নানা দেশ, ভাষা একটাই—গণিত

এই শিক্ষার্থীদের প্রায় সবার জন্যই এটা প্রথম বিদেশ সফর
ছবি: লেখক

ঢাকা থেকে অসলো। বাংলাদেশ থেকে নরওয়ে। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ। দূরত্ব প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার। বিমানে যেতে লাগে ১০ ঘণ্টার বেশি। বাংলাদেশ গণিত দলের সদস্যরা এবার তাই দারুণ রোমাঞ্চিত ছিল। অনেকেরই বিদেশভ্রমণের সুযোগ হলো এই প্রথমবার। কৈশোরের প্রাণচাঞ্চল্য আর আগ্রহ নিয়ে ৮ জুলাই সবাই রওনা দিয়েছিল গণিতের অলিম্পিক হিসেবে খ্যাত আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের ৬৩তম আসরে।

আরও পড়ুন

এ বছর বাংলাদেশ দলে ছিল সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের এস এম এ নাহিয়ান, নটর ডেম কলেজের আশরাফুল ইসলাম, সরকারি আনন্দমোহন কলেজের তাহজিব হোসেন খান, ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নুজহাত আহমেদ, নটর ডেম কলেজের তাহমিদ হামিম চৌধুরী ও ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ফোয়াদ আল আলম। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দলের সাবেক সদস্য হিসেবে আসিফ-ই-এলাহী এবার ছিলেন উপদলনেতা। এ ছাড়া পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি ও তাহ‌নিক নূর ছিলাম সফরসঙ্গী।

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দেশব্যাপী গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজনের মাধ্যমে ৬৩তম আইএমওর জন্য ৬ সদস্যের বাংলাদেশ গণিত দল নির্বাচন করা হয়। দল নির্বাচন এবং এর আনুষঙ্গিক আয়োজন করেছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।

গণিতের জন্য, গণিতকে ভালোবেসে

এবারের আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ১০৪টি দেশের ছয় শতাধিক খুদে গণিতবিদ অংশ নিয়েছে। ১১ জুলাই নরওয়ের স্থানীয় সময় বেলা তিনটায় শুরু হয় উদ্বোধনী আয়োজন। হোটেল থেকে ১৫ মিনিট হেঁটে উদ্বোধনস্থলে জড়ো হয় সবাই। এ নিয়ে ১৮বারের মতো আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে লাল-সবুজ পতাকা উড়ল। পৌঁছেই সবাই সবার সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ ইংরেজিতে কথা বলছে, কেউ পর্তুগিজ, কেউ স্প্যানিশ, কেউ বাংলা, কেউ আরবিতে; কিন্তু সবাই এক হয়েছিল গণিতের জন্য, গণিতকে ভালোবেসে।

এবারের আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ১০৪টি দেশের ছয় শতাধিক খুদে গণিতবিদ অংশ নিয়েছে
ছবি: লেখক

করোনা মহামারির পর এবারই প্রথম সশরীর গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হলো। তাই পরিবেশটা হয়ে উঠেছিল আরও উৎসবমুখর। শিক্ষার্থীদের জন্য হোটেলের পাশেই ছিল ইনডোর গেমস খেলার ব্যবস্থা। পরীক্ষার আগে কিংবা পরে অনেককে দেখা যায়, দাবার চালে মেতে থাকতে বা টেবিল টেনিস খেলতে। এসবেও কিন্তু গণিতের সমীকরণ লাগে, জানাল আমাদের গণিত দলের সদস্যরা।

পরীক্ষা পরে, উৎসব আগে

খুদে গণিতবিদেরা দুদিনের পরীক্ষায় অংশ নেয়। পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীদের জন্য নানা ধরনের শিক্ষাসফরের ব্যবস্থা ছিল। বাংলাদেশ দলের গাইড হিসেবে যুক্ত ছিলেন ফাহ্দ নেওয়াজ। ফাহ্দ বাংলাদেশের ছেলে, ঢাকা থেকে স্কুল-কলেজ শেষ করে অসলোতে এসেছেন। এখন অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তিতে পিএইচডি করছেন। ফাহ্‌দের নেতৃত্বে আমরা পুরো অসলো শহর ঘুরে বেড়াই। হোটেল থেকে পায়ে হেঁটে ২৫ থেকে ৩৫ মিনিটের পথের মধ্যেই শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। যদি কেউ হাঁটতে পছন্দ করেন, তাহলে একচক্করেই স্মরণীয় ও ঐতিহাসিক স্থান হেঁটে দেখা যায়।

শিক্ষাসফরে আনন্দে

আমাদের দেখা হয় বাংলাদেশের তরুণ গবেষক ইমরান ইকবালের সঙ্গে। এখন পিএইচডি করছেন ডিজিটাল ডিভাইড ইন এডুকেশন নিয়ে, ফিনল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব টুর্কুতে। আমরা বাংলাদেশ গণিত দলের সবাই মিলে গিয়েছিলাম ভিজল্যান্ড পার্কে। এটিকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য পার্ক। মানবজীবনের নানা আবেগ ও ঘটনার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় একেকটি স্থাপনায়।

এরই মধ্যে আমরা একদিন গেলাম অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের গাইড ফাহ্দ নিজের বিভাগসহ পুরো ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখালেন। পরীক্ষার ফাঁকে আমরা অসলোর বিখ্যাত অপেরা হাউস দেখতে যাই। ভবনটির স্থাপত্যশৈলী চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত পাহাড়ি পথের মতো ঢালু। দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার সময় যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়ার বিভিন্ন দেশের গণিতবিদদের সঙ্গে দারুণ সময় কাটিয়েছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। কার প্রস্তুতি কেমন, ভবিষ্যতে কে কী করতে চায়, এই ছিল তাদের আলাপের বিষয়।

নরওয়েতে ৭৫০টি জাদুঘর আছে। আমাদের খুদে গণিতবিদেরা চমকে গিয়েছিল ইউরোপের অন্যতম আধুনিক স্থাপনার মুঙ্ক মিউজিয়াম দেখে। নরওয়ের শিল্পী এডভার্ড মুঙ্কের নানা চিত্রকর্ম আছে এই জাদুঘরে। ১৩ তলা বিশিষ্ট টাওয়ার আকৃতির জাদুঘরটি দূর থেকে দেখলে মনে হয়, বাতাসে একটু হেলে আছে। আদতে কতখানি হেলে আছে, বাতাস সেখানে কত গতিতে আঘাত করে, কীভাবে দ্রুত ওপরে ওঠা যাবে—এমন নানা হিসাব কষছিল ছেলেমেয়েরা।

ব্রোঞ্জপদক পেয়েছে তাহজিব হোসেন খান
ছবি: প্রথম আলো

গল্প শেষ, কিন্তু স্বপ্ন শুরু

নোবেল পুরস্কার প্রদানের ভেন্যু হিসেবে বিখ্যাত নরওয়ের সিটি হল। ১৫ জুলাই এই সিটি হলে সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ হয় শিক্ষার্থীদের গণিত অলিম্পিয়াডের অভিযান। প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দল মোট ১১৫ নম্বর পেয়ে ১০৪টি দেশের মধ্যে ৫৭তম হয়েছে। আইএমওতে এটি দলীয়ভাবে বাংলাদেশ দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর। এর আগে ২০২০ সালে দলীয়ভাবে ১১৮ নম্বর পেয়েছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ দলের হয়ে ব্রোঞ্জপদক পেয়েছে তাহজিব হোসেন খান। তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ২৩। এ বছর দলীয়ভাবে ২৫২ নম্বরের মধ্যে ২৫২ নম্বর পেয়ে ৬টি সোনার পদক নিয়ে প্রতিযোগিতায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে চীন। দক্ষিণ কোরিয়া ২০৮ নম্বর নিয়ে দ্বিতীয়। যুক্তরাষ্ট্র ২০৭ নম্বর নিয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে।

স্বপ্নের মতো এই অলিম্পিয়াডের যাত্রা আপাতত শেষ। তবে যে অভিজ্ঞতা ও অনুপ্রেরণা শিক্ষার্থীদের ঝোলায় যুক্ত হলো, তা নিশ্চয়ই ওদের পথ দেখাবে।

লেখক: বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সমন্বয়ক