‘ম্যাজিক রিয়েলিজমের মতো করেই আমি জগৎটাকে দেখি’

ইফফাত নাওয়াজ আমাদের পুরান ঢাকার মেয়ে। কৈশোরেই চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর জীবন ও কাজ তাঁকে নিয়ে গিয়েছে আফ্রিকা, আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের নানা প্রান্তে। এখন বাস করছেন ভারতের পদুচেরিতে। এক দশকের বেশি সময় ধরে ইফফাত কাজ করেছেন উন্নয়নকর্মী হিসেবে। পাশাপাশি লেখালেখি করেছেন ‘দ্য ডেইলি স্টার’, ‘দ্য হাফিংটন পোস্ট’, ‘হিমাল সাউথ এশিয়া’, ‘দ্য ইন্ডিয়ান কোয়ার্টারলি’সহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পত্রিকায়। সম্প্রতি ইফফাতের প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য’স ক্ল্যান’ প্রকাশিত হয়েছে পেঙ্গুইন র‍্যানডম হাউস ইন্ডিয়া থেকে।
ইফফাত নাওয়াজের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি পদুচেরিতে, নিজের বাড়িতে। কথা বলতে বলতেই খেয়াল করলাম, পেছনের হলুদ দেয়ালে বিকেলের রোদ নকশা কাটছে। ইফফাতের চোখে-মুখেও তখন রোদের আভা। কাকতালীয় হলেও সত্য যে আমাদের কথোপকথনের অনেকটাজুড়েই ছিল রোদ আর আলোর কথা।

ইফফাত নাওয়াজ
ছবি: সংগৃহীত

লেখালেখির শুরুটা হলো কীভাবে?
আমার মা–বাবা দুজনই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। বাবা বিটিভির শুরুর দিকে, সেই সত্তরের দশকে ক্যামেরাম্যান ছিলেন। আমরা এখন সিনেমাটোগ্রাফার বলি, কিন্তু তখন ক্যামেরাম্যানই বলা হতো। বাবা খুব ভালো ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলার ছিলেন, দারুণ ফটোগ্রাফারও ছিলেন। হয়তো তাঁর স্টোরিটেলিং, গল্প বলার আগ্রহটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
আমার জন্ম হওয়ার আগেই বাবা আমার জন্য বই সংগ্রহ করতেন। উত্তরাধিকার সূত্রে আমার প্রথম পাওয়া সম্পত্তি হলো সেসব বই…বাঁধাই করা ‘আনন্দমেলা’র সব সংখ্যা, ‘সন্দেশ’, সত্যজিৎ রায়ের বই, সুকুমার রায়ের বই। তো সেখান থেকে বই পড়ার অভ্যাসটা শুরু হয়ে গেল। আমি ছোটবেলায় লিখতাম, কবিতা-টবিতা লিখতাম। ভিকারুন্নিসায় পড়তাম, আমাদের বার্ষিক ম্যাগাজিন ছিল, সেখানে লিখতাম। তবে পড়তেই বোধ হয় বেশি ভালোবাসতাম।
বাবা মারা যাওয়ার পর জীবন এবং লেখালেখিতে পরিবর্তন এল। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি, ছুটিতে বেড়াতে গেছি। ফ্লাইটেই বাবার হার্ট অ্যাটাক হলো। আমাদের পুরো পরিবারের সামনে বাবা সেই ফ্লাইটে মারা গেলেন। এরপর মা আমাদের দুই ভাই–বোনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেন। বাবার মৃত্যুর স্মৃতি আমি ‘সূর্য’স ক্ল্যান’–এও লিখেছি। সেখানে বোধ হয় আমি কোনোভাবে বাবার মৃত্যুর ঘটনাটা ‘রিরাইট’ (পুনর্লিখন) করতে চেয়েছি। যেভাবে আমি স্মৃতিটুকু মনে রেখেছি, তার চেয়ে ভালো করে মনে রাখতে চাওয়ার একটা প্রচেষ্টা হয়তো সেটা। এ জন্যই বলি, ‘সূর্য’স ক্ল্যান’ আসলে আমার সেমি–অটোবায়োগ্রাফিক্যাল বই।

যুক্তরাষ্ট্রের হাইস্কুলের ম্যাগাজিনে আমার লেখা পড়ে এক বন্ধু বলেছিল, ‘ইউ রাইট ফ্রম পেইন! ইউ হ্যাভ এ সোর্স টু ড্র ফর্ম, দ্যাটস হোয়াই ইটস গুড।’ (তুমি দুঃখ থেকে লেখো! তোমার লেখার একটা নির্দিষ্ট উৎস আছে, তাই তুমি এমন ভালো লিখতে পারো) তখন আমি এত কিছু বুঝতাম না। কিন্তু লেখালেখিটা আমার জন্য একটা ‘আউটলেট’ ছিল। ২০০৩ সালে ‘ডেইলি স্টার’–এর ‘লাইফস্টাইল’ পাতায় আমি ‘আন্ডার আ ডিফারেন্ট স্কাই’ নামে একটা কলাম লিখতে শুরু করলাম। সেখানে আমি নিজের কথা লিখতাম, ভিনদেশে নিজের বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতার কথা লিখতাম, ঢাকার প্রতি আমার যে সুতীব্র ভালোবাসা-আবেগ, সেসবের কথাও লিখতাম। প্রায় দশ বছর এই কলাম লিখে যাওয়া আমাকে লেখালেখির চর্চা ধরে রাখতে ভীষণ সাহায্য করেছিল।

উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন কখন, কীভাবে?
২০১০ সালে আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি। তখন আমার বয়স ত্রিশ-একত্রিশ হবে, চাকরি নিয়ে বাংলাদেশে এলাম। ‘অ্যাডাল্ট’ হিসেবে ঢাকায় ফিরে আসা, নতুন করে ঢাকাকে চেনা…একদম স্বপ্নের মতো ছিল। তখন আসলে আমি একটু বড় আকারে কিছু লিখতে চাইছিলাম। কিন্তু যা-ই লিখছিলাম, সব মনে হচ্ছিল গারবেজ। (হাসি)

ইফফাত নাওয়াজ
ছবি: সংগৃহীত


গারবেজ!

হ্যাঁ, গারবেজ! মানে আসলে নিজের গারবেজ। আমার মনে হতো, আমার নিজের ভেতর কিছু জিনিস জমে আছে, সেগুলো লেখার মাধ্যমে বের করে দিতে পারলে বোধ হয় আমি আরেকটু ভালো থাকতে পারব। এর মধ্যে ২০১৬ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেলাম। আর ফিরে যাওয়ার পর দেখলাম, ওখানে আমি আর মানিয়ে নিতে পারছি না। ঢাকার আবহ, ঢাকার জীবন আমি ভীষণ মিস করছিলাম। সেটা আমেরিকার জন্যও একটা পরিবর্তনের সময়; ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইন চলছে। সব মিলিয়ে তখন মনে হতো, ‘আমি কে?’ খুব বিভ্রান্তিকর লাগছিল। বাঙালি হিসেবে, সাউথ এশিয়ান হিসেবে আমি খুব স্ট্রংলি নিজেকে আইডেন্টিফাই করি। কিন্তু ওই সময়টা, মানিয়ে নিতে না পারার বিষয়টা আমাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিল।
তখন আমি ‘ভিপাসানা’ নামে একটা মেডিটেশন শুরু করি। দশ দিনের একটা সাইলেন্ট মেডিটেশন। এই মেডিটেশন শুরুর আগে আমি অনেক কিছুই লিখছিলাম…মূলত নিজের কথা, নিজেকে নিয়ে ভাবনার কথাই লিখছিলাম। আমার উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়টাও তখনই লেখা। ভিপাসানা শুরু করার ঠিক আগে আমি ‘সূর্য’স ক্ল্যান’–এর প্রথম অধ্যায়টা লিখি।

তারপর? উপন্যাসের বাকি অংশে বা আপনার লেখালেখিতে কি পরবর্তীকালে এই মেডিটেশন প্রভাব ফেলেছিল? আমি যখন বইটা পড়ছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল ভীষণ অন্ধকার, তীব্র দুঃখের এক অতীতের গল্পও আপনি সরল ভাষায়, শুভবোধের অনুভূতি নিয়ে লিখেছেন। অন্ধকার একটা সময়ের গল্পও আপনি আলোকিতভাবে বলেছেন। এ জন্যই জানতে চাইছি, এতে মেডিটেশনের প্রভাব ছিল কি না।
ভিপাসানার ১০ দিনের যাত্রা শেষ করে যখন আমি ফেরত এলাম, সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো, এই বই আমার লিখতে হবে। আমি জানতাম না কীভাবে লিখব বা গল্পটা বলার দক্ষতা আমার সত্যিই আছে কি না। কিন্তু বইটার প্রথম ড্রাফট আমি ২০১৬ সালের এপ্রিলে লিখতে শুরু করলাম।
আমার বইটার বড় অংশজুড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া আমার দুই চাচা শকু ও ভিকুর কথা। খুব হিসাব করে যে লিখতে বসেছিলাম, তা হয়তো নয়, কিন্তু তাঁদের মৃত্যুবার্ষিকীর ঠিক আগের দিন, ৫ এপ্রিল, আমি লিখতে শুরু করলাম। আগেই বলেছি, সময়টা আমার জন্য খুব বিভ্রান্তিকর ছিল, মেডিটেশন করছি, মানিয়ে নিতে পারছি না…কিন্তু আমার শহীদ দুই চাচার উপস্থিতি, বাবার উপস্থিতি সে সময় আমি খুব তীব্রভাবে অনুভব করছিলাম।
এদিকে আমাকে কিন্তু হিউম্যানেটেরিয়ান ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করতে হচ্ছে। আফ্রিকায় বোকো হারামের জায়গাটায় কাজ করছি, শেষ প্রজেক্টটা করলাম রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্রাইসিস নিয়ে। তো এসবের ভেতর লেখার সময়টা ওভাবে আর হচ্ছিল না। একটা অধ্যায় লিখছি, অর্ধেক অধ্যায় লিখছি, আবার দুই-তিন মাস লিখতে পারছি না। এভাবেই চলছিল।
এর মধ্যে ২০১৮ সালে আমার বয়স ৪০ হলো। আর আমার বাবা মারা যান তাঁর ৪০ বছর বয়সে। আমি সারা জীবন বলে এসেছি, যদি ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারি, যথেষ্ট! তো সেই ৪০ বছর বয়স হওয়ার পর বুঝলাম, চাকরিটা আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। এর ভেতর প্রতিবছর ভিপাসানা করেছি, প্রতিবার মনে হয়েছে, আমার যা করার কথা, করছি না। যে বই লেখার কথা, লিখছি না।

লেখালেখির প্রক্রিয়াটা বোঝার জন্য জানতে চাইছি, এই যে ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের সময়টা, এর মধ্যে আপনি কি অন্য কিছুও লিখেছিলেন? নাকি পুরো সময়টায় একটু একটু করে সূর্যর গল্পই লেখা হচ্ছিল?
অন্য লেখা আমি লেখার চেষ্টা করেছি। হয়নি। এই বইটা না লিখলে আর কিছু হবে না—এ রকম ভেতর থেকে মনে হতো।
২০১৮ সালে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর আমি সমুদ্রের কাছাকাছি একটা জায়গা খুঁজছিলাম, যেখানে বসে লিখতে পারব। আর ‘আধ্যাত্মিক’ একটা ডাকও হয়তো অনুভব করছিলাম। মনে হয়েছিল, আমাকে একটু থামতে হবে। কাজ-ছোটাছুটি থামিয়ে আমার একটু শান্ত হয়ে বসতে হবে। আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর মাধ্যমে তখন আমি পদুচেরির খোঁজ পেলাম। পদুচেরিতে বঙ্গোপসাগরের পাশে ছোট্ট একটা কটেজের ছবি দেখেই সিদ্ধান্ত নিলাম, এখানে আমি থাকতে চাই।
এখানে আসার এক মাসের মধ্যেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি পদুচেরিতেই দীর্ঘ সময় থাকতে চাই। এখান থেকেই আমি বইটা লিখতে চাই। এরপর ২০১৮ সালের অক্টোবরে, প্রথম অধ্যায় লেখার প্রায় দুই বছর পর, আমি উপন্যাসের প্রথম ড্রাফট লেখা শেষ করলাম। প্রায় ৯০ হাজার শব্দের বিশাল, জটিল এক উপন্যাস! (হাসি)

বাহ! তারপর পেঙ্গুইন র‍্যানডম হাউস ইন্ডিয়ার কাছে আপনার প্রথম লেখা উপন্যাস কীভাবে পৌঁছাল?
কনিষ্ক গুপ্ত নামের ভারতে একজন লিটারেরি এজেন্ট আছেন। তিনি উপমহাদেশের আরও অনেক লেখককেই রিপ্রেজেন্ট করেন…শিহান করুণাতিলক, গীতাঞ্জলী শ্রী…অনেককেই তিনি রিপ্রেজেন্ট করছেন। একজন আমার উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি তাঁকে পড়তে দিলেন, পড়ে তিনি পছন্দ করলেন, কিছু পরামর্শ দিলেন। বইটা তখন খুব কঠিন-জটিল ছিল।
প্রায় দেড় বছর ধরে, মহামারির পুরো সময়টায় আমি উপন্যাসটা সহজ করে লিখলাম। মাঝখানে কয়েকবার হাল ছেড়ে দিয়েছি। মনে হয়েছে, দরকার নেই লেখার; আরেকটা মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লেখা কি আসলেই জরুরি? তারপর আবার লিখতে বসেছি। আমার আশপাশের পরিবেশ থেকেও অনুপ্রেরণা পেয়েছি। এখানে শ্রী অরবিন্দের আশ্রমে সব ফুলের একটা তাৎপর্য আছে। যেমন বেলী শুদ্ধতার প্রতীক। এখানে সূর্যমুখী হলো আলোর দিকে ধাবিত হওয়া বোধের প্রতীক। মনে হলো, আমার গল্পের মূল চরিত্রের নাম সূর্যমুখী হোক। কারণ, আমাকেও বইটা সরল করে লিখতে গিয়ে আলোর দিকেই যেতে হচ্ছে। তুমি একটু আগে বলছিলে না যে গল্পটা আমি আলোকিতভাবে বলেছি! আমি আসলে সেটাই চাইছিলাম। আগের ভার্সনে অনেক জটিল কথা ছিল। বহু প্রত্যঙ্গবিশিষ্ট এক দেবীর কথা ছিল, যার প্রত্যঙ্গগুলো তাঁর শক্তি নয়, বরং বোঝা। দেড় বছর ধরে পুনর্লিখনের পর বইটা যা হলো, তা সত্যিই অনেক সহজ, সরল, আলোকিত বোধ থেকে লেখা।
কনিষ্কর সঙ্গে তারপর চুক্তিবদ্ধ হলাম। সেটা কোভিডের ঠিক পরের সময়টা। পুরো বিশ্বের প্রকাশনা জগতের জন্যই খুব ব্যস্ত সময়। প্রচুর মানুষ মহামারির সময় বই লিখেছেন, সেগুলো একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছে। কনিষ্ক বললেন, আমিও জানতাম যে বইটা যদি ছাপা হয়ও, সেটা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর ভেতর আমরা অনেকগুলো প্রকাশনী সংস্থাকে বইটা পাঠালাম…পেঙ্গুইন, পিকাডেলি, হ্যাচেট। প্রথমে হ্যাচেট ইন্ডিয়া পাবলিশার্স আগ্রহ দেখাল। কিন্তু তিন থেকে চার মাস পরও তাদের কাছ থেকে তেমন কোনো সাড়া পেলাম না। আমিও হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম।
এরপর হঠাৎই গত জানুয়ারিতে পেঙ্গুইনের দুই সম্পাদক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। একজন হলেন পেঙ্গুইন ভিন্টেজের এলিজাবেথ পুরোভিলা, আরেকজন পেঙ্গুইন প্রিন্টের এক সম্পাদক। এলিজাবেথ বইটা এক উইকেন্ডে পড়ে শেষ করেছিলেন, তারপর উনি আমার এজেন্ট কনিষ্কর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমার আসলে ঠিক বিশ্বাসও হচ্ছিল না। খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু খানিকটা ভয়ও ছিল। এ ধরনের প্রকাশনা সংস্থাগুলোয় তো বিভিন্ন বিভাগ থেকে সিদ্ধান্ত আসে। হয়তো সম্পাদকের বইটা ভালো লেগেছে, কিন্তু মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের রিসার্চ বলল, বইটা আসলে তেমন চলবে না। আবার হয়তো প্রকাশনার সব প্রক্রিয়া শেষ হতে অনেক বছর লেগে যাবে অথবা সেসব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে আদৌ বই বের হবে কি না, এ রকম অনেক শঙ্কা ছিল আরকি!

কিন্তু এই যে পেঙ্গুইন প্রিন্টের পেপারব্যাক না হয়ে এটা যে আসলে পেঙ্গুইন ভিন্টেজের ‘হার্ড কাভার’ বই হবে, এই সিদ্ধান্ত কীভাবে এল?
এটা এলিজাবেথেরই সিদ্ধান্ত। আমার চেয়ে আমার বইয়ের ওপর এলিজাবেথের বিশ্বাসই বেশি ছিল। লেখক হিসেবে সেটিও খুব অনুপ্রেরণার একটা বিষয়। উনিই বললেন, এটা ভিন্টেজ থেকে ‘হার্ড কাভার’ হিসেবে বের হবে।
এদিকে এলিজাবেথের সঙ্গে যখন আমার চুক্তি হচ্ছে, তখন হঠাৎ হ্যাচেট পাবলিশার্স আবার বইটা চাইল। ‘আরেকটু বেশি টাকা দেব’—এমন নানা কথা বলছে তখন হ্যাচেট। কিন্তু বিষয়টা আসলে কখনোই টাকার ছিল না। বই লিখে যে কেউ বড়লোক হতে পারে না, সে তো আমরা সবাই–ই এখন জানি। (হাসি) আমি বইটা পেঙ্গুইনকেই দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। কারণ, আমরা ছোটবেলা থেকে পেঙ্গুইনের বই পড়ছি, বাড়ির বুকশেলফে দেখেছি পেঙ্গুইনের লোগোওয়ালা সারি সারি বই। এত স্মৃতির সঙ্গে পেঙ্গুইন জড়িয়ে আছে যে আমি চাইছিলাম, বইটা পেঙ্গুইন থেকেই আসুক।
এলিজাবেথের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরের প্রক্রিয়াটা খুব মসৃণ ছিল। প্রুফ রিডিং ছাড়া তেমন কোনো সম্পাদনাই আসলে করতে হয়নি। খুব গুণী একজন সম্পাদকের সঙ্গে মিলে বই সম্পাদনার অভিজ্ঞতাটা হয়তো আমি পাইনি। কিন্তু এলিজাবেথ যে আমি বইটা যেভাবে লিখেছি, সেভাবেই রাখতে চেয়েছেন, এটা আমার জন্য খুব আনন্দের। অবিশ্বাস্য! আমার নিজের জন্য একটা মাইলস্টোন বলতে পারো।

বইটির প্রচ্ছদ

পেঙ্গুইনের সঙ্গে প্রকাশনার এই অভিজ্ঞতাটা আমি আসলে জানতে চাইছিলাম আমাদের নতুন লেখকদের জন্য। বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে তো আসলে ‘এজেন্ট কালচার’ বা খুব কাঠামোবদ্ধ (স্ট্রাকচার্ড) ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠেনি। তাই বাংলাদেশের একজন যখন বিশ্বমানের প্রকাশনা সংস্থা থেকে নিজের প্রথম বই প্রকাশ করছেন, তাঁর অভিজ্ঞতাটা আমাদের সবার জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সত্যিই। লেখালেখি তো একটা সৃজনশীল কাজ। এর পুরোটা শেষ করে প্রকাশনার কাজটাও যদি লেখককে করতে হয়, সেটা আসলে খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আমি কনিষ্ক গুপ্তকে এজেন্ট হিসেবে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবানই মনে করি। কনিষ্ক এবার আমার সঙ্গে ঢাকা লিট ফেস্টেও গেলেন, তাতে ঢাকার লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগটা হলো। এ ধরনের যোগাযোগ স্থাপন করাটা খুব জরুরি।
একজন ভালো এজেন্ট থাকা মানে তোমার নতুন আইডিয়া, নতুন লেখা প্রকাশনীর কাছে পৌঁছানো, তাদের পরামর্শগুলো তোমাকে পৌঁছে দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটা একজন দায়িত্ব নিয়ে করছেন। বই প্রকাশের পর তোমার বইটা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অনেকটা অংশ, পাঠকের মতামতের দিকে খেয়াল রাখার বিষয়টা একজন তোমার হয়ে দেখছেন। এতে একদিকে প্রকাশনার জগৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞ একজনের পরামর্শ যেমন তুমি পাচ্ছ, তেমনি তোমার সৃজনশীলতার ওপর চাপটাও কমছে।
হয়তো এখনো আমাদের দেশের প্রকাশনার জগৎ খুব কাঠামোবদ্ধ হয়ে ওঠেনি বলে পেঙ্গুইন বা বৈশ্বিক প্রকাশনী সংস্থার কাছে পৌঁছানোর বিষয়টা আমাদের নতুন লেখকদের খুব জটিল মনে হয়। কিন্তু আসলে নিজেকে পৃথিবীর কাছে মেলে ধরার সাহসটা থাকতে হবে। ইউ হ্যাভ টু পুট ইয়োরসেলফ আউট দেয়ার! তারপর দেখা যাক কী হয়।

প্রকাশনা থেকে আমরা আবার একটু ‘সূর্য’স ক্ল্যান’–এ ফিরে আসি। বহু জায়গা আপনি দেখেছেন, বহু জায়গায় আপনি থেকেছেন। লেখালেখিও বহু বছর ধরেই করেছেন। এত জায়গার এত গল্পের মধ্য থেকে আপনি যে ‘সূর্য’স ক্ল্যান’–এর গল্পটাই বলতে চান, সেটা কীভাবে বুঝলেন?
অন্য বই লেখার চেষ্টা করিনি, তা আসলে নয়। করেছি, কিন্তু সব সময় ১৯৪৭, ১৯৭১ এসেই যেত। কারণ, আমাদের পরিবারের ইতিহাস আসলে ১৯৪৭–এর সঙ্গে, ১৯৭১–এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় আমাদের পরিবারের ৭৫ ভাগ মানুষ ওপার বাংলায় চলে গেলেন। নানি সুন্দরবনের মানুষ, কিন্তু অন্যরা মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুরের। মা–বাবা, আমি ঢাকায়ই জন্মেছি। কিন্তু আমাদের বেড়ে ওঠা, আমাদের পরিচয় তৈরি হওয়ার মধ্যে এপার বাংলা, ওপার বাংলার পুরোটাই চলে এসেছে।
আমার জন্ম ১৯৭৮ সালে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে। তো তার ঠিক পরবর্তী দশকটায় (আশির দশকে) আমরা যারা বেড়ে উঠেছি, তাদের মধ্যে একাত্তরের ইতিহাস একরকম উত্তরাধিকার সূত্রেই চলে এসেছে। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জাগতিক সম্পদ মানুষ কী করে? বাবা-দাদার কাছ থেকে জমি পেলে, মানুষ বাড়ি বানায়। বাড়ি পেলে, সেটাকে ভেঙে বড় করে বা সেখানে বসবাস করে। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলাম স্মৃতি আর ইতিহাস। এই যে পূর্বসূরিদের স্মৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, একে লেখা ছাড়া আর কীই–বা করতে পারি? স্মৃতির একটা ম্যানিফেস্টেশন (প্রকাশ) তো করতে হবে। স্মৃতিস্তম্ভ বানাতে পারি হয়তো। তো এই লেখা, এই গল্প আমার জন্য একরকম স্মৃতিস্তম্ভই।
ছোটবেলায় পুরান ঢাকার যে বাড়িতে আমি বড় হয়েছি, সেখানে আমার উপন্যাসের বাড়িটির মতোই দুই শহীদসন্তানের ছবি ছিল। প্রতিদিন তাদের ছবি দেখেছি, তাদের কথা শুনেছি। তারা খুব অল্প বয়সে মারা গেছে, আমার বাবাও খুব কম বয়সে মারা গিয়েছেন। আমার মনে হতো, ওদের জীবনটাও তো আরও অনেক কিছু হতে পারত। তাদের জীবনের কথা, তাদের গল্পটাও তাই আমি আমার বইতে বলতে চেয়েছি। এরা প্রত্যেকেই, এদের প্রত্যেকের স্মৃতি মিলেই তো আমার ‘আমিত্বের’ অনেকটা গড়ে উঠেছে। তাই আমি বলব, ‘সূর্য’স ক্ল্যান’ আমার নিজেকে বুঝে ওঠার প্রক্রিয়াতেও সাহায্য করেছে।

‘সূর্য’স ক্ল্যান’ তো ইতিহাস–আশ্রিত উপন্যাস। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, সালমান রুশদি, টনি মরিসনের মতো যে আপনি ইতিহাস–আশ্রিত উপন্যাস ম্যাজিক রিয়েলিজমের মাধ্যমে লিখলেন, এটি কেন? আপনি কি মনে করেন, ইতিহাস–আশ্রিত উপন্যাস লিখতে ম্যাজিক রিয়েলিজম জরুরি?
জরুরি কি না, বলতে পারব না। কিন্তু মার্কেসের ‘হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’ আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। উপন্যাসের প্রথম ভার্সন যখন লিখছি, তখন আমি কলম্বিয়ায় গেলাম, কার্তাহেনায় মার্কেসের বাড়ি ঘুরে এলাম। ভাবছিলাম, আমাদের কেন একটা ‘ফিফটি ওয়ান ইয়ার্স অব সলিচিউড’ নেই!
ম্যাজিক রিয়েলিজম বোধ হয় ইতিহাস থেকে, ফ্যাক্ট চেকিং থেকে এক পা পেছনে সরে এসে আমাদের গল্প বলার জায়গাটা দেয়। আমার বইটা তো ঐতিহাসিক ঘটনার বই না। এটা মানুষের ওপর, মনোজগতের ওপর স্মৃতির প্রভাব, ইতিহাসের প্রভাবের গল্প। এমনকি আমি তো ঘটনাগুলো যখন ঘটছে, অর্থাৎ একাত্তরে কী হচ্ছে, সে গল্পও বলছি না। আমি বলছি পরবর্তী প্রজন্মের ওপর সেই ইতিহাসের প্রভাবের কথা। তাই আমাকে ম্যাজিক রিয়েলিজমের মাধ্যমেই গল্পটা বলতে হতো। আর আমি বোধ হয় ম্যাজিক রিয়েলিজম ছাড়া লিখতেও পারি না। ম্যাজিক রিয়েলিজমের মতো করেই আমি জগৎটাকে দেখি। (হাসি)

দ্যাটস আ বিউটিফুল ওয়ে টু সি দ্য ওয়ার্ল্ড! এখন কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন? কী লিখছেন?
এখন যে গল্প লিখছি, সেটার নাম আপাতত ‘ইজি লাভ’। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’–এ একটা কথা আছে ‘সহজ সুখ সহজ নয়’। সেখানে চারুলতা বুঝতে পারছে যে তার আগের সহজ জীবনে ফেরত যেতে তার আসলে জটিলতাহীন অনেক ভালোবাসা প্রয়োজন। আমার গল্পটা এই ‘সহজ ভালোবাসা’র কথা বলছে। পদুচেরির মতো সাগরপাড়ের এক শহরে আসা ৯ জন মানুষকে নিয়ে এ গল্প। তারা প্রত্যেকেই ‘সহজ ভালোবাসা’ খুঁজছেন। কিন্তু ইজি লাভ হ্যাজ এস্কেপড দ্য সিটি! সহজ ভালোবাসা সে শহর ছেড়ে পালিয়েছে বহু আগেই।