝির জেরে, মতানৈক্যের জেরে ভেঙে গিয়েছিল তাঁর বন্ধুত্বের চেনাজানা পরিমণ্ডল। তাঁর শারীরিক গঠন নিয়ে বন্ধুরা সেদিন চিৎকার করে তাঁকে অপমানিত করেছিল। বন্ধুদের প্রতি সেই অবিশ্বাস, সেই ঘৃণা মনে করতে চান না মুনিরা। কিন্তু কখনো কোনো দুর্বল মুহূর্তে সেই অপমানগুলো মনে পড়ে যায়।

শারীরিক গড়ন, গায়ের রং, আর্থিক অবস্থা, ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়, বৈবাহিক অবস্থা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, চশমার পাওয়ার থেকে শুরু করে এমন কোনো বিষয় সম্ভবত নেই; যেটা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে বুলিংয়ের শিকার হতে হয় না। সেই বুলিং কখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যেটা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন হয় কাউন্সেলিং, কখনো কখনো চিকিৎসাও।

বুলিঙের প্রতিবাদ করা উচিত
ছবি: সংগৃহীত

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য শ্যামল বলছিলেন বুলিংয়ের ধরনের কথা। যে বন্ধুদের সঙ্গে জীবনের সব সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতেন, তাঁরাও আদতে আলগোছে তাঁকে আলাদা করে রাখতেন। শ্যামল আর তাঁর বাঙালি বন্ধুদের মধ্যে খুব সূক্ষ্ম একটা রেখা টানা থাকত। অনেক সময় মজার ছলেই শ্যামল সাপ-ব্যাঙ খান বলে টিটকারি করতেন বন্ধুরা। মুখে কিছু না বললেও ভেতরে–ভেতরে মরমে মরে যেতেন তিনি। বন্ধুদের এই অস্পৃশ্য করে রাখার অনুভূতি দীর্ঘদিন তাঁকে রাতে ঘুমাতে দেয়নি। বর্তমানে দেশের বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন শ্যামল। জানালেন, সেখানে ভর্তি হওয়ার পর তাঁকে কাউন্সেলিং নিতে হয়েছিল। কারণ, নতুন মানুষের সঙ্গে তিনি মিশতে পারছিলেন না, বন্ধুত্ব করতে পারছিলেন না।

অনেক শিশু আছে যারা ধীরে শেখে, অন্য বন্ধুদের মতো দ্রুত লেখাপড়া ধরতে পারে না। দেখা যায় শিক্ষকেরাও তাদের অবহেলার চোখে দেখেন বা সবার সামনে এমন কোনো কথা বলে নিগ্রহ করেন, যা শিশুটির আত্মসম্মানে আঘাত করে। ছোটবেলায় হয়তো এটা বুঝতে পারেন না, কিন্তু বড় হতে হতে এ ঘটনা তার আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি করে।

বহু মানুষের কাছে আমরা এমন অনেক বুলিংয়ের গল্প শুনতে পাই, যেগুলো হয়তো খুব ছোটবেলার ঘটনা, তবু ভুলতে পারেন না তাঁরা। অবচেতন মনে রয়ে যাওয়া সেসব কষ্ট তাড়া করে বেড়ায় জীবনভর।

বুলিংয়ের শিকার হতে হতে একসময় গিয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন, এমন দুজনের সঙ্গেও কথা হয়।

শিশুর মানসিক বিকাশের সময় পরিবারকে পাশে থাকতে হয়। কেউ বুলিং করলে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে হয়।
ছবি: প্রথম আলো

তাঁদেরই একজন ফ্রিল্যান্সার তাহিয়া রুবাইয়া। তিনি বললেন, ‘গায়ের রং নিয়ে জীবনে কম কথা শুনিনি। আত্মীয়-অনাত্মীয়, কাছের-দূরের কেউ সুযোগ পেলে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়েননি। এই লজ্জা থেকে বাঁচতে মুখে কত ক্রিম যে ঘষেছি, কত বেসন যে দুধে গুলে মেখেছি, হিসাব নেই। তবে যা–ই হোক, লেখাপড়াটা ছাড়িনি। এখন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মিশতে গিয়ে বুঝি, গায়ের রং আসলে কোনো বিষয়ই নয়। আমি মানুষ হিসেবে সৎ, কর্মঠ, কিছুটা মেধাবীও। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আর এর সঙ্গে প্রতিবাদ করতেও শিখেছি। এখন কেউ গায়ের রং নিয়ে কথা বলতে এলে তাকে দুই লাইন শুনিয়ে দিতে পারি। যে জিনিসটার ওপর আমার কোনো হাতই নেই, সেটার দায় কেন আমি নেব?’ তবে এ ক্ষেত্রে পরিবার পাশে ছিল বলে কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভুললেন না।

তাহিয়ার মতে, শিশুর মানসিক বিকাশের সময় পরিবারকে পাশে থাকতে হয়। কেউ বুলিং করলে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে হয়। পরিবার, মা–বাবা, ভাই-বোন যদি বুলিংয়ের সময় সন্তানের পাশে থাকেন, তাহলে সেই সন্তান যেমন সাহস পায়, তেমনি যিনি বুলি করেন, তিনিও নিজের ভুল বুঝতে পারেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লাইলুন নাহার বললেন, ‘বুলিং হলো কোনো ব্যক্তিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আক্রমণ করা। আমরা বলি, দুই ধরনের বুলিং হতে পারে। একটি হলো সরাসরি। অর্থাৎ কাউকে আঘাত দিয়ে। আরেকটি হলো পরোক্ষ। যেমন কারও বিষয়ে ব্যঙ্গাত্মক আচরণ দেখিয়ে বা নেতিবাচক কথা বলে।

‘সাধারণত ছোটবেলায় নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা আমরা ভুলতে পারি না, কারণ সে সময় আমাদের আত্মমর্যাদার জায়গাটা শক্ত থাকে না। ফলে কেউ কিছু বললে আমরা কষ্ট পাই। সেই কষ্টটা আমাদের অবচেতন মনের গভীরে স্থান করে নেয়। বড় হওয়ার পর একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে তখন অবচেতন মন থেকে সেই ঘটনাটা বেরিয়ে আসে, আমরা আবার আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।’

আত্মমর্যাদাবোধ বাড়ানোর জন্য বই পড়া একটা ভালো অভ্যাস
ছবি: প্রথম আলো

কীভাবে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে, জানতে চাইলে এই শিক্ষক বলেন, ‘দেখুন আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থাতেই পরিবর্তন আনতে হবে। কাউকে বুলি করা বা কাউকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কথা বলা, কষ্ট দিয়ে কথা বলা ভালো কিছু নয়। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে সমাজ পরিবর্তন করা, সমাজের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন করে ফেলা সহজ কিছু নয়। সে জন্য পরিবারগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেক পরিবারের উচিত তার শিশুর আত্মমর্যাদা বাড়ানোর কাজে সহায়তা করা। শিশু যেন বুলিংয়ের শিকার না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা। আবার কেউ যদি শিশুকে বুলিং করে, তাহলে তাকে এটা বোঝানো যে ওই মানুষটা ভুল বলছে। সে যেটা বলছে, সেটা সঠিক নয়। প্রত্যেক মানুষেরই উচিত নিজের সম্পর্কে ধারণা উন্নত করা। যারা বুলিং করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নজর না দিয়ে যারা তাকে ভালোবাসে, যারা তার পাশে থাকে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভাবতে হবে। নিজের সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট রাখতে হবে, উন্নত করতে হবে।’

আত্মমর্যাদাবোধ বাড়ানোর জন্য কী করা যেতে পারে?

জবাবে লাইলুন নাহার বললেন, বই পড়া যেতে পারে। যেকোনো ধরনের শেখার উপকরণই মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়তা করে। যখন বুলিংয়ের পুরোনো ক্ষত ফিরে আসতে শুরু করে, তখন ব্রিদিং বা নিশ্বাসের ব্যায়াম করা যেতে পারে। যোগব্যায়াম করলেও উপকার পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে ভার্চ্যুয়াল জগৎ থেকে কিছু সময় দূরে থাকাও ভালো। পাশাপাশি পরিবারের সাপোর্ট সিস্টেম ভালো হওয়াও জরুরি বলে মনে করেন তিনি।