আব্বাস উদ্দীনের ছেলে এই পরিচয়ের গণ্ডিতে নিজেকে আটকে রাখেননি তিনি

আজ শনিবার সকালে মারা গেছেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী, গবেষক ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তাঁকে নিয়ে ২০০৬ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রচ্ছদ রচনা প্রকাশ করেছিল প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

বরেণ্য সংগীতশিল্পী, গবেষক ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ২০০৬ছবি: কবির হোসেন

সেদিন। ভরা পূর্ণিমা। চারপাশে মন উথাল-পাথাল করা জ্যোৎস্না। চাঁদের আলোয় যেন ভেসে যাচ্ছে গোটা গ্রাম। বইছে মৃদুমন্দ বাতাস। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন গোটা গ্রাম। ঘুম নেই শুধু একটি বাড়ির মানুষজনের চোখে। বারান্দায় হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছেন সেই বাড়ির কর্তা মানুষটি। সুর মিলিয়ে তিনি গান গেয়ে চলেছেন একের পর এক। সুরের আবেশে জলে ভেসে যাচ্ছে তার দুই চোখ। তাকে ঘিরে বসেছে পরিবারের সবাই। মন্ত্রমুগ্ধ মানুষের দৃষ্টি সবার চোখে। বাইরে রহস্যময় চাঁদের আলো। আর ঘরে দরাজ কণ্ঠ। সব মিলিয়ে মন কেমন করা এক অনুভূতি। ঘুম কী আর আসে কারো চোখে? সুরের মায়ায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ঘুমানোর কথা আর মনে থাকে না ছেলে-বুড়ো কারোরই।

বহুদিন আগের স্মৃতি সেসব। তখন সবে আট কী সাত বছর বয়স মুস্তাফা জামান আব্বাসীর। কিন্তু কুচবিহারের গ্রামে বসে বাংলার সঙ্গীত জগতের কিংবদন্তি বাবা আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে সে গান শোনার স্মৃতি এখনো দিব্যি মনে আছে তার। এখনো চোখ বন্ধ করলে পরিষ্কার কানে বাজে বাবার দরাজ কণ্ঠ। বাবা বিগত হয়েছেন অনেক দিন। কিন্তু তার বিখ্যাত বাবার দরাজ কন্ঠের মতো এখনো সঙ্গীতের মোহ ছেড়ে যায়নি ছেলে আব্বাসীকে। ৭০ ছুঁই ছুঁই বয়সে এসেও আজ দেশের সঙ্গীত জগতের একটা দিক অনেকখানি আলোকিত করে রেখেছেন তিনি। কেবল আব্বাস উদ্দীনের ছেলে এই পরিচয়ের গণ্ডিতে নিজেকে আটকে রাখেননি তিনি। নিজে বড় মাপের একজন শিল্পী আব্বাসী। সেই মাপের কাজও করেছেন অনেক। বাবা ছেলের মধ্যে বপন করে গিয়েছিলেন সঙ্গীত প্রেমের যে বীজ, সেটা দিনে দিনে ডালপালা ছড়িয়ে হয়ে উঠেছে রীতিমতো মহীরুহ। কেবল দেশে নয়, বাংলাদেশের গানকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন বিশ্ব সঙ্গীত পরিমণ্ডলে। ভিনদেশে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির। বাংলার গানের কত রত্ন ছড়িয়ে আছে গ্রামবাংলার পথেঘাটে। গভীর মমতায় তিনি কুড়িয়ে এনেছেন সেসব মণি-মানিক্য। ছুটে গেছেন বাউল-ফকিরদের দরজায় দরজায়। সংগ্রহ করেছেন তাদের গান।

সুর সাধনায় মগ্ন মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ২০০৬
ছবি: কবির হোসেন

ছেলেবেলার দিনগুলো

সত্যি বলতে গান মিশে আছে তার রক্তের মধ্যে। এখনো সকাল হলে বৈদ্যুতিক তানপুরাটি যথাযথ সুরে মিলিয়ে বসে পড়েন। রেওয়াজে বসেন। এবং গাইতে থাকেন একের পর এক পছন্দের গান। আর রেওয়াজ শেষ হলে শুরু হয় গান শোনা। এই গান শোনা ড্রার গান গাওয়া চলে আসছে সেই ছোট্টবেলা থেকে। আব্বাসী বলেন, কুচবিহারে তার বাবা আব্বাস উদ্দীন এমন এক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন, যেখানে ধানক্ষেতের আলের মধ্যে সুর ঘুরে বেড়াত। সেই সঙ্গীতকে তিনি মাঠ থেকে তুলে এনে শহরের মানুষের দোরগোড়া অবধি পৌঁছে দিয়েছেন। ভারতবর্ষে তো বটেই, এমনকি বিশ্বের দরবারেও বাংলার গানকে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। কুচবিহার থেকে পরে আব্বাস উদ্দীন কলকাতায় ৬ নম্বর বেনেপুকুর লেনে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানে তাকে ঘিরেই সঙ্গীতের বিশাল এক পরিসর সৃষ্টি হতে থাকে। শুধু লোকসঙ্গীত নয়, নজরুল ইসলামের ইসলামী গানকে তিনি সরার কাছে নিয়ে যান। নজরলের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞও ছিলেন তিনি। তিনি বলতেন, আমার শরীরের প্রতি লোমকূপ নজরুলের কাছে ঋণী। ’৪৭-এ দেশভাগের পর ঢাকায় এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে থাকেন আব্বাস উদ্দীন এবং পরিবার। আব্বাসী বলেন, দাদীর নামে বাবা পল্টনে ‘হীরামন মঞ্জিল’ নামে একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বাবা ঢাকায় এসে খুব একটা ভালো ছিলেন না। কারণ এখানে তার সেই কদর ছিল না। তা ছাড়া কলকাতা তখন ছিল সারা ভারতের সঙ্গীত রাজধানী।

কলকাতায় তাদের বাড়িতে সব সময় কবি গোলাম মোস্তফা, কবি জসীমউদ্‌দীন, আসাদউদ্দৌলা শিরাজী, কবি তালিম হোসেন, বেদার উদ্দীন আহমদ, সোহরাব হোসেন ও আরো অনেক কবি-শিল্পী যেতেন। পুরো পরিবারটি ঢাকায় চলে আসার পর এখানেও বসত শিল্প-সংস্কৃতির আড্ডা। আব্বাসী বলেন, নববর্ষের প্রথম দিনে আমাদের বাসায় গানের জলসা বসত। আমার আব্বা চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করতেন। আমরা ভাইবোনরা গান গাইতাম। এখনো পহেলা বৈশাখে সে গানগুলো তার স্মৃতিতে চলে আসে। কবি সুফিয়া কামাল, ইব্রাহীম খাঁ, আবদুল লতিফ, আবদুল হালিম চৌধুরী, নাজির আহমদ, আবদুল আহাদ, ফতেহ লোহানী, জাহানারা আরজু, শামসুর রাহমান প্রমুখ পল্টনের বাসায় আসতেন। অনেক বড় ওস্তাদের সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন বাসাতেই।

শান্তিনিকেতনে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সান্নিধ্যে (১৯৭৪)
ছবি: সংগৃহীত

সঙ্গীতের সঙ্গে সারা জীবন

কুচবিহার থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকা। কত স্মৃতি, কত কথা। কিন্তু ঢাকাকে ঘিরেই মুস্তাফা জামানের সবচেয়ে বেশি স্মৃতি। তখনকার নামকরা স্কুল সেন্ট গ্রেগরিজে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। বন্ধুরা মিলে তখন কত মজার ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। সেসব আজও তাকে নস্টালজিয়ায় ভোগায়। স্কুলে খুব ভালো ছাত্র ছিলেন আব্বাসী। লেখাপড়ায় বরাবরই ছিলেন ফার্স্ট।

আব্বাস উদ্দীন লোকসঙ্গীত গাইলেও তিনি চেয়েছিলেন সন্তানরা হিন্দুস্থানি সঙ্গীতে দক্ষতা অর্জন করুক। তাই তিনি কলকাতার বাসায় নিয়ে এসেছিলেন ভারতবর্ষের বিখ্যাত ওস্তাদ জমির উদ্দীন খাঁ সাহেবের ভাইয়ের ছেলে কাদের জামিরিকে। সেটা ১৯৪৫ সালের কথা। তার কাছেই দুই ভাইবোন মুস্তাফা জামান ও ফেরদৌসী রহমানের হাতেখড়ি। তখন তার বয়স সাত আর ফেরদৌসীর সাড়ে চার। প্রথম রাগটি ছিল ভূপালি। ওস্তাদ কাদের জামিরি ১৯৫০ সালে ঢাকায় চলে আসেন। বেনেপুকুর লেনের ১১ নম্বর বাড়িতে থাকতেন ওস্তাদ মুহম্মদ হোসেন খসরু। কিছু দিন পর তার কাছেও দুই ভাইবোন সঙ্গীতে তালিম নেওয়া শুরু করেন। আর বাবার কাছে তো-শিখতে হতোই।

কলকাতায় সেই কবে তার রেকর্ড বেরিয়েছিল। সেগুলো চলেছিলও বেশ। বাংলাদেশে দেবু ভট্টাচার্যের সুরে আধুনিক গান গেয়েছেন। ১৯৬০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষে অন্তত এক ডজন ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন। তিনি হিন্দি ও উর্দু গানও গেয়েছেন। গজলও গেয়েছেন। ভারতবর্ষের গজলের কিংবদন্তি মেহেদী হাসানের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। এয়ার ফোর্সের অত্যন্ত নিম্নমানের চাকুরে ছিলেন মেহেদী হাসান। কিন্তু গানের গলাটা ছিল অপূর্ব। পাকিস্তানে কর্মরত অবস্থায় উভয়ের দেখা হয়। মেহেদী হাসানকে তখন কেউ চিনত না। সেখানে মেহেদী হাসানকে ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত শেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন আব্বাসী। আব্বাসী বলেন, 'আজও যখন সেই শিল্পীর গান শোনেন তখন আব্বাসীর মনে হয়, এই তো আমার বন্ধুর গান শুনছি।' গানকে কখনো পেশা হিসেবে নেননি তিনি। দেশের অনেকেই হয়তো জানেন না আব্বাসী আসলে একজন সফল ব্যবসায়ী। মতিঝিলে তার অফিস। অবশ্য প্রথম জীবনে তিনি পাকিস্তানের একটি বড় কোম্পানির বড় কর্তার চাকরি পেয়েছিলেন। ২০০১ সালে তাঁকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদটি দেওয়া হয়। তিনি তা গ্রহণও করেন। কিন্তু মাত্র নয় মাস পর আবার তাঁকে সরে আসতে হয় পদটি থেকে। বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের দায়িত্বও তিনি পালন করেছিলেন একটা সময়। বাংলাদেশ টেলিভিশনের লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান বাঁশরী ও হিজলতমালে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে গান করেছেন। তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষের চিঠি পান। কিন্তু এর একটিও নষ্ট করেন না। প্রতিটি চিঠিই তার কাছে ভীষণ মূল্যবান। কত রকমের হাতের লেখা। ছোট ছোট অনুভূতির প্রকাশ থাকে এসব চিঠিতে। তার জীবনের অনেক বড় সঞ্চয় এ চিঠি। দেশে একাধিক স্যাটেলাইট চ্যানেল হওয়ার পর তার ব্যস্ততা বেড়েছে অনেক। সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি নিজের জীবনীগ্রন্থ লিখছেন তিনি।

অসুস্থ কবি কাজী নজরুলের পাশে দুই ভাই। মোস্তফা কামাল এবং মুস্তাফা জামান আব্বাসী (কলকাতা, ১৯৬৬)
ছবি: সংগৃহীত

আব্বাসীর সঙ্গীত সংগ্রহ

২ হাজার লোকসঙ্গীতের এক বিশাল ভাণ্ডার আছে তার সংগ্রহে। গানের সংগ্রহ অনেকেরই কাছে থাকে; বিভিন্ন বইপত্র কিংবা রেকর্ড থেকে সংগৃহীত। কিন্তু এ সংগ্রহ তেমন মামুলি নয়। লোকসঙ্গীত বলতে আমরা যা বুঝি ঠিক তেমন গান তিনি তুলে এনেছেন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। গানগুলোর গীতিকার-সুরকার কে তা আজ আর সঠিকভাবে জানা যায় না। কিন্তু লোকমুখে যুগের পর যুগ ধরে টিকে আছে এসব গান। এ দেশে লালনের গানের মূল সুরও সংগ্রহ করেছিলেন তিনিই এবং টেলিভিশনে সে গান সম্প্রচারেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। এর আগে মারফতি, মুর্শিদির সুরে গাওয়া হতো লালনের গান। বাউল বিয়াল শাহ, বাউল খোদা বক্স বিশ্বাস, বাউল জোনাব আলী মল্লিকসহ আরো ১০ জন বাউলকে তিনি কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় নিজের বাসায় এনে রেখেছিলেন। বাউলদের কয়েকশ গানের সংগ্রহ আছে তার কাছে। এখন তার শুধু একটাই চিন্তা এ ঐশ্বর্য তিনি কার হাতে তুলে দেবেন?

কোনো আধার পাচ্ছেন না মুস্তাফা জামান আব্বাসী। তার এ বিশাল সংগ্রহ রক্ষিত আছে ঘরের একটি ছোট্ট আলমারিতে। সব গান স্পুলে রেকর্ড করা। সারা দেশের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এ গানগুলো শত শত শিল্পীর গলা থেকে তিনি তুলে এনেছেন। তাদের বেশির ভাগ শিল্পীই হয়তো এখন আর জীবিত নেই। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ-ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতধারা কত উপকৃত হতে পারত এ ২ হাজার 'অরিজিনাল' গান পেলে। শত বছরের পুরনো গান আবার ফিরত দেশের মানুষের মুখে মুখে। আমাদের জাতীয় গর্বে যুক্ত হতো আরো কত সঙ্গীতের উপাদান।

যখন তাঁরা নবদম্পতি। মুস্তফা জামান আব্বাসী এবং আসমা আব্বাসী (১৯৬৩)
ছবি: সংগৃহীত

সঙ্গীত পরিবার

মুস্তাফা জামান আব্বাসীরা দুই ভাই এক বোন। সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দারুণভাবে সফল। বড় ভাই বিচারপতি মোস্তফা কামাল সুবক্তা, সুলেখক। বোন ফেরদৌসী রহমান, নতুন করে বলার কিছু নেই তার সম্পর্কে। মুস্তাফা জামান বিয়ে করেন ১৯৬৩ সালের ২০ জানুয়ারি সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাগ্নি আসমা চৌধুরীকে (পরে আসমা আব্বাসী)। তাদের দুই মেয়ে সামীরা আব্বাসী ও শারমিনী আব্বাসী। বড় মেয়ে থাকে আমেরিকায়, ছোট মেয়ে দেশের একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। বাবার মতো তারাও গান ভালোবাসে।

দেশের গান নিয়ে বিদেশে

বাংলাদেশের গান, বিশেষ করে লোকসঙ্গীত বিদেশের মাটিতে যে কয়জন শিল্পী পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তাদের একজন মুস্তাফা জামান আব্বাসী। যেখানেই গেছেন সেখানেই তিনি বাংলাদেশের মাটির গান শুনিয়েছেন মানুষকে। অন্তত ৪০টি দেশ ঘুরেছেন তিনি। গান গেয়ে মুগ্ধ করেছেন সেখানকার মানুষকে। ইউনেস্কোর অঙ্গসংগঠন ইন্টারন্যাশনাল মিউজিক কাউন্সিলে অংশ নেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন মোৎসার্টের শহর ভিয়েনায়। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। রেখেছিলেন বক্তৃতা। নিজের পকেট থেকে ১ হাজার ডলার চাঁদা দিয়ে সেবার বাংলাদেশকে তিনি সদস্য করে নেন সম্মেলনের। বহু বছর নিয়মিতভাবে সে চাঁদা দিয়ে তিনি সদস্যপদ বহাল রেখেছিলেন। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত কোনোরূপ সহায়তা না করায় কাউন্সিলে বাংলাদেশের সদস্যপদ এখন আর নেই। ১৯৭৪ সালে একবার তিনি গিয়েছিলেন রাশিয়ায় (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন)। সেখানে চিকিৎসার জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও গিয়েছিলেন। কিন্তু তার অবস্থা তখন ভালো ছিল না বলে শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে নির্জন স্থানে রাখা হয়েছিল। সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমান বললেন, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীকেই তার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। আমি যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাই সেটা তাকে বলেছিলাম। কয়েক দিন পর বঙ্গবন্ধু নিজেই ডেকে পাঠান তাকে। কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আর শুনেছিলেন একের পর এক গান। অনেকগুলো গান সেদিন শুনিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুকে। 'দিল্লিতে একবার দেখা করতে গিয়েছিলাম শচীন দেববর্মণের সঙ্গে। কিন্তু তার দেখা কিছুতেই পাচ্ছিলাম না। আমার পরিচয় পেয়ে আদর করে পাশে বসিয়ে তিনি আমার গান শুনেছিলেন।' বলছিলেন আব্বাসী। এ রকম পণ্ডিত রবিশঙ্কর, এহুদি মেনুহিন, অমর পাল, আলী আকবর খাঁ, আরো কত বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে পরিচয় আছে তার। প্রয়াত সেতার সম্রাট ওস্তাদ বেলায়েত খাঁর সঙ্গে তার পরিচয় বাল্যকালেই। কলকাতায় একই স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন তারা।

আব্বাস উদ্দীনের নিজেরই ইচ্ছে ছিল অভিনয় করার। তিনি চেয়েছিলেন তার এক ছেলে হবে ব্যারিস্টার, অন্য ছেলে অভিনেতা। প্রথমটিতে সফল হলেও পরেরটি হননি। ঢাকায় পড়াশোনা শেষে মুস্তাফা জামানের কথা ছিল আমেরিকায় গিয়ে সিনেমাটোগ্রাফির ওপর পড়াশোনা করবেন। কিন্তু বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ায় সেটা আর করা হয়নি। সেসব পুরনো কথা। অনেক দিন পর একবার পরিচালক এহতেশাম তাকে দেখে সিনেমায় নায়ক হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাজি হননি মুস্তাফা।

ছুটির দিনের প্রচ্ছদে মুস্তাফা জামান আব্বাসী

আমারে ভুলিয়া যেও ভালোবাস মোর গান

গুলশানের বাসায় স্ত্রী আসমা আব্বাসী এবং মেয়ে ও নাতনিদের নিয়ে তার সুখের সংসার। ৬৮ বছরের এ মানুষটির জীবনের অবসর বলতে কিছু নেই। নিজের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে দুই দিন সময় দেওয়া, নিয়মিত গানের চর্চা, দেশ-বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া, বক্তৃতা রাখা-এসব কাজ করেই কেটে যায় দিন। কে এল সায়গল তার প্রিয় শিল্পী। আরেকজন হলেন শচীন দেববর্মণ। কিন্তু কে এল সায়গলের 'যখন রবনা আমি, গান হলে অবসান' গানটিই এখন তার সবচেয়ে প্রিয়। তিনি বেঁচে থাকতে চান তার গানের মধ্য দিয়েই। জীবনে অনেক পেয়েছেন তিনি। আর কিছু পাওয়ারও নেই। দেশের জন্য অনেক করেও কিছুই করতে পারেননি বলে বড় আক্ষেপ তার। আব্বাসী বলেন, 'আমাদের দেশে যদি একটি পূর্ণাঙ্গ ফোকলোর ইনস্টিটিউট থাকত, তাহলে আমাদের হাজার বছরের পুরনো গান সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো। আর সরকার কিংবা ক্যাসেট প্রকাশনা সংস্থাগুলো যদি প্রকাশ করত দেশের বাউল, মারফতি, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, চটকা ইত্যাদি গান, তাহলে বিশ্ববাজারে এক অভূতপূর্ব সাড়া ফেলতে পারতাম আমরা। কিন্তু দুর্ভাগ্য সুযোগ-সুবিধার অভাবে আমাদের এই সুর এখানেই থেকে যাবে। বিশ্বসভায় এ সুর আর পৌছাবে না। আর বিশ্বসভা কেন, আমরাই তো এর কদর বুঝি না। আর এ জাতীয় উদ্যোগ নেই বলেই বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের শিল্পরূপ মূল গানের মতো নেই। গানের শব্দে শহুরে কথা বা শহুরে ব্যাপার এখন ঢুকে গেছে। গ্রামের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রেখে শহরে বসে লেখা হচ্ছে গ্রামকেন্দ্রিক লোকসঙ্গীত। ফলে এর কোনো আবেদনও থাকছে না। আমাদের অনুসরণ করতে হবে আমাদের পূর্বসূরি আব্বাস উদ্দীন, আবদুল আলীম কিংবা শচীন দেববর্মণদের।’